Originally posted in সমকাল on 31 July 2022
সাম্প্র্রতিক সময়ে সরকারি দায়দেনা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক দায়দেনা পরিস্থিতির জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এ আলোচনা জোরালো হয়েছে। শুধু শ্রীলঙ্কাতে নয়; এরূপ আর্থিক সংকট ঘানা, জিম্বাবুয়ে, পাকিস্তান এমনকি নেপালেও চলছে। এসব দেশে দায়দেনা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক সংকট এখন রাজনৈতিক সংকটে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশে দায়দেনা এখনও স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকলেও নিকট আগামীতে এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার মতো বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
সব দেশের সরকারি দায়দেনা পরিস্থিতি জটিল হওয়ার সাধারণত তিনটি কারণ দেখা যায়। প্রথমত, যথেষ্ট পরিমাণে অভ্যন্তরীণ সম্পদ না থাকলে অর্থাৎ কর আহরণ ব্যবস্থা খুব দুর্বল থাকলে সরকার প্রয়োজনীয় পরিমাণে ব্যয় করতে পারে না। ফলে উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে বড় ধরনের ঘাটতি থেকে যায়। দ্বিতীয়ত, বহির্বিশ্বের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে যদি দুর্বলতা সৃষ্টি হয়। যেমন রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ হ্রাস এবং বিদেশে থাকা দেশের সম্পদ থেকে আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া। তৃতীয়ত, সাশ্রয়ী উৎসের বদলে অনেক বেশি ব্যয়বহুল উৎস থেকে ঋণ নিলে দায়দেনা পরিস্থিতি জটিল হয়। এসব কারণে নিজস্ব মুদ্রার বিনিময় হারের পতন ঘটে। জাতীয় মুদ্রার মূল্যমান কমে যেতে থাকলে সরকারি ঋণ পরিশোধে আরও বেশি নিজস্ব মুদ্রা ব্যয় হয়। অপরদিকে দায়দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে প্রবৃদ্ধির হার কমে যায়। মূল্যস্ম্ফীতি বেড়ে যায় ও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমতে থাকে। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা এবং ক্রেডিট রেটিংও কমে যায়। শ্রীলঙ্কাতে সাম্প্র্রতিককালে তাই ঘটেছিল।
সরকার যখন দায়দেনা মেটাতে পারে না অথবা সুদ-আসল মেটানোর জন্য আবার ঋণ নিতে হয়, তখন সেই দায়দেনা টেকসই নয় বলে প্রতিভাত হয়। অনেক ক্ষেত্রে বলা হয়, মোট দেশজ আয়ের (জিডিপির) নির্দিষ্ট শতাংশের ওপর হলে দায়দেনা পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক বা এর নিচে থাকলে খুব ভালো। অর্থনীতি শাস্ত্রে এই শতাংশের হিসাব খুব যৌক্তিকভাবে স্থাপন করা যায়নি। যেমন জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের দায়দেনা তাদের জিডিপির যথাক্রমে ২৬৬ শতাংশ এবং ১২৫ শতাংশের ওপরে। কিন্তু এ দুই দেশ কোনো সময়ে খেলাপি হয়নি। আবার এমনও দেখা গেছে, অনেক দেশের দায়দেনা দেশজ আয়ের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ, কিন্তু তাদের কেউ কেউ অভ্যন্তরীণ বা অন্য উৎস থেকে দায়দেনা মেটানোর জন্য অর্থ জোগাড় করতে পারেনি। সাধারণভাবে অর্থনীতি শাস্ত্রে ঐকমত্য আছে- ‘ফিসক্যাল কনসোলিডেশন’ অর্থাৎ আর্থিক খাতকে সংহতকরণের ভিত্তিতে সরকারি দায়দেনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। আর্থিক খাত সংহতকরণ করার মানে হলো, সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে কর আহরণ বাড়ানো। উপরন্তু বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং আর্থিক পরিণামদর্শিতার ভিত্তিতে তার অর্থায়ন করতে হবে।
বর্তমান দায়দেনা পরিস্থিতি
আইএমএফের হিসাবে বাংলাদেশের সরকারি দায়দেনা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তুলনামূলক কম, যা দেশজ আয়ের প্রায় ৩৫ শতাংশ। সরকারি হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দায়দেনা ১৩১ বিলিয়ন ডলার, যা গত তিন বছরে প্রতি বছর দেশজ আয়ের প্রায় আড়াই শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ গত তিন বছর সরকারি দায়দেনাতে বছরে মোট গড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার করে বেড়েছে। দায়দেনা বাড়ার হার সাম্প্র্রতিককালে খুবই বেশি। তবে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ উৎসের প্রাধান্য রয়েছে। কারণ তা মোটের প্রায় ৫৬ শতাংশ।
অনেক বিষয় থাকে, যেগুলো দায়দেনার সরকারি হিসাবের ভেতরে প্রকাশিত বা বিবেচিত হয় না। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব দায়দেনা আছে। সেগুলো অভ্যন্তরীণ দায়দেনার ভেতরে বিবেচিত হয় না। সরকারের কিছু সংযুক্ত দায় আছে। অর্থাৎ সরকার যেসব ঋণ অধিগ্রহণ করেছে বা দায়িত্ব নিয়েছে বা গ্যারান্টি দিয়েছে সেগুলোও হিসাবের ভেতরে নেই। সরকার অনেক সময় বাজেটবহির্ভূত অর্থায়ন করে। অর্থাৎ বাজেটের বাইরে রেখে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক লেনদেনে যুক্ত হয়। আবার সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একে অপরের কাছে যে দায়দেনা সেগুলোও অনেক সময় হিসাবে আসে না।
উপরন্তু কিছু ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে অনেক সময় সরকার ফেরত দেওয়ার গ্যারান্টি দিচ্ছে। এটিও দায়দেনার হিসাবের মধ্যে প্রকাশিত হয় না। উপরন্তু, অনেক সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ হচ্ছে। সেখানে সরকারের অংশের জন্য বা তার সহযোগীর জন্য অনেক সময় গ্যারান্টি দেওয়া হয়। সেগুলোও যদি খেলাপি হয় তাহলে এর দায় সরকারের ওপর আসবে। ফলে সরকারি দায়দেনার হিসাব পূর্ণাঙ্গ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
তাই দেশের প্রকৃত দায়দেনার পরিমাণ বা মাত্রা সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি। আমরা হিসাব করে দেখেছি, সরকারের সংযুক্ত দায়, আন্তঃসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায় এবং বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ যদি যোগ করা হয় তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রকৃত দায়দেনা হবে দেশজ আয়ের প্রায় ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এই সংখ্যা সরকারের হিসাবের চেয়ে দেশজ আয়ের অংশ হিসাবে প্রায় ৩ শতাংশ বেশি। দেশের বৃহৎ ২০টি মেগা প্রকল্পের সর্ববৃহৎ তিন ঋণদাতা যথাক্রমে রাশিয়ান ফেডারেশন (৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ), জাপান (৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ) এবং এক্সিম ব্যাংক অব চায়না (২১ দশমিক ২ শতাংশ)। আর এ ২০টি প্রকল্পের ঋণের ধরনের মধ্যে রেয়াতি ঋণ ৭৩ দশমিক ৩ শতাংশ, আধা-সাশ্রয়ী ঋণ ৪ দশমিক ৪ শতাংশ, অসাশ্রয়ী ঋণ ১১ দশমিক ১ শতাংশ এবং অনুদান ১১ দশমিক ১ শতাংশ।
স্বস্তিদায়ক অবস্থা থাকবে?
বাংলাদেশের দায়দেনা পরিস্থিতির শুধু পরিমাণগত নয়, গুণগত পরিবর্তনও হচ্ছে। পরিমাণগত পরিবর্তন আগামী ২০২৪ ও ‘২৫ সালের দিকে ক্রমশ দেখা যাবে। সে সময়ে সম্ভবত বাংলাদেশ তার ‘সবুজ’ অবস্থান অর্থাৎ স্বস্তিদায়ক অবস্থান অতিক্রম করে একটি অস্বস্তির বা ‘হলুদ’ অবস্থানের দিকে যাবে। কেননা, আমরা ক্রমান্বয়ে বহুপক্ষীয় উৎসের বদলে অনেক বেশি উচ্চমূল্যে দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে মেগা প্রকল্পগুলো, অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নে যাচ্ছি। সংক্ষিপ্ত রেয়াতি কাল (অনেক ক্ষেত্রে ৫ বছর) এবং পরিশোধ কাল (অনেক ক্ষেত্রে ১৫ বছর) থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ‘সম্মানবর্ধক’ প্রকল্পের জন্য চীন ও রাশিয়া থেকে ব্যয়বহুল ঋণ নেওয়া হচ্ছে। ঋণগুলো তখনই নিচ্ছি, যখন আমাদের অব্যবহূত সাশ্রয়ী বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। সেই অনুদান বা সামান্য সুদের অর্থ আমরা ব্যবহার করতে পারছি না।
আগামী দিনে আরও বড়ভাবে দায়দেনার পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসবে। কিছু উচ্চমূল্যের সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট বা ঠিকাদারদের ঋণ রয়েছে। যেমন পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। রেল সেতুর জন্য ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার চীন থেকে সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট নেওয়া হচ্ছে। সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট হলো, কাজটা যে করে সে অর্থের জোগান দেয়। সেখানে অনেক সময় আমদানিকৃত পণ্যমূল্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না। সবচেয়ে বড় সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট চীনের; ৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। তার ভেতর ২ বিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছে। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট বা উচ্চমূল্যের ঋণ রয়েছে। এসব ঋণ পরিশোধের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, দায়দেনা নিয়ে উদ্বেগ তত বাড়বে।
আমাদের জাতীয় দায়দেনা বৃদ্ধির হার জিডিপি বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আগামী দিনে অবশ্যই আমাদের জিডিপির অংশ দায়দেনা হিসেবে বাড়বে। দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে বৈদেশিক উৎসের চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়বে। বিশেষ করে উচ্চমূল্যের ঋণের রেয়াতি সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে।
তবে এ পরিস্থিতির অন্যতম দুর্বল জায়গা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ঋণ। অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রায়শ আমাদের দায়দেনা পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে আলোচনা করা হয় না। বলা বাহুল্য, যত বেশি অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিশোধে অর্থ খরচ হবে, তত বেশি উন্নয়নের জন্য অর্থের লভ্যতা কমবে।
পাঁচ ঝুঁকি ও তিন বার্তা
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনাটা অযৌক্তিক। কারণ একেকটি দেশ একেকভাবে বিকশিত হয়। বিবেচনার বিষয় হলো, শ্রীলঙ্কা থেকে কী শেখার আছে? শ্রীলঙ্কা যে ধারটা নিয়েছে, তার অনেকটাই ব্যক্তি খাতের ধার এবং সরকার বন্ড ছেড়ে ঋণ নিয়েছে। এক সময় আমাদের এখানে অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের কথা বলে ‘সভরেন বন্ড’ ছাড়ার কথা বলা হয়েছিল। আমরা এর সমালোচনা করেছিলাম এবং এ বিষয়ে অনেক বেশি রক্ষণশীল ছিলাম। শ্রীলঙ্কাতেও এমন রক্ষণশীল পক্ষ ছিল, যারা হাম্বানটোটা বন্দর নির্মাণের বিপক্ষে ছিল। তারা বিদেশে বন্ড দিয়ে টাকা তোলার বিরোধী ছিল। কিন্তু সরকার তাদের কথা শোনেনি।
বর্তমানে দায়দেনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাঁচ ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। বিনিময় হারের ঝুঁকি, অর্থাৎ যে বিনিময় হারে ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে টাকার মূল্য অবনমন হয়ে গেলে বেশি টাকা দিতে হবে ধার পরিশোধের জন্য। অপরদিকে আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎসের ঋণের সুদের হার আগামীতে বাড়বে। বৈদেশিক ঋণের সুদের হারের ঝুঁঁকিও কিছুটা বাড়ছে, তবে অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থায় আছে। অন্যদিকে কোনো কোনো প্রকল্পে অর্থায়ন উচ্চমূল্যে হচ্ছে, যা প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধির ঝুঁঁকি বাড়াচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পর আয় দিয়ে ঋণ শোধ করা যাবে কিনা, সে ঝুঁকিও রয়েছে।
সবশেষে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিতে চাই। প্রথমত, বাংলাদেশের সরকারি দায়দেনা পরিস্থিতিতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর মাধ্যমে আর্থিক খাতের সুসংহতকরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্যও রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতেও এটা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যের সূচকগুলোয় সুরক্ষা দিতে হবে। যেমন, রেমিট্যান্সে উচ্চ প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে। রপ্তানি বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, অনেক বেশি পূর্ণাঙ্গ, স্বচ্ছভাবে এবং নিয়মিত দায়দেনা পরিস্থিতি নজরদারিতে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যাকে অস্বীকার করার মনোভাব থেকে সরে আসতে হবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: অর্থনীতিবিদ ও সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)