বাজারে অসাধুচক্র ও মধ্যস্থতাকারীদের অন্যায্য হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in আমাদের সময় on 24 August 2024

দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা পণ্যমূল্যে স্বস্তি নেই

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে বাজার মনিটরিং শুরু করলেও চাল, পেঁয়াজ, আলুসহ বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম এখনো নিয়ন্ত্রণহীন। বাড়তি মূল্যের জন্য খুচরা এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা একে অপরকে দোষারোপ করলেও অন্তরালে এখনো বাজার সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। থেমে নেই মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যও। এদিকে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে পাকা রসিদ ব্যবহারে ব্যবসায়ীদের বারবার সতর্ক করা হলেও তা মানা হচ্ছে না। বন্ধ হয়নি কমিশন বাণিজ্য। এখনো পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে অসাধুচক্র। এতে চড়া দামে পণ্য কিনে ভোক্তার কষ্ট ও হতাশা কেবল বাড়ছে।

বাজারসংশ্লিষ্টরা জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নিত্যপণ্যের দাম না বাড়লেও তেমন কমেনি। তবে পণ্যপরিবহনে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ হওয়ায় সবজিসহ কিছু পণ্যের দাম কমেছে। যদিও সবজি ছাড়া বাজারে অন্য পণ্যগুলোতে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।

ব্যবসায়ীরা জানান, অতীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ঘাটে ঘাটে চাঁদা আদায় করতেন। পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে এটি ছিল অন্যতম কারণ। বর্তমানে চাঁদাবাজি অনেকটাই বন্ধ রয়েছে। এর প্রভাবে সবজিসহ কিছু পণ্যের দাম কমেছে। কিন্তু অন্যান্য পণ্যের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

রাজধানীর খুচরা বাজার চিত্র বলছে, মাসের ব্যবধানে চালের দাম এখনো কেজিপ্রতি ২ থেকে ৪ টাকা বাড়তি রয়েছে। পেঁয়াজের কেজি শতকের ঘরে। আলুর দরে নড়চড় নেই। ডিমের দামেও হাত পুড়ছে। ফার্মের ডিমের ডজন ১৫০ টাকা। ব্রয়লারের দাম কিছুটা কমলেও এখনো নিম্নআয়ের ভোক্তাদের কিনতে কষ্ট হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা গুনতে হচ্ছে। গরুর মাংসের দামে এখনো চড়া। তরকারির দাম কমলেও আকস্মিক বন্যার প্রভাবে আবার বাড়তে শুরু করেছে। মাছের বাজারও অপরিবর্তিত। সস্তার পাঙাশ কেজি ২০০ থেকে ২২০ আর তেলাপিয়া ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম না কমায় অন্য মাছের কাছে ভিড়ছেন না স্বল্প আয়ের ভোক্তারা। অন্যদিকে দীর্ঘসময় ধরে পেঁয়াজ, আলুসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হাঁপিয়ে উঠেছেন ভোক্তারা।

কদমতলী এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. কৌশিক আহমেদ বলেন, বাজারে গেলে কেবল হতাশা বাড়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ৩০-৪০ টাকা আর আলুর কেজি ২০-২৫ টাকা হওয়া দরকার। অথচ, লম্বা সময় ধরে এগুলো তিনগুণেরও বেশি দামে কিনে খেতে হচ্ছে। চাল কেজিতে ২ টাকা বাড়তি। ডিমের ডজন এখনো ১৫০ টাকা। দামের উত্তাপে মাছ-মাংস খাওয়া কমাতে হয়েছে। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে বাজার ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর এখনই উপযুক্ত সময়। চাঁদাবাজি বন্ধের সুফল মিলছে কিছু পণ্যে। এখন বাকি সমস্যাগুলোও দূর করতে হবে।

অটোরিকশাচালক মো. কাশেম মোল্লা বলেন, কম আয়ের মানুষের জন্য চাল, ডাল, তেল, আলু, ডিমÑ এসবের

দাম বাড়তি থাকলে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। লবণের দামটাও বাড়তি। কম দামের পাঙাশ-তেলাপিয়ার কেজি ২০০-২৪০ টাকা। বাজার খরচ সামাল দিতে গেলে অন্য খরচে টান পড়ে।

রাজধানীর শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজারের বেশ কয়েক পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ী ও উৎপাদকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সড়ক ও বাজারে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হলেও বাকি সবকিছু আগের মতো চলছে। হাতবদলের সংখ্যা আগের মতোই, যা প্রতিটি ধাপে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। উৎপাদকরা কম দাম পেলেও বাড়াত দামে বিক্রি করে বেশি লাভ তুলে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীর বেশিরভাগই রসিদবিহীন পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করছেন। সিন্ডিকেটের তোড়ে গরুর মাংস দাম বাড়ার পর আর কমেনি। মুরগি ও ডিমের বাজারেও সক্রিয় পুরনো সিন্ডিকেট। পেঁয়াজসহ অন্য অনেক পণ্যে চলছে কমিশন বাণিজ্য। ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে নয়, ফোনে নির্ধারণ করা দামেই বিক্রি হচ্ছে পণ্য।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাঁদাবাজি বন্ধ হওয়ায় ব্যবসায়ীদের ‘হিডেন কস্ট’ কমেছে। এর প্রভাব কিছু পণ্যমূল্যে পড়েছে। কিন্তু চাঁদাবাজি একমাত্র সমস্যা নয়। এটি সমস্যাগুলোর একটি মাত্র। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে আরও অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা, যা এখনো ভোগাচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও নানা অনিয়ম। অনেক পণ্যের বাজারে প্রতিযোগিতার অভাবসহ বেশকিছু দুর্বলতা রয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। কারণ, আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর এবং উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তা স্তরে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি মনিটরিং সংস্থা রয়েছে, বিভিন্ন আইন আছে, কিন্তু সেগুলো সক্রিয় না। সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে অবশ্যই সঠিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা ছাড়া আমাদের পরিসংখ্যানেও ত্রুটি রয়েছে। সেগুলো আরও নির্ভুল হতে হবে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজারে অসাধুচক্র ও মধ্যস্থতাকারীদের অন্যায্য হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া বাজারে প্রতিযোগিতার ঘাটতি রয়েছে। কিছু আমদানিনির্ভর পণ্য রয়েছে, এতে বাজারে হাতে গোনা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য দেখা যায়। অযৌক্তভাবে পণ্যমূল্য যাতে না বাড়তে পারে সে জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিযোগিতা কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি শক্তিশালী করতে হবে। সরবরাহ নিশ্চিতের বিষয়ে সরকারকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজনে আমদানি করে মজুদ বাড়ানো উচিত। এক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানো যেতে পারে। তা ছাড়া মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনমানের অবনমন কাটিয়ে ওঠাও বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারকে আয় বাড়ানোর দিকেও নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করতে হবে।

বাজার বিশ্লেষক গোলাম রহমান বলেন, দেশ নানা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রথমত মূল্যস্ফীতি কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় যে দুর্বলতা রয়েছে সেগুলোতে নজর দিতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে। যেসব অসাধুচক্র কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে।