Originally posted in বাংলাদেশ প্রতিদিন on 21 August 2025
দীর্ঘ হচ্ছে টিসিবির ট্রাকে ক্রেতার লাইন
♦ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকায় সরকারি ট্রাকই শেষ আশ্রয় ♦ বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা স্থায়ী সমাধান নয়

সকাল ৮টা। রাজধানীর মগবাজার মোড়ে বাজারের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন গৃহিণী রহিমা খাতুন। লাইনে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আরও অনেকেই। ট্রাক তখনো আসেনি। ১০টার দিকে ট্রাক পৌঁছালে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। অনেকেই দৌড়ে আসার সময় পড়ে গিয়ে আঘাতও পান। তবু কেউ লাইন ছাড়েন না। অসহায়ত্বের সুর রহিমা খাতুনের কণ্ঠে। তিনি বলেন, বাজারে চাল ১ কেজি ৭০ টাকার ওপরে, এখানে ৩০ টাকায় পাওয়া যায়। স্বামীর আয় ১৫ হাজার টাকার বেশি না। ঘরে বাচ্চাদের খাওয়াব কী? তাই টিসিবির ট্রাকের এই চাল-তেল না নিলে সংসার চলে না। রিকশাচালক আবদুল করিমও নিয়মিত লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্য নেন। ট্রাক থেকে পণ্য না কিনলে মাস শেষে ঋণ করতে হয়। এখানে কিনে মাসে অন্তত এক থেকে দেড় হাজার টাকা সাশ্রয় হয়, সেই টাকা দিয়ে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চলে যায়।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে টিসিবির ট্রাকের পেছনে প্রতিদিন দেখা যায় এ চিত্র। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকায় সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এবং ওএমএসের ট্রাকের সামনে মানুষের এই সারি দীর্ঘ হচ্ছে দিনদিন। দীর্ঘ দিন পণ্য বিক্রি বন্ধ থাকার পর গত ১০ আগস্ট থেকে টিসিবি ভর্তুকি মূল্যে ‘ট্রাকসেল’ কর্মসূচি শুরু করে। সরকারি উদ্যোগে টিসিবির ভ্রাম্যমাণ ট্রাক থেকে মিলছে তেল, চিনি ও ডাল, আর খাদ্য অধিদপ্তরের ওএমএস ট্রাকে পাওয়া যাচ্ছে চাল-আটা। দাম বাজারের চেয়ে অনেকটা কম। বাজারে তেল ১৭৫-১৮০ টাকা, টিসিবিতে ১১৫ টাকা, ডাল ৯০-১০০ টাকার বদলে ৭০ টাকা; চিনি ৮০ টাকা কেজি। আর ওএমএসে মোটা চাল ৬০-৭০ টাকার বদলে ৩০ টাকা, আটা পাওয়া যাচ্ছে ৫৫ টাকা কেজিতে। এই সাশ্রয়ই স্বল্প আয়ের মানুষকে লাইনে টেনে আনছে। এফডিসি গেট এলাকায় ওএমএসের ডিলার নুরুল ইসলাম মৃধা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত পণ্য বিক্রি করা হয়। মঙ্গলবার আমরা খাদ্য অধিদপ্তর থেকে ১ হাজার ৫০০ কেজি চাল ও ২ হাজার কেজি আটা বরাদ্দ পেয়েছি। জনপ্রতি ৫ কেজি চাল ১৫০ টাকা আর ২ কেজি আটা ১১০ টাকায় দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ৩০০ জন মানুষকে দেওয়া সম্ভব এসব পণ্য। তার মতে, বরাদ্দ বাড়ালে আরও মানুষ উপকৃত হতো। ‘দুপুরের মধ্যেই লাইনে দাঁড়ানো অর্ধেক মানুষ খালি হাতে ফিরে যায়,’ বলেন তিনি।
ওএমএসের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গতকাল ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৭০ জায়গায় ট্রাকে করে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি হয়েছে। এতে ছিল ১ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন চাল ও ২ হাজার মেট্রিক টন আটা। টিসিবিও একইদিনে রাজধানীর ৬৮ জায়গায় ভ্রাম্যমাণ ট্রাকসেল পরিচালনা করেছে। তবে স্বস্তির পাশাপাশি অভিযোগও আছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা, বরাদ্দ সীমিত হওয়ায় খালি হাতে ফেরা, কিছু অসাধু দালালের কারসাজি-এসব নিয়ে অসন্তোষ শোনা যায়। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, দালালরা বেশি করে কিনে পরে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে। আবার পণ্যের মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তবু দিনমজুর, গার্মেন্টকর্মী, গৃহকর্মী, রিকশাচালক কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বলছে-এ ট্রাকই এখন তাদের বাঁচার ভরসা। অর্থনীতিবিদরা অবশ্য ভিন্ন চোখে দেখছেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘টিসিবি ও ওএমএসের উদ্যোগ দরিদ্রদের জন্য তাৎক্ষণিক স্বস্তি। কিন্তু এটি স্থায়ী সমাধান নয়। মূল বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণে না আনলে মানুষের এই ভোগান্তি দূর হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারকে সরবরাহ ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, উৎপাদন ও আমদানিতে জটিলতা দূর করতে হবে, মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বাজার তদারকিকে কার্যকর করতে হবে।’
গত এক বছরে রহিমা, করিম কিংবা আরও অসংখ্য সাধারণ মানুষের কণ্ঠে ফুটে উঠছে একটিই বার্তা, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকায় সরকারি ট্রাকই তাদের শেষ আশ্রয়। আর তাই প্রতিদিন লাইন শুধু লম্বাই হচ্ছে, ছোট হচ্ছে না।