Originally posted in সময়ের আলো on 14 May 2025
সঙ্কুচিত বাজেট
ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন পরিবেশে আসছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আগামী ২ জুন নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
আসন্ন বাজেটের দুটি বিশেষত্ব থাকছে। এর একটি হচ্ছে- দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আগের বছরের তুলনায় ছোট বাজেট দেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়ত জাতীয় সংসদ কার্যকর না থাকায় ১৭ বছর পর ২০০৭-০৮ সালের মতো টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে বাজেট ঘোষণা করা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটটি হতে যাচ্ছে সংকোচনমূলক বাজেট। বাজেটের আকার হবে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী বাজেটের মূল আকার ৭ হাজার কোটি টাকা কমবে। যা অতীতে দেশে আর কখনো এমনটি দেখা যায়নি।
নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। একই সঙ্গে বাজেটটি হবে সমতাভিত্তিক ও কল্যাণমুখী। আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। বিশেষ জোর দেওয়া হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে। এ ছাড়া উজ্জীবিত করা হবে গ্রামীণ অবকাঠামো খাতকে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতা ও সুবিধাভোগীর ভাতাও কিছুটা বাড়বে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা থাকবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আগামী অর্থবছরেও বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখা হবে। নতুন বাজেটে ব্যক্তি করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে পৌনে ৪ লাখ বা ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তবে বাড়তে পারে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক। আগামী বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হবে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা করা হয়।
এবারের বাজেটে থাকবে না বড় বড় মেগা প্রকল্প। আগামী অর্থবছরে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে সেই লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ‘আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রথম অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এ ছাড়া নজর থাকবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জ্বালানি সাশ্রয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে বাজেটে। চাইব মানুষের জীবনযাত্রা যেন সহজ হয়।’
আগামী বাজেট কেমন হওয়া দরকার এবং কোন কোন খাতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার সে বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ সময়ের আলোকে বলেন, ‘আগামী বাজেট হওয়া দরকার জনবান্ধব। আগের সরকারের সময় দেখা গেছে, বাজেট ঘোষণার সময় বলা হতো জনবান্ধব বাজেট, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে জনবান্ধব না-বরং সরকারবান্ধব বাজেট দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের বাজেট দেওয়া হয়েছে, বড় বড় প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এভাবে বড় বাজেট এবং মেগা প্রকল্প নেওয়া হতো মেগা দুর্নীতির জন্য। প্রকল্পের টাকা লোপাট করে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং দলীয় নেতারা বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। তাই বড় বাজেট দেওয়া মানেই ভালো বাজেট- বিষয়টি তেমন না। শোনা যাচ্ছে এবার চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা দেওয়া হবে। আমি বলব- এটি ভালো সিদ্ধান্ত।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগামী বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সুরক্ষায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রাধান্য দেওয়া দরকার। মূল্যস্ফীতির লাগাম যাতে টেনে ধরা যায় তার জন্য নতুন বাজেটে পর্যাপ্ত উপাদান থাকে। কারণ টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে দেশের সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। এমন বাজেট হওয়া দরকার যার মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেয়।’
দেশ স্বাধীনের পর থেকে কখনোই দেখা যায়নি নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার আগের অর্থবছরের চেয়ে ছোট হয়েছে। সাধারণত নতুন বাজেটের আকার তার আগের বছরের তুলনায় গড়ে ৬ থেকে ৮ শতাংশ বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়। আর বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ বছরে দেখা গেছে, কোনো বছর ৫০ হাজার, কোনো বছর ৬০ হাজার বা কোনো বছর ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ কোটি টাকা বাড়িয়ে নতুন বাজেটের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এবারই প্রথম আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেটের আকার কমাতে যাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।
আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা বাজেটে থাকবে বলে জানা গেছে। আর চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরেও বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচেই রাখা হবে। আগামী অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা কমিয়ে ইতিমধ্যে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, চলতি অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে থাকবে।
আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার নিচে থাকলে সাড়ে ছয় শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি এমনটি থাকবে বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, আইএমএফের শর্ত মেনে নতুন বাজেটে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বাড়াতে পারে সরকার। এতে রাজস্ব কিছুটা বাড়লেও সাধারণ মানুষের ব্যয় বহুগুণে বাড়বে, চাপে পড়বে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্র বলছে, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আগামী বাজেটে শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং উৎসে কর (এআইটি) বাড়ানো হচ্ছে।
এ ছাড়া আগামী বাজেটে সরকার সব পণ্যে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর বসানোর পরিকল্পনা করছে। বর্তমানে অসমভাবে ভ্যাট বসানো হচ্ছে। কর ছাড় কমিয়ে রাজস্ব বোর্ড নতুন কর ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক উন্নতির মাধ্যমে অতিরিক্ত ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বিশ্বে সর্বনিম্ন। মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের সবশেষ বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে সতর্ক করে বলা হয়েছে- রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কম হওয়ায় অন্যান্য বিনিয়োগে সরকারের টাকা দেওয়ার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক জাতীয় শুল্কনীতির আওতায় করের টাকা স্বচ্ছভাবে খরচের কাঠামো, অভিন্ন ভ্যাট হার এবং শুল্ক ও অশুল্ক বাধা কমানোসহ একাধিক প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিগত সংস্কারের সুপারিশ করেছে। তাই আগামী বাজেটে এসবের প্রতিফলন থাকতে পারে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সময়ের আলোকে বলেন, ‘এবারের বাজেট বিশেষ একটি পরিস্থিতিতে আসতে যাচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যেই আভাস পাচ্ছি নতুন বাজেট চলতি বাজেটের চেয়ে আকারে ছোট হবে। আমি মনে করি এটি ভালো দিক। কারণ শুধু আকারে বড় দেখানোর জন্য প্রতি বছর বড় বাজেট দিতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।’
উল্লেখ্য, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার মূল বাজেট ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। পরে তা সংশোধন করে সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকার মধ্যে সীমিত রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা করা হয়েছিল।