Published in Prothom Alo on Friday, 5 June 2015.
বিশ্লেষণ
বাজেটের আর্থিক কাঠামো কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
বাংলাদেশে নতুন বাজেট নিয়ে যত আলোচনা হয়, বিদায়ী বাজেটের প্রাক্কলনগুলো কতখানি বাস্তবায়ন হলো, তা খুব সামান্যই পর্যালোচনা করা হয়। এমনকি যাঁরা ‘বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয়’ বলে প্রায়ই মন্তব্য করে থাকেন, তাঁরা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে পরবর্তী সময়ে তাঁদের মতের যথার্থতা প্রতিষ্ঠা করেন না।
অবশ্য এটা করার ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে অর্থমন্ত্রী নতুন বাজেট উপস্থাপনকালে বিদায়ী বছরের অর্জন হিসেবে সংশোধিত বাজেটকে উল্লেখ করে থাকেন, কোনো ক্ষেত্রে জুলাই-মার্চ সময়কালের প্রকৃত পরিসংখ্যান দিয়ে থাকেন। আমরা তাই মূল সূচকের জুলাই-জুন সময়কালের প্রকৃত বা অর্জিত পরিসংখ্যান পাই না। অথচ এ তথ্য না পেলে পরবর্তী অর্থবছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর বৃদ্ধির হার সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। সদ্য প্রস্তাবিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
প্রাক্কলিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা ও প্রকৃত অর্জনকে তুলনা করলে দেখা যায়, এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গত তিন অর্থবছরে (২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫) মোট রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এই পার্থক্য ছিল যথাক্রমে ৮.৩%, ১৬.২% ও ১৬.৪%। ব্যয়ের ক্ষেত্রে তুলনীয় পার্থক্যগুলো হচ্ছে ৯.২%, ১৫.৪% ও ১৭.৪%। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে বাস্তব অর্জনের পার্থক্য বৃদ্ধি এক অর্থে বাজেটের আর্থিক কাঠামোর গুণগত মানের ক্ষয়ই নির্দেশ করে।
বাজেটের আয় ও ব্যয় প্রাক্কলন যে বাস্তবে প্রতিফলিত হচ্ছে না শুধু তাই নয়, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রেও পরিকল্পনামাফিক অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন, গত বছর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বৈদেশিক সাহায্যের প্রায় ৫০% পাওয়া যায়নি। অবশ্য আয়-ব্যয় দুটিই কম হওয়ায় বাজেট ঘাটতির ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েনি।
যেটা বলতে চাইছিলাম সেটা হলো, সদ্য ঘোষিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটকে আমাদের সাম্প্রতিক এই অভিজ্ঞতার আলোকে দেখতে হবে। যেমন ধরুন, আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্ব বৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২৭%-এর ওপরে (বিদায়ী বছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার ওপর আগামী বছরের প্রাক্কলন), অথচ যাকে আমরা বিদায়ী বছরের শেষে সম্ভাব্য অর্জনের পরিমাণ বিবেচনায় নিই, তবে এই বৃদ্ধির হার হবে ৩৫%-এর ওপরে। অথচ গত দুই বছর (২০১৩-২০১৪) এই বৃদ্ধি ছিল ৪০%-এর কম। তাহলে আগামী রাজস্ব আয়ের প্রাক্কলনে যথার্থতা নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলে, তাহলে কি সেটা খুব অন্যায় হবে?
রাজস্ব আয় ১০% বৃদ্ধির হারকে ৩৬%-তে নেওয়া যায় না সেটা বলছি না। পৃথিবীর বহু স্বল্পোন্নত দেশ আছে, যারা বাংলাদেশের মোট রাজস্ব হারের (দেশজ আয়ের শতকরা হিসাবে) অনেক বেশি রাজস্ব আদায় করে থাকে। তবে তা করার জন্য যদি কোনো পদক্ষেপ থেকে কত বাড়তি আয় আসবে বলা হতো (যা বিভিন্ন দেশের বাজেটে বলা হয়ে থাকে) তবে আশ্বস্ত হওয়া যেত। সেটা জানলে আরও বোঝা যেত আগামী বছর দেশের কোন শ্রেণি বা গোষ্ঠী বর্ধিত রাজস্বের কত ভাগ ভার বহন করবে। বর্ধিত করের উৎস আলোচনা থেকে এটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয় না।
মোট ব্যয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। এবার (২০১৫-১৬) মোট সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ২৩%-এর মতো। অথচ অর্থবছরের প্রকৃত ব্যয় (সংশোধিত বাজেট নয়) ধরলে এই বৃদ্ধির হার হবে ৪২%-এর ওপরে। লক্ষণীয়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ১০%-এর মতো। তাই বাজেটে ঘোষিত ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রাগুলো নিতান্তই স্ফীত করে দেখানো আছে, যা প্রকৃত আয়ের নিরিখে নিঃসন্দেহে সংকুচিত হয়ে যাবে ২০১৫-১৬-এর শেষে।
এর অর্থ কি এই যে বাংলাদেশের কোনো ‘উচ্চাভিলাষী’ বাজেট প্রস্তুত করা উচিত নয়? অবশ্যই করা উচিত। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যয় মোট দেশজ আয়ের মাত্র ১৬-১৭%-এর মতো। অনেক তুলনীয় স্বল্পোন্নত দেশে এই হার ২০-২২%। আমাদের মতো স্বল্প আয়ের দেশের উন্নয়ন চাহিদা মেটানোর জন্য নিঃসন্দেহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ইত্যাদি খাতে গুণমানসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় ব্যয় অবশ্যই বাড়াতে হবে। তবে সে জন্য উচ্চ লক্ষ্যমাত্রাই নির্ধারণের সঙ্গে সঙ্গে একটি নীতি ও প্রতিষ্ঠান সংস্কার ও সংহতকরণের একটি পরিকল্পনা লাগে। সেটা তো খুঁজে পাচ্ছি না।
ব্যয়ের ক্ষেত্রে অবশ্য বড় বিষয় হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার। আসলে যত না এডিপির আদায় নিয়ে কথা, তার চেয়ে বেশি চিন্তা তার প্রকার নিয়ে। আমরা জানি এডিপিতে একধরনের প্রকল্প নৈরাজ্য। যেমন, অনুমোদিত প্রকল্প সংখ্যা বৃদ্ধির বিপরীতে যেসব প্রকল্প ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা, তাতে কী দেওয়া হয়েছে? গত বছর তো তা পায়নি। এমনকি দ্রুতায়িত (ফাস্ট ট্র্যাক) আট-নয়টি প্রকল্প কি সেটা পেল?
বর্তমান সরকারের দুই দফায় ছয়টি বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকার রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির হারকে বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ব্যক্তি বিনিয়োগে মন্দা অবস্থার কারণে বর্ধিত রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তথা মোট রাষ্ট্রীয় ব্যয় আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তিন-চার বছর ধরে।
কিন্তু বর্ধিত ব্যয় মেটানোর প্রথম দিকে সহজ থাকলেও বিগত তিন বছর রাজস্ব আদায়ে আগের তেজিভাব না থাকায় সরকারকে বেশি করে ঋণ করে ঘাটতি মেটাতে হয়। এ ক্ষেত্রেÿবৈদেশিক অনুদান বা রেয়াতি ঋণ ব্যবহার করতে পারাটাই সর্বোত্তম। কিন্তু সেটাতে ব্যর্থ হলে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে—ব্যাংক বা জনগণের কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়। বিগত বাজেটগুলোতে আমরা তাই লক্ষ করি, দ্বিতীয় সর্বোত্তম পদক্ষেপ হিসেবে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যয়কে এগিয়ে নিতে চেয়েছে। আগামী অর্থবছরে আর্থিক কাঠামো পর্যালোচনা করলে সেই প্রবণতার ধারাবাহিকতাই লক্ষÿকরি। সেহেতু সরকারের মোট ঋণের দায় আপাতত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে (মোট দেশজ আয়ের ৩৫%-এর মতো), তাই হয়তো তাৎক্ষণিক কোনো বড় দুশ্চিন্তা নেই। কিন্তু ঋণ পরিশোধজনিত ব্যয় বৃদ্ধির কারণে লাভের গুড় কিছুটা পিঁপড়ায় খাচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের সম্প্রসারণশীল অর্থনৈতিক ভঙ্গি সঠিক ছিল, যাকে অর্থনীতির ভাষায় বলে চক্র-বিপরীত পদক্ষেপ (কাউন্টার-সাইক্লিক্যাল পলিসি)। কিন্তু এই রূপ অর্থনৈতিক ভঙ্গি দীর্ঘ সময়ের জন্য টেকসইভাবে অব্যাহত রাখা যায় না আর্থিক সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে, যাকে ‘ফিসকাল স্পেস’ না থাকা বলে। তখন প্রয়োজন হয় ব্যাপক নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অর্থনীতির দক্ষতা বাড়ানোর জন্য। সেটা করতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংকোচন অবধারিত হয়ে পড়ে সামষ্টিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে। এটাই বলে বিশ্ব অভিজ্ঞতা।
আগামী বাজেটে বেশ কিছু রাজস্ব প্রস্তাব আছে, যা প্রণিধানযোগ্য। সঠিকভাবে করযোগ্য আয়ের ন্যূনতম পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, নিবন্ধিত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিগুলোর প্রান্তিক কর হার কমানো হয়েছে, পুঁজিবাজারে লব্ধ করযোগ্য মুনাফার ন্যূনতম পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, দেশজ শিল্পকে সুরক্ষা দিতে বা পরিবেশদূষণকে নিয়ন্ত্রণ করতে নেওয়া হচ্ছে বেশ কিছু বিচক্ষণ পদক্ষেপ। তবে প্রশ্ন উঠবে, আগে পৌর এলাকার সঙ্গে জেলা-উপজেলার ন্যূনতম প্রদেয় কর হারের যে পার্থক্য ছিল, তা কেন উঠিয়ে দেওয়া হলো। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরে প্রাপ্য আনুতোষিকের ওপর কেন কর আরোপ করা হবে?
শিশু বাজেট প্রচলনকে অভিনন্দন জানাতে হয়। জেন্ডার বাজেট অব্যাহত আছে। হয়তো কোনো দিন আমরা পৃথকভাবে প্রবীণদের জন্য বাজেট প্রণয়ন করব। তবে ধাক্কা খেতে হয় জেলা বাজেটের অন্তর্ধানে। অর্থমন্ত্রী বক্তৃতায় স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা নিয়ে যা বলেছেন, সেটা একটি স্থানীয় সরকার অর্থায়ন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে বড় যুক্তি।
মোটা দাগে, অন্য যেকোনো বছরের মতোই এবারের বাজেট এল। অর্থনীতিতে বিরাজমান স্বস্তিকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়কাঠামো এবং বিনিয়োগ পরিবেশের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থবহ মৌল সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণই থেকে গেল।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বিশেষ ফেলো, সিপিডি