Originally posted in যুগান্তর on 4 June 2021
মনে হচ্ছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে এই বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে। ফলে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার তাৎপর্য, অভিঘাত ও পরিণতি সম্পর্কে কোনো সংবেদনশীল তথ্য এই বাজেটে খুঁজে পাইনি।
করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে সমন্বিত কোনো পরিকল্পনাও নেই। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, টিকা সংক্রান্ত ব্যয় এবং বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা দেখছি না।
দ্বিতীয়ত, করোনার কারণে দেশে দরিদ্র বেড়েছে। কর্মসংস্থান এবং মানুষের আয় কমেছে। বেড়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। বাজেটে তার কোনো প্রতিফলন নেই।
উপরন্তু দারিদ্র্য বিমোচনসহ এমন সব কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে, যা অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার চেয়েও উচ্চাবিলাসী। সাম্প্রতিক হিসাবের কোনো কিছুই সেখানে নেই।
তৃতীয়ত, বিভিন্ন খাতে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এটি খুব ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু যেসব খাতে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, তার বেশির ভাগ সুবিধা পাবে সংগঠিত ও বৃহৎ শিল্প। কিন্তু মাঝারি বা ছোট শিল্পের জন্য সুনির্দিষ্ট খুব বেশি সুবিধা নেই।
বিশেষ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের জন্য তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। যদিও কর ছাড়ের মাধ্যমে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ কিছু বাড়ানো হয়েছে।
চতুর্থত, সরকারি ব্যয় বাড়লে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা খুব বেশি উপকৃত হয়। কিন্তু এই ব্যয়ের গুণগতমান বাড়ানোর ব্যাপারে বাজেটে কোনো বক্তব্য নেই। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য সুদ মওকুফ এবং অর্থ সহায়তাসহ কোনো প্রস্তাব নেই।
সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নতুন ১৪ লাখ মানুষ নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়েনি। সামগ্রিকভাবে মহামারি-উত্তর মন্দা পরিস্থিতিকে কাটানোর জন্য বৃহৎ শিল্পকে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত সে ধরনের সুবিধা পায়নি।
সামাজিক খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেটিও একেবারে কম। ব্যয়ের ক্ষেত্রে গত বছরের বাজেটে অব্যবহৃত টাকা রয়েছে, এবারো যে সেটি থাকবে না, তার ফলাফলভিত্তিক মূল্যায়ন আশা করছিলাম। কিন্তু নতুন বাজেটে সে ধরনের পদক্ষেপ নেই।
আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো বর্তমানে প্রতিকূল এবং অনিশ্চিত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। বাংলাদেশের ওপরও তার নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিদেশের সঙ্গে আমাদের চারটি খাতে সম্পর্ক রয়েছে।
এটি চার খাতেরই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন। যেমন বর্তমানে আমাদের প্রবাসী আয় (রেমিটেন্স) ভালো অবস্থায়। কিন্তু এটি যে অব্যাহত থাকবে, তা নিশ্চিত নয়। প্রচুর মানুষ ফিরে আসছে।
নতুন কর্মসংস্থানও কম হচ্ছে। রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে গার্মেন্টস খাত কিছু পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। কিন্তু অব্যাহত থাকবে, তা বলা যাচ্ছে না।
আগামী দিনে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া কষ্টকর হবে। এ ক্ষেত্রে অনুদান কিংবা রেয়াদি সুদে ঋণ পাওয়া কঠিন। কারণ ইতোমধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। বড় আশার জায়গা ছিল প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ।
কিন্তু সেটিও একেবারে সামান্য আসছে। করোনার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এটি আরও কমেছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে দেশীয় শিল্প গড়ে তুলতে হবে।
এ ছাড়াও এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা) উত্তরণের পর আমরা বৈদেশিক বাজার সুবিধা হারাব। সে রেত্রে নিজের দেশের বাজারের জন্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
এ ক্ষেত্রে কৃষি, ছোট ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিককে নিয়মের ভেতরে এনে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা উচিত। এ ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো দূর করতে হবে।
এখনো আমরা রফতানি নিয়ে যতটা চিন্তিত, দেশীয় চাহিদা বিবেচনা করে অভ্যন্তরীণ শিল্পকে শক্তিশালী করাকে তত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি না। এ কারণেই দেশীয় অর্থনীতিতে জোর দেওয়ার কথা বলছি।
পাশাপাশি দেশীয় প্রতিষ্ঠান ব্যাংক, পুঁজিবাজার এবং পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে হবে।
লেখক : সম্মাননীয় ফেলো, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।