Originally posted in দেশ রূপান্তর on 29 May 2025
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি আর্থ-উন্নয়ন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো হিসেবে কর্মরত। বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন বিষয়ে বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এ ছাড়াও তিনি জেনেভায় জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছেন। ২০২৪ সালে দেশের বিদ্যমান সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। দেশের অর্থনৈতিক সংস্কার, বাজেট, শ্বেতপত্রের সুপারিশ বাস্তবায়ন ইত্যাদি বিষয়ে সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- বিজনেস এডিটর মো. মাসুম বিল্লাহ
দেশ রূপান্তর: আপনি তো শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ছিলেন। শ্বেতপত্র প্রণয়নের প্রেক্ষাপট কী ছিল?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনীতির পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সূচনা বিন্দু হচ্ছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যে অর্থনীতিকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেল, সেটির মূল চরিত্র কী ছিল, অর্থনীতিকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে বেগবান করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো কী সেগুলো চিহ্নিত করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে লক্ষ্যেই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়নে শ্বেতপত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কোন ভিত্তিভূমির ওপর দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতিকে আরেকটু সুষ্ঠু এবং সচল করতে পারে, সেটার পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবনের চেষ্টা হচ্ছে শ্বেতপত্র। সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে আমরা ১২ জন মিলে যথাসময়ে এবং যথাসম্ভব সুষ্ঠুভাবে এটির কাজ সম্পন্ন করেছি। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে এটি একটি অনন্য ঘটনা। সম্পূর্ণভাবে স্বপ্রণোদিত হয়ে ও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এবং জাতীয় দেশজ বিদ্যা ও মেধার ভিত্তিতে আমরা এই কাজটা সম্পন্ন করেছি। আগের টাস্কফোর্সগুলোর সঙ্গে এটির ভিন্নতা এই যে, এটি একটি চলমান সরকারের অভিপ্রায়ে তার মেয়াদকালে সম্পন্ন হয়েছে। এটা এমন না যে, এক সরকারের আমলে লিখিত হয়ে প্রণীত হয়েছে এবং আরেক সরকার এসে তা বাস্তবায়ন করবে। সেই পার্থক্যটা এখানে ছিল না।
দেশ রূপান্তর: শ্বেতপত্র প্রতিবেদন কি সরকার যথাযথভাবে ধারণ করেছে?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এ সরকারের আমলে যতগুলো কমিটি বা টাস্কফোর্স বা কমিশন হয়েছে, সবই হয়েছে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থার অধীনে। শ্বেতপত্র ছিল একমাত্র সরকারি উদ্যোগ, যা প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের অধীনে হয়েছে। আমার বিভিন্ন লেখা দেখে প্রধান উপদেষ্টা মনে করেছেন যে, একটি শ্বেতপত্র হওয়া উচিত। সেই অভিপ্রায় থেকে তিনি এটি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শ্বেতপত্র প্রণয়নে কোনো কমিশন ছিল না, একটি কমিটি ছিল। আর এ কমিটি অনেক স্বাধীন এবং পেশাগতভাবে অনেক বেশি ব্যুৎপত্তিগত অবস্থানে ছিল। কমিটিতে যারা সদস্য ছিলেন, তাদের যোগ্যতা নিয়েও কোনো প্রশ্ন ছিল না। এটি যেহেতু প্রধান উপদেষ্টার অভিপ্রায় ছিল, তাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টা এটিকে কীভাবে গ্রহণ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা এটিকে খুবই আন্তরিকভাবে এবং সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। আমরা ৩০ নভেম্বর প্রতিবেদনটি জমা দেই। আর ১৬ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিন মিনিট তিনি শুধু শ্বেতপত্রের ওপর বক্তব্য রেখেছেন। এতেই বোঝা যায়, তিনি এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। তা ছাড়া আমার জন্য বিশেষ সম্মানের যে, তিনি শ্বেতপত্রের ওপর বক্তব্য দেওয়ার সময় আমার নাম উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি তিনি শ্বেতপত্রের বিভিন্ন অনুমিতি ও মূল্যায়ন সেখানে তুলে ধরেছেন এবং এটিকে জাতির জন্য একটি বড় অবদান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ফলে স্বীকৃতির দিক থেকে কোনো ঘাটতি আছে বলে মনে করি না। কারণ যিনি আমাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তিনি এটিকে বেশ সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন।
দেশ রূপান্তর: সরকারের অন্যান্য দপ্তর কি শ্বেতপত্রের যথাযথ মূল্যায়ন করেছে?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এই মুহূর্তে অর্থনীতির বিভিন্ন অঙ্গন নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তত ৫ জন ব্যক্তি যুক্ত আছেন। অর্থসংক্রান্ত প্রধান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আছেন আরও দুজন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট আরও ৪-৫টি মন্ত্রণালয় আছে, যেগুলোর বিষয়ে শ্বেতপত্রে উল্লেখ আছে। আরও প্রায় ৮-১০টি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন খাতভিত্তিক বিষয় শ্বেতপত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব মুখ্য অর্থনৈতিক মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো (অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংক খাত, বাণিজ্য খাত, শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ইত্যাদি) তাদের চলমান কার্যক্রমের সঙ্গে শ্বেতপত্রকে প্রাসঙ্গিক মনে করেছেন কি না, এটিকে তারা অধ্যয়ন করেছেন কি না, শ্বেতপত্রের প্রধান প্রধান উপলব্ধিগুলো তারা তাদের চলমান কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছেন কি না, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এটিকে বিবেচনা করেছেন কি না এ ধরনের কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। একজন উপদেষ্টাও আমাদের ডেকে জিজ্ঞেস করেননি যে, তাদের চলমান কার্যক্রমের সঙ্গে শ্বেতপত্রের প্রাসঙ্গিকতা কী? ফলে এটি একটি স্বাধীন মূল্যায়ন হিসেবেই রয়ে গেছে। সরকারি কার্যক্রমের আনুতোষিক বা একটি কার্যকর উপাদান হিসেবে প্রচলিত হয়েছে বলে মনে হয় না। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ না করলেও বিদেশিরা এবং বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এটিকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছে। বিদেশিরা আমাদের কাছে এটির বিভিন্ন বিষয় বুঝতে চেয়েছেন এবং তাদের দেশের উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে এটির প্রাসঙ্গিকতা কতখানি, তা তারা বুঝতে চেয়েছেন। শ্বেতপত্রের আলোকে চলমান প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটির বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটি একটি বড় বিষয় শ্বেতপত্রকে কেন্দ্র করে হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাত এটির বিষয়ে বেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। বেসরকারি খাতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় আমাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। শিল্প, বাণিজ্য ও পুঁজিবাজারের পাশাপাশি বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য পরিস্থিতি, মিয়ানমার ও ভুটানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্লেষণের প্রাসঙ্গিকতা তারা বুঝতে চেয়েছেন। বিবর্তনশীল বৈশ্বিক, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে এগুলোকে কীভাবে আমাদের বুঝতে হবে এবং এসব বিষয়ের তাৎপর্য কি সেটি তারা বিশ্লেষণ করেছেন। এর বাইরে সরকারের নানা সংস্থা যেমন প্রশাসনবিষয়ক প্রশিক্ষণ একাডেমি, সেনাবাহিনীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (এনডিসি, স্টার্ফ কলেজ ইত্যাদি) এটি বোঝার জন্য পড়তে চেয়েছে। আর বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাও (এনজিও) এর বিষয়বস্তু বুঝতে চেয়েছে। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি যাদের আত্মস্থ করার দরকার ছিল, তারা এটিকে ব্যবহার করেননি। তবে সমাজের একটি বৃহৎ অংশ যারা সমাজের নানা ধরনের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা এটিকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছেন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কেন এত গুরুত্ব দিল না? সে ক্ষেত্রে একটা সাধারণ উত্তর হতে পারে, উনারা হয়তো সবই জানেন। তাই এ বিষয়ে তাদের হয়তো অধিকতর জানার দরকার নেই।
দেশ রূপান্তর: এই সরকারের শুরু থেকেই নানা ধরনের সংস্কারের বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছিল, সে মোতাবেক কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেই উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সরকার প্রথম সংস্কারটাই করেনি। তা হচ্ছে, এই সরকার আগের সরকারের প্রস্তুত করা বাজেট নিয়ে দিনযাপন করছে। সরকার যদি আগের সেই কাঠামোর মধ্যেই অবস্থান করে, তাহলে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় তারা কী সংস্কার করবেন? দ্বিতীয়ত, সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা স্থগিত করেছে। কিন্তু এর পরিবর্তে কোনো মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা দেয়নি। যেহেতু তারা কোনো মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা দেয়নি, তাই এই সংস্কারের আকাক্সক্ষা কীভাবে মধ্যমেয়াদি নীতি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে বা উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে সেটিও তারা বলেননি। সংস্কারকে বুঝতে হলে, একটি নীতি কাঠামোর ভেতরে সময় নির্দিষ্টভাবে কিছু লক্ষ্য অর্জনের জন্য সেটির উদ্যোগ নিতে হবে। সংস্কার নির্ভর করে অর্থনৈতিক ও বাস্তবিক ফলাফলের ওপরে। সরকার কি ফলাফল অর্জন করতে চাচ্ছে, সেটি আমরা বুঝতে পারলাম না। ফলে সংস্কারকে মূল্যায়ন করার সুযোগও হলো না। কি সংস্কার করতে হবে জানলাম, কিন্তু করতে চাচ্ছি কি না, কীভাবে করছি, কতখানি করছি সেটা তো জানা হলো না। বর্তমান সরকারের এটি একটি কাঠামোগত দুর্বলতা। এর ফলে সরকারের স্বচ্ছতার অভাব স্পষ্ট হয়েছে। সংস্কারের উদ্যোগগুলো কারা, কীভাবে, কতখানি বাস্তবায়ন করছে, সেটি সরকারের কোনো সংস্থার কাছে স্পষ্টভাবে বিধৃত নয়। সরকারের কোনো উপদেষ্টাকে দেখলাম না, যিনি এই পুরো বিষয়টি সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে অবহিত এবং তিনি এটির বিষয়ে দায়িত্ব নিয়ে মানুষকে অবহিত করতে পারেন। সমসাময়িক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কী হচ্ছে, জ্বালানি খাতে কী হচ্ছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিস্থিতি কী সব বিষয়কে আত্মস্থ করে বর্তমান সরকারের সংস্কারের পথরেখাকে ব্যাখ্যা করার মতো কোনো স্পোকসপার্সন নেই।
দেশ রূপান্তর: এখন তো সংসদ নেই। তাহলে সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে কীভাবে?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনার বিষয়ে দেশে যে আইন আছে, সেখানে লেখা আছে যে, তিন মাস পর পর বাজেট ও আর্থিক পরিস্থিতির ওপর সংসদে প্রতিবেদন পেশ করতে হবে। বর্তমানে সংসদ নেই, তাই বলে কি এই সরকারের কোনো স্বচ্ছতা বা দায়বদ্ধতা থাকবে না? সরকার তো একটা সংবাদ সম্মেলন করে বাজেট ও আর্থিক পরিস্থিতির প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করতে পারে। সরকারের ৯ মাস হয়ে গেছে। এ সময়ে তিনটি বিবৃতি হওয়ার কথা। কিন্তু একটিও দেওয়া হয়নি। ভাগ্যিস প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মাঝে একবার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেছিলেন। সে কারণে আমরা কিছুটা জানতে পেরেছি। অর্থ উপদেষ্টা বা পরিকল্পনা উপদেষ্টার তরফ থেকে আমরা জানতে পারিনি। আমাদের এখন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের কাছ থেকে জানতে হয় যে, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কী।
দ্বিতীয়ত, সরকারের স্বচ্ছতার অভাব দেখা দিয়েছে। স্বচ্ছতার অভাব দেখা দিলে যা ঘটে তা হচ্ছে, আপনি যদি কোনো ভালো কাজ করে থাকেন, সেটি জানা যায় না। আবার যদি কোনো বিষয়ে সংশোধনের দরকার হয়, সে ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সমালোচনাও সরকারের কাছে পৌঁছাতে পারে না। এর বড় কারণ হলো, উপদেষ্টাদের নিজেদের কাজের মধ্যে সমন্বয় নেই। অর্থনৈতিক বিষয়ে একজন উপদেষ্টা অন্যজনের সঙ্গে একটি সামগ্রিক টিম হিসেবে কাজ করেন বলে মনে হয় না। ফলে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এই সমন্বয়ের অভাবের কারণে সরকারের পক্ষ থেকে কেউ বলতে পারবে না যে, কোন ক্ষেত্রে কতটুকু সংস্কার হয়েছে। ফলে সরকার ভালো-মন্দের কোনো ক্রেডিট নিতে পারছে না। এখন যদি কোনো উপদেষ্টার কাছে জিজ্ঞেস করা হয়, এডিপি বাস্তবায়নের পরিস্থিতি কেমন বা মেগা প্রকল্পগুলোর পরিস্থিতি কী অথবা এবার কোন নীতির ভিত্তিতে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে তাহলে এ বিষয়ে তিনি সঠিকভাবে বলতে পারবেন বলে মনে হয় না। উপদেষ্টাদের মধ্যে কেউ একজন আরেকজনের কাজের বিষয়ে কোনো জ্ঞান রাখেন বলে মনে হয়নি। উপদেষ্টাদের মধ্যে সহযোগিতার অভাব, সমন্বয়ের অভাব এবং স্বচ্ছতার অভাব দেখা যাচ্ছে। সহযোগিতা নিজেদের মধ্যেও নেই, বাইরের জগতের সঙ্গেও নেই।
দেশ রূপান্তর: কিছু দিনের মধ্যে সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছে। এবার যে প্রক্রিয়ায় বাজেট প্রণীত হচ্ছে, সে বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছে। গত তিন দশক ধরে আমি বাজেট প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। ব্যক্তি খাতের সঙ্গে বাজেট নিয়ে এত কম আলোচনা আগে কখনো দেখা যায়নি। আগের সরকারের আমলে লোক দেখানো হলেও ব্যক্তি খাতের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করা হতো। লোক দেখানোর জন্য হলেও ঢাকার বাইরে বাজেট নিয়ে দুটো আলোচনা হতো। পেশাজীবীদের সঙ্গে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হতো। এখন তো সংসদ নেই। রাজনীতিবিদরা যমুনাতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এতবার আলোচনায় বসলেন, তারা একবারও কি বাজেট নিয়ে কোনো আলোচনা করেছেন? তাহলে স্বচ্ছতা বা দায়বদ্ধতা থাকে কোথায়? সবচেয়ে দায়বদ্ধহীনভাবে ও অস্বচ্ছভাবে একটি বাজেট প্রণীত হতে চলেছে। আর বাজেটটি হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে আমলানির্ভর। সেই আমলারা এ কাজ করছেন, যারা গত সরকারের আমলে জিডিপির পরিমিতিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছেন। বিগত সরকারের কোনো পরিসংখ্যান সংস্কার হয়নি। নতুন করে কোনো পরিমিতি করা হয়নি।
দেশ রূপান্তর: বিগত সরকারের পরিসংখ্যান নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। বর্তমান সরকার কি পরিসংখ্যানের সঠিকতা নিশ্চিতে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: প্রধান উপদেষ্টা যখন তার বক্তৃতায় বলেন, আমাদের জিডিপির পরিসংখ্যান স্ফীত এবং এটা ঠিক না তখন সেটা আমাদের শে^তপত্রের পর্যালোচনাকে সমর্থন করে। উনার উপদেষ্টারা বা আমলারা কেউ এ বিষয়ে কোনো কাজ করল না। প্রধান উপদেষ্টা ভবিষ্যতে হয়তো ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ হবেন এ কারণে যে, উনি শ্বেতপত্রের ওপর ভিত্তি করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিকে উনার আমলারা আক্ষরিক অর্থে প্রমাণ করতে দেননি। আগের সরকারের ত্রুটিপূর্ণ পরিসংখ্যান নিয়েই তো উনি বাজেট দিতে যাচ্ছেন। এর ফলে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কারণ সরকার যে বাজেট দেওয়া হবে, সেটিতে তো বিগত সরকারের জিডিপির ধারাবাহিকতার ভিত্তিতেই বিভিন্ন প্রাক্কলন করা হবে। আর ওই জিডিপির ভেতরে তো অতিরঞ্জন আছে। এখন সরকার বাজেট দেবে সেই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে। ফলে এখানে তো আলোচনার সুযোগই থাকে না। এটা বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্ম দেবে।
দেশ রূপান্তর: সংস্কারের অংশ হিসেবে এনবিআর ভাগ করা নিয়ে যে জটিলতা দেখা দিল, সে বিষয়ে আপনার মতামত কী?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সহযোগিতা, স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের অভাবের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুই ভাগ করা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা। এনবিআরের নীতি ও বাস্তবায়ন পৃথক করার বিষয়ে আমরা সুপারিশ করেছিলাম। এটি পৃথক করার প্রয়োজন ছিল। উনারা করেছিলেনও। কিন্তু ভালো কাজ যদি বেঠিকভাবে করা হয়, তাহলে যে ব্যাকফায়ার করে, এটিই তার উদাহরণ। উনারা আলোচনা ও সমন্বয় ব্যতিরেকে, এমনকি স্বচ্ছতা ও সত্যতাকে পাশ কাটিয়ে এটি করেছেন। যেভাবে ভাগ করার সুপারিশ করা হয়েছিল, সেভাবে করা হয়নি। কাজ সঠিকভাবে না করলে যে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা এখান থেকে বোঝা গেল।
দেশ রূপান্তর: সরকার যে বাজেট দিতে যাচ্ছে, তারা কি সেটি বাস্তবায়ন করতে পারবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এই সরকারের তো বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করার সুযোগ নেই। সরকার আগের সরকারের বাজেট ঘাড়ে বহন করেছে কোনো ধরনের স্বচ্ছ পরিমার্জন না করেই। আগের সরকারের নীতিগুলো পরিমার্জন করার বিষয়ে আমরা সুপারিশ করেছিলাম। এমনকি একটি দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের কথা বলেছিলাম। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিদেশি অর্থায়নকারী সংস্থা, বিদেশি বিনিয়োগকারী ও যারা রেমিট্যান্স পাঠায় তাদের নিয়ে একটি উন্নয়ন ফোরাম আয়োজনের কথা বলেছিলাম। কিন্তু সেগুলো করা হয়নি। ফলে এখন বিদেশিরা এসে অর্থলগ্নি করার সঠিক জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। তারা বলছেন যে, অর্থ দিতে চান। কিন্তু কোথায় কীভাবে দেবেন, সেটা বুঝতে পারছেন না। একটি বিনিয়োগ সম্মেলন হলো। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের সঠিকভাবে বিনিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হলো না। ফলে তারা কার সঙ্গে যোগাযোগ করে এখানে কাজ করবেন, বুঝতে পারছেন না।
দেশ রূপান্তর: এই মুহূর্তে সরকারের কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে দেখি, সেটি হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা খাত। যোগ্য ব্যক্তিদের উপযুক্ত হারে সহায়তা প্রদান করতে হবে। একই সঙ্গে সহায়তা পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের একটি সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার তৈরি করতে হবে। যাতে যারা এই সুবিধার বাইরে আছে, তাদের সুবিধাভোগীদের তালিকার মধ্যে আনা এবং মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়ানো যায়। এ কাজগুলো করা বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে এ কারণে যে, এখন স্থানীয় সরকার নেই। আর অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের পেনশন তহবিলকে সামাজিক সুরক্ষার বাইরে রাখতে হবে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের নিজস্ব স্বাস্থ্য ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার) অনেক বেশি। এটি কমানোর বিষয়ে কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেটি দেখলাম না। সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো ভালো নয়। কিছু ক্ষুদ্র সংখ্যার মানুষ সংঘবদ্ধভাবে মানুষের অধিকার হরণ করছে, জীবননাশের হুমকি দিচ্ছে, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যকে হুমকিতে ফেলছে। এটি চলতে পারে না। যে অর্থনীতিতে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই, যেখানে কোনো সামাজিক চুক্তি কাজ করে না। যেখানে সহনশীলতা নেই, সেখানে তো অন্য সবকিছু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করতে চাই। ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে দেশে সরকার পরিবর্তন হলো। কিন্তু ছাত্রদের কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য কোনো পরিকল্পনা করা হলো না। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি বা শিক্ষার গুণমান বাড়ানোর বিষয়ে কোনো উদ্যোগ দেখলাম না। এত এত সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু মূল যে বিষয় নিয়ে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, সেই কর্মসংস্থান নিয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। কারিগরি শিক্ষার শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা সমস্যা রয়েছে। কিন্তু সে খাতে সংস্কারের কোনো আলোচনা হলো না। সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টারা এসব বিষয়ে কার্যকর কোনো সংস্থারের কথা বলছেনও না।
দেশ রূপান্তর: সম্প্রতি একটি গুজব শোনা গেল যে, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন। সার্বিকভাবে এক ধরনের অস্থির পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অর্থনীতিতে এতে কোনো ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: যেকোনো ধরনের অনিশ্চয়তা অর্থনীতির জন্য খারাপ। এমনিতেই আমরা একটা অন্তর্বর্তী সময়ে আছি। অর্থাৎ একবিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে পৌঁছাতে চাচ্ছি। এর মাঝে যদি আবার দুই-তিন রকমের পথরেখা বের হয়, তাহলে তো নতুন চিন্তার উদ্ভব হবে। এমন পরিস্থিতি মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করবে, বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে, কর্মসংস্থানে অসুবিধা সৃষ্টি করবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও দুর্বল হয়ে যাবে এবং কিছু সংখ্যক মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে পরিস্থিতির সুযোগ নেবে। কাজেই এটি কোনো ভালো বিষয় নয়। অনিশ্চয়তা অর্থনীতির জন্য কখনোই ভালো কোনো বিষয় নয়।
দেশ রূপান্তর: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, সময় দেওয়ার জন্য।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: দেশ রূপান্তরের জন্য শুভকামনা থাকল।