বাজেট বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে প্রবৃদ্ধি হবে কি না – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in বাংলা নিউজ ২৪ on 30 June 2024

নতুন বাজেটের কিছু বিষয়ে সাধারণ জনগণের সমালোচনা থাকলেও সেগুলোর প্রতি স্পর্শকাতরতা দেখানো হয়নি বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তার অভিমত, সরকারের যেসব কর্মসূচি রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে প্রবৃদ্ধি হবে কি না এবং মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে কি না।

এছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাও কতটুকু ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। সুতরাং বাজেট বাস্তবায়নের ওপরই সবকিছু নির্ভর করবে।

রোববার (৩০ জুন) জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট পাসের পর বাংলানিউজকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় মোস্তাফিজুর রহমান এসব কথা বলেন।

এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এবারের বাজেটে যেমন বিভিন্ন ইতিবাচক দিক ছিল, ঠিক তেমনি সামালোচনাও হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ইতিবাচকের মধ্যে একটা ছিল সর্বোচ্চ করের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ করা। কারণ আমরা মনে করি আমাদের আয়ের বৈষম্য বাড়ছে। এজন্য করের হার কোভিডের আগের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কথা আমরা বলেছিলাম। কিন্তু সেটা আমরা দেখলাম ২৫ শতাংশই রেখেছে। এটা ৩০ শতাংশ করলে ভালো হতো।

তিনি বলেন, সংসদ সদস্যদের জন্য ৪০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে গাড়ি আনার যে আহ্বান জানানো হয়েছিল সেটা কোনো কাজে লাগেনি। এটা শুল্কমুক্ত রেখেছে সরকার। অথচ আমাদের প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষ, নিম্ন আয়ের মানুষ তারা একটা ক্রয়ক্ষমতার অবনমনের দিকে যাচ্ছে। সেরকম একটি অবস্থায় তাদের এ অনুরোধ করা হয়েছিল, কিন্ত তারা সেটা রাখেননি। কিন্তু তারা এখনো করতে পারতেন যে একটা সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেওয়া যেতো। যেমন শুল্কমুক্ত গাড়ি আনলে ৫০ লাখ টাকার কম হতে হবে। সেরকম কিছু আমরা দেখলাম না। এটা দুঃখজনক বলে আমার মনে হয়েছে।

কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে তিনি বলেন, এর বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীরাও সমালোচনা করেছেন। বিভিন্ন গবেষকরা বলেছেন, অর্থনৈতিকভাবে এটা দেশের জন্য ইতিবাচক নয়। এটা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য না এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেখানে তারা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, দুর্নীতির মাধ্যমে যারা সম্পদ আহরণ করবে তাদের বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ দেখাবে। আর জমির মৌজা মূল্যের সঙ্গে প্রকৃত মূল্যের পার্থক্য হয়েই থাকে, তাহলে এটা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া যেতো। কিন্তু সেখানে ঢালাওভাবে দেওয়া, যেকোনো আইন থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া, এটা কোনো বিচারেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর সৎ করদাতাদের জন্য এটা একটা রং সিগন্যাল দেবে।

তিনি বলেন, বাজেট যেহেতু পাস হয়েছে এখন সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করবে। যেমন বেসরকারি বিনিয়োগ আছে, যেটার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তারপর সরকারের যে উন্নয়ন কর্মসূচি রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের উৎকর্ষতার ওপর নির্ভর করবে প্রবৃদ্ধি হবে কি না এবং মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে কি না। একই সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাও কতটুকু ফিরয়ে আনা সম্ভব হবে।

অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের ওপরই সবকিছু নির্ভর করবে। সেদিকে সবার নজর দেওয়া উচিত। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা, অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যাতে আমরা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারি সেদিকে জোর দেওয়ার সময় আসছে।

রোববার সংসদের অধিবেশনে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পাস হয়। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে এবারের বাজেটের আকার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। এ বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। বাকি দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে। দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এরই মধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

নতুন অর্থবছরে কালোটাকার মালিকরা আয়ের উৎস সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়েই তাদের অঘোষিত সম্পদকে বৈধ করার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক, কোনো করদাতা ফ্ল্যাট, জমির পাশাপাশি নগদ অর্থসহ স্থাবর সম্পত্তির জন্য ১৫ শতাংশ কর দিলে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না। সংসদের ভেতরে-বাইরে কঠোর সমালোচনা সত্ত্বেও প্রস্তাবটি বহাল রাখা হয়েছে।

নতুন অর্থবছরে সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা বহাল থাকছে। প্রস্তাবিত বাজেটে সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা কাটছাঁট করে ২৫ শতাংশ শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু তাদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি বাতিল করতে হলে ১৯৭৩ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার সংশোধন করতে হবে। এরপরই এ ধরনের গাড়ি আমদানিতে কর আরোপ করা যাবে। কিন্তু এখনো সংসদে এ ধরনের কোনো বিল উত্থাপন হয়নি। ফলে এমপিদের গাড়ি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা বহালই থাকছে। তবে আগামীতে এ সংক্রান্ত বিল পাসের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে।

নতুন অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এক লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। নতুন বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের। ব্যাংকিং খাত ছাড়াও নন-ব্যাংকিং খাত থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া হবে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

আর করমুক্ত আয়কর সীমা বিদ্যমান সাড়ে তিন লাখ টাকাই বহাল থাকবে। বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। আর মূল্যস্ফীতি আটকে রাখার লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নিত্যপণ্যের ওপর উৎসে কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এজন্য চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, ভুট্টা, ভোজ্যতেল, লবণ ও চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের সরবরাহকারীর ঋণপত্রের ওপর কর হার এক শতাংশ করা হয়েছে।

পাস হওয়া এ বাজেট আগামীকাল ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।