বাড়তি শুল্ক ভিয়েতনামের সমপর্যায়ে নামাতেই হবে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in সমকাল on 9 July 2025

আমরা কেন ভিয়েতনামের মতো সমঝোতা করতে পারলাম না? এর উত্তর সরকারের কাছেই আছে

অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণার পর আলোচনার জন্য সময় চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে চিঠি দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রও স্বীকার করেছিল, যেসব দেশ দ্রুতই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। এর পর তিন মাস ধরে আলোচনা চলেছে। কিন্তু ফল হতাশাজনক। প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক মাত্র ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। ফলে বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে আরও ৩৫ শতাংশ যোগ হয়ে ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের পণ্যে মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত ব্যাপক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইতোমধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছে, যার আওতায় তাদের পণ্যে মাত্র ২০ শতাংশ শুল্ক বসবে। অর্থাৎ আমাদের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ শুল্ক থাকছে, যা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন করে তুলবে। যদি প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য কোনো দেশ এমন সুবিধা বাগিয়ে নেয়, তা আরও বড় সমস্যা তৈরি করবে।

নতুন শুল্কহার কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্র্যান্ডগুলোর যারা বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি করে, তারা হয়তো প্রাথমিকভাবে অতিরিক্ত শুল্কের একটা ছোট অংশ নিজেরা বহন করবে এবং বাকিটা চাপিয়ে দেবে রপ্তানিকারকের ওপর। ফলে রপ্তানিকারকরা পণ্যের দাম কমাতে বাধ্য হবেন। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এ ব্যবস্থা টিকবে না। শেষ পর্যন্ত ব্র্যান্ডগুলো ভিয়েতনাম বা এমন দেশেই চলে যাবে, যেখানে কম খরচে পণ্য পাবে।

এখন প্রশ্ন ওঠে– আমরা কেন ভিয়েতনামের মতো সমঝোতা করতে পারলাম না? এর সুনির্দিষ্ট উত্তর সরকারের কাছেই আছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত সমঝোতার খসড়া গোপন রাখার শর্ত ছিল। তবে চাইলে সরকার একটি ‘সমঝোতা দল’ গঠন করে বিষয়টি নিয়ে পেশাদার ও অংশগ্রহণমূলক আলোচনা করতে পারত।

আমরা জানি না, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কছাড় ছাড়াও কোনো অশুল্ক দাবি ছিল কিনা। বাংলাদেশ এর আগে স্ক্র্যাপ লোহা, সয়াবিন, এলএনজি ও তুলার মতো প্রধান আমদানীকৃত মার্কিন পণ্যে শূন্য শুল্ক আরোপ করেছে বা করতে চেয়েছে। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আরও কিছু চেয়েছে; যেমন– তাদের বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে নীতিগত সুবিধা বা সরকারি ক্রয়ে বিশেষ সুযোগ। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা হয়তো তাদের কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। আবার হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে– তাদের পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে শূন্য শুল্কছাড় দেওয়া হোক, যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মের পরিপন্থি। এমন শর্তে সরকার হয়তো রাজি হয়নি; কিন্তু ভিয়েতনাম রাজি হয়েছে।

তবে এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। ১ আগস্ট পর্যন্ত আমাদের হাতে তিন সপ্তাহ সময় আছে। এ সময়ের মধ্যে যদি আলোচনার মাধ্যমে অন্তত ভিয়েতনামের মতো একটি সমঝোতায় পৌঁছানো যায়, তাহলে সেটাই হবে ‘মন্দের ভালো’। প্রয়োজনে কিছু অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অতিরিক্ত কিছু ছাড় আদায়ের চেষ্টা করা যেতে পারে।

যেহেতু সরকার এখনও পরিষ্কার করেনি, যুক্তরাষ্ট্রকে কী কী সুবিধার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, আমরা কেবল অনুমান করতে পারি– মূলত শুল্কছাড় ও নীতিগত সুবিধার কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের হয়তো আরও স্পষ্ট, সময় সীমাবদ্ধ ও বাস্তবায়নযোগ্য প্রতিশ্রুতি চেয়েছে। সরকারি ক্রয়ে হয়তো অগ্রাধিকার চেয়ে থাকতে পারে। সমস্যা হলো, আমাদের আরও কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী দেশকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। তাদের স্বার্থের দিকটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

সব মিলিয়ে সামনের সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে আলোচনার কৌশল, প্রস্তুতি ও নেতৃত্ব– সবকিছুই হতে হবে সুপরিকল্পিত। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্যান্য সম্ভাব্য বাজারের দিকেও আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে কোনো একটি দেশের সিদ্ধান্ত আমাদের রপ্তানি সক্ষমতাকে হুমকির মুখে না ফেলে। বিশেষত আমরা উৎপাদন বাড়াতে পারলে খরচ কমিয়ে অতিরিক্ত শুল্কহারে চাপ কমানোরও চেষ্টা করতে পারি।

লেখক: অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)