উন্নয়নশীল দেশ হলে বিদেশি অনুদান কমে যাবে, সেটার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবেঃ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Published in খোলা কাগজ  on Saturday, 17 March 2018

উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি বাংলাদেশের

বাড়ছে সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

নিজস্ব প্রতিবেদক

অবসান হলো অপেক্ষার। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠতে যে যোগ্যতা প্রয়োজন, তা অর্জন করায় বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিল জাতিসংঘ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এ ঘোষণা সংক্রান্ত চিঠি জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেনের কাছে স্থানীয় সময় গত শুক্রবার হস্তান্তর করেন। বাংলাদেশে তখন ১৭ মার্চ। দিনটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের জন্য মর্যাদার এ সুসংবাদটি এলো বাংলাদেশের স্থপতির জন্মদিনে।

বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে নিম্নআয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। এখন জাতিসংঘের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটল। জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলোকে স্বল্পোন্নত (এলডিসি), উন্নয়নশীল ও উন্নত এ তিন পর্যায়ে বিবেচনা করে।

১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক (ইভিআই) এ তিন শর্তপূরণ করে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার যোগ্যতা দেখাল বাংলাদেশ। ওই তিন সূচকে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার সাপেক্ষে ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে। স্বীকৃতিপত্র দেওয়ার অনুষ্ঠানে সিডিপি এক্সপার্ট গ্রুপের চেয়ার প্রফেসর হোসে অ্যান্তোনিও ওকাম্পো, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফেকিতামইলোয়া কাতোয়া উটইকামানু, জাতিসংঘে বেলজিয়ামের স্থায়ী প্রতিনিধি মার্ক পিস্টিন, তুরস্কের স্থায়ী প্রতিনিধি ফেরিদূন হাদী সিনিরলিওলু, ইউএনডিপির এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক ব্যুরোর পরিচালক ও জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হাওলিয়াং ঝু এবং ইউএনডিপির মানবিক উন্নয়ন রিপোর্ট অফিসের পরিচালক সেলিম জাহান উপস্থিত ছিলেন।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদণ্ড অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, জাতিসংঘের হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১২৭৪ ডলার। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, মাথাপিছু আয় এখন ১৬১০ ডলার। ইকোসকের মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৪ পয়েন্টের প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশের আছে ৭২। অর্থনৈতিক ঝুঁকির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২। এ পয়েন্ট ৩৬-এর বেশি হলে এলডিসিভুক্ত হয়, ৩২-এ আনার পর উন্নয়নশীল দেশে যোগ্যতা অর্জন হয়।

অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে। কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না-এ প্রতিশ্রুতি ধারণ করে আমরা শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের জন্য শুধু একটি স্লোগানই নয়, সারা দেশের মানুষ আজ এর সুবিধা পাচ্ছেন।’ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে উঠতে বাংলাদেশ সচেষ্ট বলে জানান তিনি।

চিঠি হস্তান্তরের পর সিপিডি সেক্রেটারিয়েটের প্রধান রোলান্ড মোলেরাস বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের কাক্সিক্ষত বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ সামাজিক খাতগুলোর ব্যাপক উন্নয়ন এ উত্তরণের ক্ষেত্রে কমিটির সুপারিশ করাকে সহজ করেছে। সিপিডি এক্সপার্ট গ্রুপের চেয়ার হোসে অ্যান্তোনিও ওকাম্পো বাংলাদেশের গতিশীল রপ্তানি খাত, মানবিক সম্পদ এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের ব্যাপক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন। জাতিসংঘের এলডিসি, এলএলডিসি ও সিডস সংক্রান্ত কার্যালয়ের প্রতিনিধি আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল উটইকামানু বলেন, দারিদ্র্য হ্রাস ও উন্নয়নের অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হয়েছে।

উন্নয়নশীল দেশের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে আসায় বিশ্বদরবারে নানা দরকষাকষিতে বাংলাদেশের অবস্থান মজবুত হলেও মোকাবেলা করতে হবে নানা চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে বৈদেশিক সাহায্য ও বাণিজ্যিক নানা সুবিধা হারাতে হবে। সুনির্দিষ্ট ও যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার কার্যকর বাস্তবায়ন হলে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন,  উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ায় বাংলাদেশ নানাভাবে লাভবান হবে। রপ্তানি আয় বাড়বে। বাড়বে দেশের সম্মান। এ সম্মানও এক ধরনের পুঁজি। উন্নয়নশীল দেশের শিরোপা ধরে রাখতে, নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তুত হতে হবে। অন্যথায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সামনে বাংলাদেশের জন্য যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে সেগুলো নিয়েও কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা এখনো সন্তোষজনক নয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরমতসহিষ্ণুতার অভাব প্রকট। যে কারণে প্রায়ই অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ বছরই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিগত জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার যেসব কারণ দেখিয়েছিল তারা, সেসব আমলে নেয়নি সরকার। পারস্পরিক অনৈক্য ও অনাস্থার কারণে নষ্ট হয়েছে দেশের স্থিতিশীলতা।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে রপ্তানি আয়, বৈদেশিক ঋণ ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

রপ্তানি আয়

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে, বিশেষ তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা কমে যাওয়ার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে পোশাকশিল্পের ওপর। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাজার হওয়ায় ওই অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যের শর্তাবলী পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গেলে গার্মেন্টস ছাড়াও আরও অনেক রপ্তানি পণ্য তৈরি করতে হবে।

এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে রপ্তানিতে শুল্ক সংযোজনের পাশাপাশি দেশের শিল্প-কারখানায় শ্রমিক অধিকার ও মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলোতে আরও স্বচ্ছতা দাবি করবে আমাদানিকারকরা। সে ক্ষেত্রে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বৈদেশিক ঋণ

উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে আগের মতো সহজ শর্তে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য পাবে না বলে মনে করছেন অনেকে। তবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে ভাবমূর্তি উন্নয়নের ফলে বৈদেশিক ঋণ পাওয়া সুবিধাজনক হতে পারেও। তবে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ মসৃণ ও টেকসই করতে দেশের অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও স্থিতিশীলতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ

উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও উৎসাহী হবেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ হিসাবে তারা মনে করছেন, যেসব দেশ এখন পর্যন্ত স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই প্রবৃদ্ধির হার, বৈদেশিক সাহায্য ও বৈদেশিক আয় কমেছে। তবে প্রায় প্রত্যেক দেশের ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বেড়েছে।

সাধারণত প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়। তবে অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় সঞ্চয়ের চেয়ে বৈদেশিক বিনিয়োগ আয় বেড়ে যাওয়ায় চলতি হিসেবে ঘাটতি সৃষ্টি হয়। যার ফলে বৈদেশিক আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য নেতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বাড়ছে সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে : ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। এটা বাংলাদেশের জন্য বড় স্বীকৃতি। কারণ বাংলাদেশের যে অগ্রগতি হচ্ছে এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিমিত হয়ে সেটা সনদের মতো হয়েছে। তবে বাংলাদেশের আগামী ৬ বছর এক ধরনের পর্যবেক্ষণের মধ্যে থাকবে। সেই সময়কালে এসব অগ্রগতিকে ধরে রাখার প্রয়োজন আছে। উন্নয়নশীল দেশ হলে পরবর্তী অবস্থা যেটা হবে তখন বাণিজ্য সুবিধা আরও কঠিন হবে, বিদেশি অনুদান কমে যাবে। সেটার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

 

বাংলাদেশকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে : আবু আহমেদ

উন্নয়নশীল দেশের প্রস্তাবনায় বাংলাদেশ মোটামুটি ওপরের কাতারে গেল। যেসব রাষ্ট্র ভালো করেছে বা করছে সেসব রাষ্ট্রের কাতারে পৌঁছাল বাংলাদেশ। লিস্ট ডেভেলপে ছিল ৫০টার মতো রাষ্ট্র। সেটার মধ্যেই ছিলাম আমরা এতদিন। কিন্তু ডেভেলপিং কান্ট্রি সংখ্যায় অনেক বেশি- একশ’র ওপরে। ওদের সঙ্গে এখন আমাদের জায়গা হলো; যদিও নিচের দিকে। জাতিসংঘ দেখবে তিন বছরে বাংলাদেশ অবস্থান কতটুকু পাল্টাতে পেরেছে। অবস্থান আরও স্ট্রং করতে পারছে কি না। এ স্বীকৃতি প্রাথমিক, পর্যবেক্ষণে রাখবে, রেখেছেও পরীক্ষার মধ্যে। তবে এটা আমাদের জন্য সম্মানের জায়গা। এ সম্মান আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়। গ্লোবালি আমরা একটা আউটপুট পাব। বাংলাদেশ সম্বন্ধে বাইরের রাষ্ট্রে যে ধারণা সেটা পাল্টাবে।

একই সঙ্গে শঙ্কার ক্ষেত্রও রয়েছে। আমরা যদি গ্রোথ লেভেল বজায় রাখতে না পারি, কিংবা আমাদের অর্জিত সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট যদি ব্যাহত হয়, এক্সপোর্ট যদি পেছনে চলে যায়- সব মিলিয়ে আমাদের যে পজিটিভ ইন্ডিকেটরগুলো আছে সেগুলো যদি ঠিকমতো ওপরের দিকে না গিয়ে এক জায়গায় স্থির থাকে তখন শঙ্কার কারণ থাকবে। বিশেষ করে জিডিপি গ্রোথ ও এক্সপোর্ট এ দুটি বিষয় জরুরি আমাদের ওপরে নেওয়ার ক্ষেত্রে। ইনভেস্টমেন্ট হতে হবে, ইনভেস্টে জোর দিতে হবে আরও। ফলে আগামী কয়েক বছর হুঁশিয়ার থাকতে হবে বাংলাদেশকে।