বিদেশী ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়ছে, দরকার নমনীয় শর্ত – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in বণিকবার্তা on 20 February 2025

সরকারের বিদেশী ঋণ পরিশোধ খরচ বছরে ৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাড়বে আরো ১ বিলিয়ন ডলার

সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৬০৭ কোটি ৮০ লাখ ডলারের বিদেশী ঋণ পরিশোধ করেছে (সুদ ও আসল মিলিয়ে)। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিশোধ করা হয়েছিল ৪৭৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

সে অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে সরকারের বিদেশী ঋণ পরিশোধ বাবদ ব্যয় বেড়েছে ২৭ শতাংশের বেশি। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে সরকারের মোট বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৮ দশমিক ১৮ বিলিয়ন (৭ হাজার ৮১৮ কোটি) ডলারে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) শেষে এ বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৮০ বিলিয়ন (৮ হাজার কোটি) ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকার নতুন বিদেশী ঋণের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে ২০০ কোটি ডলারের বেশি। এ সময় বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের অর্থ ছাড় হয়েছে ৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন (৩২৬ কোটি) ডলারের কিছু বেশি। এ ছয় মাসে সরকার ঋণ পরিশোধ করেছে প্রায় ১৯৮ কোটি ১৮ লাখ ডলার। এর মধ্যে আসল পরিশোধ হয়েছে ১২৩ কোটি ৪২ লাখ ডলারের বেশি। বাকি প্রায় ৭৫ কোটি ডলার পরিশোধ হয়েছে সুদ বাবদ।

ইআরডির তথ্যানুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের বিদেশী ঋণ পরিশোধের মধ্যে সরকারের নিজস্ব ঋণ (সাধারণ) পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৩৩৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে বাকি ২৭০ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এর মধ্যে জ্বালানি তেল বাবদ ১২৬ কোটি, বিদ্যুৎ খাতে ৮০ দশমিক ৬০ লাখ, আইএমএফকে ৪৫ কোটি ২০ লাখ, বিসিআইসি ১০ কোটি, বিমান ৬ কোটি ৯০ লাখ ও বিটিআরসির ১ কোটি ৯০ লাখ ডলারের ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে।

ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়বে ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারেরও বেশি। পর্যায়ক্রমে এ ঋণ পরিশোধের চাপ সামনের বছরগুলোয় আরো বাড়বে। কেননা গত অর্থবছরে বিদেশী ঋণের আসল পরিশোধ যে গতিতে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি গতিতে বেড়েছে সুদ বাবদ খরচ। টাকার অবমূল্যায়নের ফলে বিদেশী ঋণের সুদের পরিমাণ বেড়ে গেছে। তাছাড়া প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণের চাপও সামনে বাড়তে থাকবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সামনের দিনগুলোয় সরকারের বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে এবং এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরেও চাপ পড়বে। বড় প্রকল্পগুলোয় গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে গেলে সুদ ও আসল দুটোই পরিশোধ করতে হবে। ফলে সামনে ঋণ পরিশোধের চাপ স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। এ চাপ এমন একটি সময়ে আসছে যখন দেশের রিজার্ভের পতন ঠেকানো গেলেও তা এমন পর্যায়ে নেই যে ঋণ পরিশোধের চাপকে ধারণ করতে পারে। এ অবস্থায় আমাদেরকে বিদেশী ঋণের শর্ত নমনীয় করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি করতে হবে। সম্প্রতি চীনের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। অন্যদের সঙ্গেও এ ধরনের আলোচনা শুরু করাটা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে করে সহনীয়ভাবে ঋণ পরিশোধ করা যায়। পাশাপাশি নতুন করে বিদেশী ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে খুব সাবধান থাকতে হবে। আমাদের ঋণ পরিশোধের যে প্রক্ষেপণ করা হয়, সেক্ষেত্রেও অস্পষ্টতা রয়েছে, সেগুলোকে ঠিক করতে হবে। তা না হলে নীতিনির্ধারকরা সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। কতটুকু চাপ আসবে, আগাম কোনো সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে কিনা বিবেচনায় নিতে হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাজেট সহায়তা পেলে আমাদের জন্য কিছুটা সুবিধা হবে। পাশাপাশি ঋণ পরিশোধের অবস্থা ও রিজার্ভ কোথায় দাঁড়াতে পারে সেই প্রক্ষেপণ বিবেচনায় নিয়ে নতুন ঋণ গ্রহণের কৌশল ঠিক করতে হবে।’

বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় দাতাদের সরকার গত অর্থবছরে ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে পরিশোধ করেছে ৩৩৭ কোটি ২০ লাখ ডলার বা ৩৭ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ। এর মধ্যে ২২ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা মূল ঋণ ও ১৪ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা সুদ রয়েছে। বহুপক্ষীয় দাতা সংস্থা হিসেবে গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে (এডিবি)। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংস্থাটির অনুকূলে পরিশোধ করা হয়েছে ১৪ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা আসল ও ৫ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা সুদ। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সদস্য ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনকে (আইডিএ) গত অর্থবছরে পরিশোধ করা হয়েছে ৯ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল ঋণের অর্থ ৭ হাজার ৪৪ কোটি এবং সুদের পরিমাণ ২ হাজার ২৭২ কোটি টাকা।

দ্বিপক্ষীয় ঋণের ক্ষেত্রে সরকার গত অর্থবছরে চীনকে ৩ হাজার ৭০১ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে মূল ঋণের কিস্তি ২ হাজার ৩৭৩ কোটি ও সুদ ১ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। জাপান সরকারের সহযোগিতা সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অনুকূলে পরিশোধ করা হয়েছে ১ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল ঋণ ১ হাজার ৩৪৪ কোটি ও সুদ ৫৮৮ কোটি টাকা।

রাশিয়ার এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। এ ঋণের আসল এখনো পরিশোধ শুরু হয়নি। ২০২৭ সাল থেকে আসল পরিশোধের কথা থাকলেও সরকার এটিকে আরো দুই বছর পেছানোর উদ্যোগ নিয়েছে। আসল ও সুদসহ তখন বাংলাদেশকে প্রতি বছর প্রায় ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। তবে তার আগেই রাশিয়ার নেয়া ঋণের বিপরীতে সুদ বাবদ বড় অংকের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। গত অর্থবছরে ঋণের সুদ বাবদ রাশিয়াকে ২৬ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। অবশ্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার কাছে সুদের অর্থ পাঠাতে পারছে না বাংলাদেশ। অন্যথায় এ সুদ পরিশোধের পরিমাণ আরো বেশি হতো বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গত অর্থবছরে ভারতকে ৯৭৮ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করেছে সরকার। এর মধ্যে ৭৮৭ কোটি টাকা মূল ঋণ ও ১৯১ কোটি টাকা সুদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারের নিজের ঋণের পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও এ ধরনের অন্যান্য যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর নেয়া বিদেশী ঋণও শেষ পর্যন্ত সরকারকেই পরিশোধ করতে হয়। এসব ঋণের ক্ষেত্রে সরকার গ্যারান্টি দিয়েছে। ঋণ নেয়ার সময় চুক্তিতে যদিও বলা হয়ে থাকে যে প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে এ অর্থ নিয়েছে এবং তাদেরকে সেটি ফেরত দিতে হবে। কিন্তু দেখা যায় যে যখন কিস্তি পরিশোধের সময় আসে তখন অনেক ক্ষেত্রে তারা এটি পরিশোধ করতে পারে না এবং তখন সরকারকেই সেটি পরিশোধ করতে হয়। এটিই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ফলে সার্বিকভাবে সুদাসলে সরকারের বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। যত দিন যাবে এ ঋণ পরিশোধের বোঝা আরো বাড়বে। তাই বিদেশী ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সেটি গ্রহণের ন্যায্যতা, পরিশোধের সক্ষমতা ও ঋণের প্রয়োজনীয়তার দিকটি বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে আগামী দিনগুলোয় ঋণ পরিশোধের চাপের কারণে আরো বেসামাল অবস্থা হবে। এজন্য সরকারকে একটি কার্যকর ও যথাযথ ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল গ্রহণ করতে হবে।’