Originally posted in বণিকবার্তা on 7 December 2025
জ্বালানি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা
আইইপিএমপি সংশোধন করে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের অংশীদারত্ব বাড়াতে হবে

দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা (আইইপিএমপি) দ্রুত সংশোধন করে তাতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের অংশীদারত্ব বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা (আইইপিএমপি) দ্রুত সংশোধন করে তাতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের অংশীদারত্ব বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীর সামরিক জাদুঘরে ‘বাংলাদেশ জ্বালানি সম্মেলন ২০২৫’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গতকাল এ কথা বলেন তারা। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনে দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান সংকট, সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ রূপান্তরের দিকনির্দেশনা নিয়ে নীতিনির্ধারক, বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা তাদের মতামত তুলে ধরবেন। বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক কর্মজোটের (বিডব্লিউজিইডি) আহ্বায়ক অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলামের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংস্থাটির নির্বাহী সদস্য মনোয়ার মোস্তফা।
সম্মেলনে দেশে জ্বালানি খাতের বর্তমান চিত্র তুলে ধরে বক্তারা বলেন, এনডিসি অনুসারে ২০৩৫ সালে বিদ্যুতের চাহিদা হবে ২৬ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। অথচ স্থাপিত সক্ষমতা এরই মধ্যে ২৮ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটেরও বেশি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ আরো পাঁচ হাজার মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। অলস সম্পদের দায় মেটাতে এ বছর সরকারকে সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। এছাড়া এ বছর ২ হাজার ২০ মেগাওয়াটের নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে।
অন্যদিকে গত বছরের তুলনায় এলএনজি আমদানি বেড়েছে ১৩ শতাংশ, যা মোট গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে। এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। বাংলাদেশ এখন তার জ্বালানি খাতের এক গুরুত্বপূর্ণ যুগ সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে; হয় নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে নতুন মাইলফলক তৈরি করতে হবে, নতুবা পিছিয়ে পড়তে হবে। ১৭ বছর আগের জ্বালানি নীতি হালনাগাদ করা হলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ফেলা হয়েছে, যা শুভ ফল বয়ে আনবে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল নবায়নযোগ্য এবং বৈদ্যুতিক যানবাহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ সেই গতিতে এগোতে পারছে না।
সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘এখন মানুষ গ্যাস চায়। আপনি নবায়নযোগ্য চান। এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে উত্তরণে যেটুকু সময় লাগবে সেটুকু আমাদের দিতে হবে। সেটুকু বিনিয়োগ আমাদের করতে হবে। এটাকে সরকারের প্রাধিকার হিসেবে ধরে নিয়েই করতে হবে।’
জ্বালানি রূপান্তর সময়সাপেক্ষ কাজ উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে রাতারাতি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে লাফ দেয়া সম্ভব নয়। তাই এর অংশ হিসেবে আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্প্রসারণে নানা নীতিমালা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছি এবং সেই কাজ চলমান রয়েছে। তাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা কমল নাকি বাড়ল এর চেয়ে মুখ্য হলো লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিগত সময়ে বড় বড় লক্ষ্য নেয়া হলেও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে খুবই সামান্য। তাই বড় লক্ষ্য ঘোষণা করে তা অর্জন না হওয়া থেকে বরং বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা প্রণয়নই বেশি জরুরি। এজন্য আমরা প্রত্যেকটি সরকারি ভবনের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি, যা দ্রুত এগিয়ে চলছে।’
সম্মেলনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘প্রযুক্তিগত জ্ঞান, সঠিক নীতি ও দক্ষ জনবল এ তিনটির সমন্বয় ছাড়া কার্যকর জ্বালানি রূপান্তর সম্ভব নয়। বিদেশী পরামর্শক নির্ভরতা কমিয়ে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সক্ষমতা গড়ে তোলা ও নীতি বাস্তবায়নে দেশীয় মালিকানা তৈরি করাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।’
এ সময় সেন্টার ফর রিনিউয়েবল এনার্জি সার্ভিসেস লিমিটেডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রতি বছর বিদ্যুৎ খাতে সরকারের সাবসিডি দিতে হচ্ছে ৪ বিলিয়ন ডলার। এর অর্ধেক অর্থ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে দিলে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের নীতিমালাগুলো নবায়নযোগ্য বান্ধব নয়। ফলে এ খাতে অগ্রগতি হচ্ছে না। আইইপিএমপিতে এসব বিষয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশীয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী মহাপরিকল্পনা সাজাতে হবে। তাহলে এটি গ্রহণযোগ্য হবে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে জ্বালানি খাতে সংঘবদ্ধ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। যার বড় একটি ছিল পলিসিগত অপরাধ। জাইকা বা বিদেশী পরামর্শকদের তৈরি মহাপরিকল্পনা কখনই নবায়নযোগ্য এনার্জির স্বার্থ রক্ষা করবে না। সুতরাং পরিকল্পনায় দেশীয় বিশেষজ্ঞদের বেশি যুক্ত করতে হবে।’
লিড বাংলাদেশের গবেষণা পরিচালক অ্যাডভোকেট শিমনুজ্জামান বলেন, ‘জ্বালানি রূপান্তরে আইনগত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। ন্যায্য রূপান্তরে শুধু প্রযুক্তি নয়, জনগণের অংশগ্রহণ ও প্রান্তিক মানুষের অধিকার এবং সুরক্ষাকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।’



