গেল কয়েক বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে আসার কারণ কী বলে মনে করেন?
গত অর্থবছরের মতো ২০১২-১৩ অর্থবছরেও মোট দেশজ উত্পাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্জন হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। জিডিপি হিসাবের ভিত্তি বছর ১৯৯৫-৯৬ থেকে ২০০৫-০৬ করার পরও প্রবৃদ্ধির হার ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ ছিল। আমাদের অগ্রগতির ধারায় এটি একটি নেতিবাচক লক্ষণ। কেননা ২০২১ সালের মধ্যে আমরা একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চাই। আর মধ্যম আয়ের মানদণ্ডটি কোনো স্থবির বিষয় নয়। তাই প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের গতিময়তা অব্যাহত রাখতে হবে। দেখা যাচ্ছে, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১১-১৫ সালের মধ্যে গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হলেও সেটি অর্জন এখন কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে ২০১২-১৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ হওয়া উচিত ছিল। তেমনি চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এটি ৯ দশমিক ৬ শতাংশ হতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা নেই। এক্ষেত্রে কৃষি ও সেবা খাতের অবদান জিডিপিতে কমে যাওয়ার ফলেই প্রবৃদ্ধি কমতির দিকে। যেমন ২০১০-১১ অর্থবছরের তুলনায় ২০১১-১২ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ এবং সেবা খাতের অবদান শূন্য দশমিক ১ শতাংশ কম ছিল। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে কৃষি ও সেবা খাত উভয়েরই অবদান শূন্য দশমিক ২ শতাংশ করে কম ছিল। তাছাড়া বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাওয়ায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। বাস্তব চিত্রটা কী?
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির দুটো উদ্দেশ্য থাকে। একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করা এবং অন্যটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এ দুটির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা তাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ বটে। গত কয়েক অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি থাকার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ এবং মুদ্রা সরবরাহ কমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য দেখা যাচ্ছে না। ২০১৩ অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি ছিল। চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হবে। নির্বাচনী বছরে অর্থনীতিতে বরাবরই বেশ কিছু বাড়তি ব্যয় যুক্ত হয়। এবারো এর ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। যেমন— প্রথমত. ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সরকারি এবং ব্যক্তিগত উভয় খাতেই মজুরি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বিতীয়ত. নির্বাচনী বছরে বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সরকারি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। তৃতীয়ত. বাংলাদেশে নির্বাচনের সময়ে টাকার ছড়াছড়িও লক্ষ করা যায়। এ সবকিছু মিলে অর্থনীতিতে সামগ্রিক চাহিদা বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতির ওপর ঊর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি হয়। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হবে অভ্যন্তরে পণ্যসামগ্রীর অবাধ চলাচল অব্যাহত রাখা। বর্তমান রাজনৈতিক সংকট এবং সামনের দিনগুলোয় হরতাল, অবরোধ, সহিংসতা ইত্যাদি কারণে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যার প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতেও।
দেশের ব্যাংকিং খাত কেমন পারফরম্যান্স করছে? রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সংঘটিত কেলেঙ্কারি এবং এক্ষেত্রে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকায় আপনি কী সন্তুষ্ট? বেসরকারি ব্যাংকেও কিছু কেলেঙ্কারির ঘটনা সম্পর্কে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। তদারকির শিথিলতার কারণেই কি এমন হচ্ছে?
আমাদের আর্থিক খাতটি মূলত ব্যাংকনির্ভর। সুতরাং ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যের ওপর আর্থিক খাতের সামগ্রিক ভালো-মন্দ নির্ভর করে। সাম্প্রতিক সময়ে এ খাতের দুর্বলতা নানাভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য নির্ণায়ক সূচকগুলোয়, কয়েক বছর ধরে অধোগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যাংকের সম্পদের বিপরীতে প্রাপ্তি বা রিটার্ন, ইকুইটির ওপর প্রাপ্তি, মূলধন পর্যাপ্ততা এবং মোট ঋণের মধ্যে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ। ব্যক্তি খাতের চেয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ। রাজনৈতিক প্রভাব এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। রাজনৈতিক প্রভাব শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেই নয়, ব্যক্তি খাতের ব্যাংকের ওপরও রয়েছে। প্রভাবশালীদের নির্দেশনা এবং তদবিরে যেসব ঋণ দেয়া হয়, সেগুলো কু-ঋণে রূপান্তরের ঝুঁকি বেশি থাকে। ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার একটি বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বড় বড় আর্থিক জালিয়াতির মাধ্যমে। ব্যাংকগুলোয় ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এবং সুশাসন দুর্বল থাকায় আর্থিক কেলেঙ্কারি সংঘটিত হচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার শতভাগে উন্নীত করা এবং মানবসম্পদের দক্ষতার ওপর বরাবরই জোর দেয়া হচ্ছে। ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা হতাশাজনক। তাছাড়া যত দিন পর্যন্ত যোগ্য পরিচালনা পরিষদ এবং গতিশীল কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে ব্যাংকিং সেবা ও প্রকল্পের ব্যবসায়িক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে না পারছে, তত দিন শ্রেণীকৃত বা কু-ঋণের জঞ্জাল থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।
সরকার দাবি করছে কৃষিতে তারা সফল। আপনার বিশ্লেষণ কী? কৃষিতে আমাদের চ্যালেঞ্জ এবং এক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ যথেষ্ট বলে মনে করেন কি?
গত চার দশকে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষির প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যদিও প্রবৃদ্ধির ধারা সবসময় একই রকম ইতিবাচক ছিল না। আমাদের প্রধান শস্য চাল উত্পাদন কয়েক বছর ধরেই বাড়ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে চাল উত্পাদন তার আগের বছরের চেয়ে ১ শতাংশ বেশি ছিল। ২০১২-১৩ অর্থবছরেও চাল উত্পাদন তার আগের বছরের চেয়ে ১ শতাংশ বেশি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৃষকরাই সর্বাগ্রে সাধুবাদ পাবেন। নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের খাদ্য উত্পাদন বাড়াতে তারা অব্যাহত পরিশ্রম করে চলেছেন। তবে মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদে কৃষি খাত উন্নয়ণে আমাদের বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি তো হচ্ছে, শুধু চালের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, চাল উত্পাদনে সৃজনশীল হওয়া। কেননা আমাদের সমস্যা হলো— একদিকে কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাওয়া, অন্যদিকে জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার অব্যাহত থাকা। বর্তমান হারে বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর জন্য চাল উত্পাদন প্রতি বছর চার লাখ টন করে বাড়াতে হবে। চাষযোগ্য জমি সংকুচিত হওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন দুর্যোগ বৃদ্ধি পাওয়া, অতিব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে এটি অর্জন করা কষ্টসাধ্য হবে। তবে চাল উত্পাদন আরো কিছুটা বাড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে বন্যা ও খরা আক্রান্ত এবং লবণাক্ত জমিতেও যাতে জন্মাতে পারে এ ধরনের ধান উদ্ভাবন এবং বিশেষত উত্তরাঞ্চলের হাওর, বন্যাকবলিত ও উপকূলীয় চরাঞ্চলে তা চাষাবাদের মাধ্যমে জমির ব্যবহার। সেজন্য পর্যাপ্ত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা জোগানো প্রয়োজন। যেসব প্রতিষ্ঠান কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে নিয়োজিত, তাদের জনবল ও আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণে জন্য জাতীয় বাজেটে আরো বরাদ্দ রাখতে হবে।
বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণ কী বলে মনে করেন?
বিনিয়োগে স্থবিরতা বেশ উদ্বেগজনকই বটে। সরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়লেও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বর্তমানে ঋণাত্মক। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ১ দশমিক ২ শতাংশ কমে গেছে। একই সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বেসরকারি বিনিয়োগের অবদান নেতিবাচক (-) শূন্য দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দিয়েই তা বোঝা যায়। যেমন ২০১১-১২ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল (-) ১৪ দশমিক ১ শতাংশ হারে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে কিছুটা কমলেও তা ছিল (-) ৬ দশমিক শূন্য শতাংশ। বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যেটি আগেই বলেছি। শ্লথ বিনিয়োগের আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে— ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়া। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ কম হয়েছে। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না। তদুপরি এটি হচ্ছে নির্বাচনী বছর। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সহিংসতা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া অবকাঠামো এবং ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা তো রয়েছেই। এগুলো ঠিক না করলে শুধু নীতিমালা দিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব নয়। আমাদের দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত উপযোগী একটি নীতিমালা রয়েছে। তারপরও বৈদেশিক বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত হারে আসছে না কেন? স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতামুক্ত পরিবেশই যেকোনো বিনিয়োগের পূর্বশর্ত
শিল্প খাতের পারফরম্যান্স সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে শিল্প খাত এখনো ইতিবাচক অবদান রাখছে এবং এ হার ২০১১-১২ অর্থবছরে ২ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শিল্প খাতে তৈরি পোশাকশিল্পের অবস্থান বোধগম্যভাবেই শীর্ষে। তবে মূল্যসংযোজনের দিক থেকে ওষুধ, পরিবহন যান প্রস্তুত, আসবাব ইত্যাদি শিল্পও এগিয়ে আসছে। শিল্প বিকাশেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অবকাঠামো, বিদ্যুত্ ও গ্যাস সরবরাহ, সুলভ মূল্যে জমির প্রাপ্যতা, আইনি কাঠামো ইত্যাদি উপযোগী হতে হবে। তাছাড়া ব্যাংকঋণের সুদও এখানে একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলার কারণে ব্যাংকগুলোয় প্রচুর তারল্য সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারছে না এবং ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে অনীহা বিদ্যমান, সে কারণে তারা লাভবান হতে পারছেন না। সেজন্য ব্যাংকে তারল্য বেশি হওয়া সত্ত্বেও সুদের হার বাড়িয়ে লাভ তারা পুষিয়ে নিতে চাচ্ছে। ফলে শিল্পোদ্যোক্তারাও উত্সাহ পাচ্ছেন না। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে দক্ষ শ্রমিকের অভাব। আমরা একটি জনবহুল দেশ হওয়ার পরও এখানে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে, যেহেতু শ্রমিকের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রচেষ্টা ন্যূনতম। সরকারের শিল্পনীতিতে বেশ কিছু ‘অগ্রবর্তী খাতকে’ চিহ্নিত করে সেগুলোকে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি শিল্পায়ন কৌশলের অংশ হিসেবে বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা স্থাপনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যান্য খাতের মতোই শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও নীতিমালার ঘাটতি নেই। শুধু প্রয়োজন সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা।
অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার কি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে বলে মনে করেন? এক্ষেত্রে পদ্মা সেতু নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে সরকারের ভূমিকাকে কীভাবে দেখেন?
অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা কাজ করে বিভিন্ন ধরনের প্রশাসনিক জটিলতার কারণে। তার ওপর সম্পাদিত প্রকল্পের গুণগত মানেও ঘাটতি রয়ে যায়। এটি সব সরকারের বেলায়ই কমবেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত, আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করা এবং কর্মসংস্থান ও আয় সৃষ্টির জন্য পদ্মা সেতু নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই পদ্মা সেতু নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা আমাদের কাম্য ছিল না। দুই পক্ষের অনমনীয় অবস্থান পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছে। আমাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণে দাতারা অর্থায়ন করতে গেলে বেশ ভাবনাচিন্তা করবে। তবে দাতারা সর্বক্ষেত্রেই দুর্নীতির ব্যাপারে যে শূণ্য সহনশীলতা দেখায় তা সত্য নয়। পৃথিবীতে ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে, যেখানে গ্রহীতা দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিকে সম্বল করেই বরং তারা তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। তাই তাদের আচরণ দেশভেদে বৈষম্যমূলক হয়। কিন্তু আমরা যেহেতু এখনো সাহায্যনির্ভর দেশ এবং আমাদের নিজেদেরকে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রাখতে পারছি না, তাই অনেক সময় অপমান সহ্য করতে হয়। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের কাছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জনগণের এ অনুভূতি বুঝতে হবে। তবে পদ্মা সেতু নিয়ে জটিলতার বেশির ভাগ দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।
বর্তমান সরকারের মেয়াদে শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটলো। সে পরিস্থিতি কাটিয়ে শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন কি?
শেয়ারবাজারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় যে প্রস্তাবগুলো বিভিন্ন সময়ে দেয়া হয়েছে, সেগুলোর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। শেয়ারবাজারে মালিকানা ও প্রশাসনের মধ্যে বিভাজন, আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্যে আরো সমন্বয় সাধন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর চাহিদা বাড়ানো ও মিউচুয়াল ফান্ডকে উত্সাহিত করা এবং ইকুইটি ও বন্ডের জন্য সরবরাহ ও চাহিদা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, শেয়ারবাজারে এখনো নতুন বিনিয়োগ আসছে না। এখনো আস্থার সংকট রয়ে গেছে। স্থানীয় ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান যাতে বিনিয়োগে উত্সাহী হয়, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিদ্যমান নীতিমালা পর্যালোচনা করতে পারে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারবাজারে আসার কথা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বারবার বলা হলেও এক্ষেত্রে তাদের অনীহা লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারবাজারে না এলে স্থানীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান উত্সাহিত হবে কীভাবে? ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগে উত্সাহিত করার কথা বলা হচ্ছে, যাতে তাদের বিনিয়োগ ভবিষ্যদ্বাচ্য হয়। তবে এক্ষেত্রে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর প্রশাসনিক কার্যক্রম ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, তাও নজরদারিতে রাখতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন এখন বড় ইস্যু। বাংলাদেশ কি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের সমস্যা ও শঙ্কা তুলে ধরতে পারছে? অভ্যন্তরীণভাবে যা করা দরকার, সেটাও কি হচ্ছে?
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত বাংলাদেশের জন্য বেশ ভয়াবহ। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশ যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বন্যা, খরা, সাইক্লোনসহ অপ্রত্যাশিত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক পরিবর্তন। এছাড়া রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। ফলে বাংলাদেশের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে বলে শঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাসস্থান, কৃষি, শিল্প তথা বিরাট জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা। মাত্র ক’দিন আগেই ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আইপিসিসির পঞ্চম মূল্যায়ন রিপোর্ট বের হলো, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত বিষয়ে পুনরায় জোর দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জলবায়ু-সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন সভায় বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ জোরালোভাবে বলে আসছে যে, উন্নত বিশ্বের বেপরোয়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ভোগ-বিলাসিতার ফলেই বিশ্ব উষ্ণায়ন বেড়ে চলেছে এবং এর ভুক্তভোগী হচ্ছে আমাদের মতো দরিদ্র দেশগুলো। তাই উন্নত দেশগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে এর ক্ষতিপূরণ দেয়া। বাংলাদেশ যাতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের সঙ্গে অভিযোজন করে চলতে পারে, এজন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং আধুনিক প্রযুক্তি। বাংলাদেশ এ অভিযোজন ব্যয় মেটানোর অর্থ দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোয় জোর দাবি জানাচ্ছে। অভ্যন্তরীণভাবে ২০০৮ সালে প্রণয়ন করেছে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনা। সরকার বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড অ্যাক্ট বা বিসিসিটিএফ ২০১০ প্রণয়ন করেছে। বিসিসিটিএফ এবং বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসিলিয়েন্ট ফান্ড বা বিসিসিআরএফ— এ দুটো তহবিলের বরাদ্দ ও ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা আবশ্যক। এর অধীনে যে প্রকল্পগুলো নেয়া হবে, সেগুলো বাস্তবতার আলোকে প্রণীত হওয়া উচিত। এজন্য প্রয়োজন জনগণকে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা।