Sunday, May 19, 2024
spot_img

‘বিযুক্ত’ যুবসমাজ: বিশ্লেষণী কাঠামোর সন্ধানে – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in সমকাল on 13 September 2021

চলমান কভিড-১৯ অতিমারির অভিঘাত সবচেয়ে বেশি পড়েছে যুবসমাজের ওপর। প্রান্তিক এবং পিছিয়ে পড়া যুব জনগোষ্ঠীর ওপর এর মাত্রা আরও তীব্র। শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব এবং প্রযুক্তিগত বৈষম্য যুবসমাজের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দিয়েছে। তাদের অনেকেই সমাজের মূলধারা থেকে ‘বিযুক্ত’ হয়ে পড়ছে। যুবসমাজের এ পরিস্থিতি নানা অসংগতি তৈরি করছে। এ কারণে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে যুবসমাজের বিযুক্ততা কিংবা বিচ্ছিন্নতাকে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

যুবসমাজ নানা ধরনের আর্থসামাজিক বৈচিত্র্য নিয়ে দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের চিন্তা করতে হলে যুবসমাজকে কেন্দ্র করেই চিন্তা করতে হবে। বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এরাই নেতৃত্ব দেবে। যদিও যুবসমাজের সংজ্ঞা নিয়ে সরকারের তথ্যের মধ্যেই বিতর্ক রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী যুবদের বয়সসীমা ১৫ থেকে ২৯ বছর। সরকারের যুবনীতিতে এই সীমা ১৮ থেকে ৩৫ বছর। যদি ২৯ বছরকে যুবদের বয়সসীমা ধরা হয়, তাহলে এর নিচে আছে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ।

আমাদের দেশের যুবসমাজের অর্জন অনেক। ক্রীড়া, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্নভাবে উদ্দীপনা ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আলাদা করে জায়গা করে নিচ্ছে। তবে যুবসমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের শক্তি দেশ ও জাতির জন্য সঠিকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে না। তারা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তবে আর্থিক সচ্ছলতা বা শিক্ষা থাকলেও যুবরা বিযুক্ত হতে পারে। যে ছেলেটি উচ্চশিক্ষা পেয়েছে, সচ্ছল পরিবারের ছেলে এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্যে আছে, সে নীরবে-নিভৃতে রাত্রিবেলা উগ্র চিন্তার মধ্যে ঢুকছে। এখানে শিক্ষার অভাব এবং আর্থিক সংকট নিয়ে এই বিযুক্ততাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

যুবজীবনের সংকট:যুবসমাজের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি এ আলোচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। যুবকদের মধ্যে যারা বেকার তাদের ১৩ দশমিক ৪ শতাংশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা আছে। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এমন যুবকদের ক্ষেত্রে এ হার ৪ শতাংশ। এর মানে নিম্ন-দক্ষতা ও শিক্ষার যুবকরা অনানুষ্ঠানিক খাতে নিম্ন উৎপাদনশীলতা এবং নিম্ন মজুরির কর্মসংস্থানের মধ্যে রয়েছে। দেশের ৮৯ শতাংশের বেশি যুব শ্রমশক্তি অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শিক্ষা, কর্মসংস্থান অথবা প্রশিক্ষণে নেই এমন সংখ্যা সমগ্র যুবসমাজের ৩০ শতাংশ। এখানে জেন্ডার বৈষম্যও আছে। নারীদের ক্ষেত্রে এ হার ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ৮ দশমিক ১ শতাংশ। দরিদ্র পরিবারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে যায়। আর ৫০ শতাংশ ঝরে যায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে। বাজারে দক্ষতার যে চাহিদা আছে তার সঙ্গে চাকরিপ্রার্থীদের দক্ষতার ব্যবধান ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যদিও দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ বেড়েছে, তবুও এখনও চাকরির বাজারে ব্যাপক দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। কভিডকালে বেসরকারি খাতের অনেক কর্মী ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাবে বিশেষত সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের যুবকদের মধ্যে চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞানের অভাব প্রকট, যা তাদের আরও পেছনে ঠেলে দিচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে এসব ইস্যু যুব জনগোষ্ঠীর সক্ষমতার ঘাটতি তৈরি করছে এবং কভিডকালে ‘বিযুক্ত’ যুবসমাজের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে কভিডের কারণে যেসব প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে তা কভিড-পরবর্তী সময়ে শিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রাখার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করছে। একই সঙ্গে জ্ঞান ও দক্ষতার যথেষ্ট ঘাটতি তৈরি করেছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বিশেষত দলিত, সমতলের আদিবাসী, চর-হাওর, উপকূলে বসবাসকারী এবং শহরের বস্তিবাসীদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা গ্রহণের অভাব তাদের আরও পেছনে ঠেলে দিয়েছে। ২০২০ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, যুব শ্রেণির অন্তত ৫০ শতাংশ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অংশগ্রহণের জন্য স্মার্টফোন, ল্যাপটপ এবং কম্পিউটারের মতো সামগ্রী নেই।

২০২০ সালের এই জরিপে যুবসমাজের মধ্যে দুশ্চিন্তা (৬৭ শতাংশ) এবং হতাশাগ্রস্ততার (৭৮ শতাংশ) উচ্চ মাত্রা পাওয়া যায়। বেকারত্ব এর সবচেয়ে বড় কারণ বলে প্রতিভাত। মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি এবং এর পরিণতিতে মাদকের প্রতি আসক্ত হওয়ার প্রবণতার পেছনেও বেকারত্ব বড় কারণ বলে জরিপে উঠে আসে। অন্যদিকে, যুবসমাজের একটি অংশের মধ্যে উগ্র চিন্তাভাবনা লক্ষণীয় এবং কভিডকালে ভার্চুয়াল যোগাযোগনির্ভরতার কারণে এটি বেড়েছে। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ তরুণের মধ্যে ভবিষ্যতের আয়ের সুযোগ নিয়ে প্রত্যাশা নেই। জরিপে ৯৬ শতাংশ উত্তরদাতা মানসিক চাপে রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। প্রায় ৮০ শতাংশ তরুণ বলেছে, কভিডকালে তাদের আয় কমেছে।

আমরা জানি, সরকারের যুবকেন্দ্রিক বেশ কিছু নীতি ও কার্যক্রম রয়েছে। জাতীয় যুবনীতি এবং জাতীয় যুব কর্মপরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। কর্মসংস্থান বাড়াতে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি রয়েছে। প্রশিক্ষণ এবং অস্থায়ী চাকরির সুযোগ সৃষ্টিতে রয়েছে ন্যাশনাল সার্ভিস প্রোগ্রাম। নীতি এবং উদ্যোগ থাকলেও এর বাস্তবায়নই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। নাগরিক প্ল্যাটফর্মের এক জরিপে দেখা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশ যুবক কভিড-১৯ এর প্রথম বছরে কোনো সরকারি সহায়তা পায়নি। অন্যদিকে, যুবকদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরা এবং তাদের সচেতন করার মতো পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। এর কারণ তথ্যের অপর্যাপ্ততা, সমন্বয়ের অভাব এবং নেতৃত্বের ব্যর্থতা। চাকরির বাজারে চাহিদা অনুযায়ী যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং নাগরিক সচেতনতা বাড়াতে যুবশ্রেণির কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন নীতি উদ্যোগ এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্ব দরকার। যুবকদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে সরকারের বাইরে নাগরিক সমাজ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও অংশীদারিত্ব দরকার। তরুণদের জন্য যেসব নীতি আছে সেগুলো উচ্চাভিলাষী। নীতিগুলোকে আরও স্থানিকভাবে তৃণমূল পর্যায়ে নামিয়ে এনে কার্যকর করার চেষ্টা করতে হবে। গড়ভাবে না দেখে গোষ্ঠীবান্ধবভাবে দেখতে হবে। এখানে নেতৃত্ব, সামগ্রিক পরিবেশ এবং সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়ও জড়িত।

চারটি বিশ্লেষণী প্রশ্ন: সম্প্রতি এসডিজি বাস্তবায়নে ‘বিযুক্ত’ যুবসমাজের ওপর নাগরিক প্ল্যাটফর্মের এক আলোচনায় চারটি বিষয়কে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়। প্রথমত, বিযুক্ত যুবসমাজ প্রত্যয়টি কি কোনো কার্যকরী ধারণা? একে অবলম্বন করে কি আমরা বাংলাদেশের যুবসমাজকে বোঝার নতুন কোনো আঙ্গিক খুঁজে পাই কিনা? দ্বিতীয়ত, এমন কী দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য আছে, যা দেখে বিযুক্ত যুবকদের চিহ্নিত করা যেতে পারে। যেমন- একটি বৈশিষ্ট্য হলো শিক্ষায়ও নেই, কর্মসংস্থানেও নেই কিংবা কোনো প্রশিক্ষণেও নেই তাদের শ্রমশক্তির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিযুক্ত বলতে পারি কিনা? তৃতীয়ত, বিযুক্ত যুবসমাজের ধারণা বা বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির অন্তর্নিহিত কারণ কী কী? হঠাৎ কী কারণে বিযুক্ততার সৃষ্টি হয়? এবং চতুর্থত, এই জটিল সমস্যার সমাধানের কোন কোন পথ রয়েছে? সমাধান করতে পারলে বিযুক্ত যুবসমাজকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে উৎপাদনশীলভাবে যুক্ত করা যাবে। সব ধরনের দুশ্চিন্তা দূর করে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের পথে এগিয়ে যাওয়া যাবে।

বাংলাদেশের যুবসমাজকে বোঝা ও জানার জন্য বর্তমানে যে বিশ্লেষণী কাঠামো রয়েছে, তা এই মুহূর্তে যথোপযুক্ত বা যথেষ্ট নয়। বিশ্লেষণী কাঠামোতে জীবনচক্র, বয়স এবং কর্মসংস্থানের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রত্যয় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর পরও যুবসমাজকে ঠিকমতো বুঝে ওঠার বিষয়ে একটি অতৃপ্তি থেকেই যায়। ‘বিযুক্ত’ ধারণাটা যে একেবারেই নতুন, তা নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধারণা রয়েছে, যারা বামপন্থি চিন্তার মানুষ এবং মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্র পড়েছেন এবং উদারনৈতিক চিন্তাভাবনার মধ্যে রয়েছেন, তারা ভালো করে জানেন, গ্রামসিয়ান তত্ত্ব থেকে আরম্ভ করে উত্তর আধুনিকতাবাদ চিন্তার মধ্যে এই ধারণাগুলো রয়েছে। দার্শনিকরা বিচ্ছিন্নতার ধারণার ওপর বহুদিন ধরে আলোচনা করছেন। যারা মনস্তাত্ত্বিক জগতে বসবাস করেন, তারা একে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও এ নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। ষাটের দশকের ‘হিপিদের’ আবির্ভাব থেকে বর্তমানের ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস’ আন্দোলন এই বিযুক্ততার ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি মনে করি, বিযুক্ততার ধারণাকে বাংলাদেশের যুব সমস্যা বোঝার জন্য সৃষ্টিশীলতাকে ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অনেকেই ‘বিযুক্ত যুবসমাজ’ এবং ‘পিছিয়ে পড়া যুবসমাজকে’ এক করে দেখছেন। এ দুটো সমধর্মী হলেও এক নয়। সব পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিই যে বিযুক্ত এবং সব বিযুক্তরাই যে পিছিয়ে পড়া, তা নয়।

‘বিযুক্ত’ যুবসমাজের একটি প্রত্যয়গত বিশ্লেষণ কাঠামো সৃষ্টির জন্য এ নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি তথ্য-উপাত্ত যুক্ত করতে হবে। ধারণা ও প্রত্যয়গুলোকে পরিস্কার করা, তথ্য-উপাত্তের সংগ্রহ কাঠামো ঠিক করা এবং তার সঙ্গে নীতির সংযোগ ঘটাতে হবে। এমনটি করতে পারলে বাংলাদেশের যুবসমাজের অনেক দিকে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা বাড়ানোর সম্ভাবনা আরও বেশি বাস্তবায়িত হবে।

 

অর্থনীতিবিদ; সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.