Originally posted in Kalerkantho on 3 January 2023
বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা: রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে চাপ বাড়বে
বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশ নতুন বছরে মন্দার কবলে পড়বে বলে সতর্ক করেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীনে অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়ায় ২০২৩ সাল এক কঠিন সময় হবে। সারা বিশ্বে এর প্রভাব পড়বে বলেও মনে করেন তিনি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, উচ্চ সুদহার এবং চীনে করোনার বিস্তার বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করায় এমনটা হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত বছরের অক্টোবরে আইএমএফ তাদের আগের পূর্বাভাসের তুলনায় ২০২৩ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি খানিকটা কম হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল।
নতুন বছরে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অশনি বার্তাকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা বলছেন, বিশ্বমন্দার ঢেউয়ের প্রথম আঘাত আসবে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে। এতে অর্থনীতিতে চাপ আরো বাড়বে। তাই মন্দার অভিঘাত মোকাবেলায় ব্যয়ে লাগাম টানতে হবে, নিতে হবে আগাম প্রস্তুতি।
করোনার ক্ষত কাটিয়ে বিশ্বের দেশগুলো যখন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ফিরে আসতে শুরু করে, সে সময় থেকেই বিশ্বব্যাপী জ্বালানি, জাহাজভাড়া ও কাঁচামালের মূল্যসূচক চড়া হতে থাকে। ফেব্রুয়ারির রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মূল্যবৃদ্ধির এ সূচকে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে বিশ্বব্যাপী সরবরাহব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে, জ্বালানির রেকর্ড মূল্য এবং এর কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্বমন্দা হলে বেশি প্রভাব পড়বে আমাদের পণ্য রপ্তানিতে।
ইউরোপের মন্দা যদি গভীর ও দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে রপ্তানিতে সেই ধাক্কা বড় হবে। করোনা বাড়ার কারণে চীনের অর্থনীতি যদি হোঁচট খায়, তাদের সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়, তাহলে শুধু রপ্তানি নয়, আমদানিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ আমাদের রপ্তানি পণ্যের কাঁচামালের একটি বড় অংশ আসে চীন থেকে। ’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, মন্দা হলে করণীয় খুব বেশি নেই। তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত রপ্তানিতে তেমন কোনো প্রভাব লক্ষ করা যায়নি, যদিও রপ্তানিতে কিছু দুর্বলতা লক্ষ করা যাচ্ছে। মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ না করে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। বৈদেশিক মুদ্রার জোগানে ভাটা পড়েছে, সেটা যাতে আরো না পড়ে, তার জন্য রেমিট্যান্স বাড়ানো এবং রপ্তানি বহুমুখীকরণ ছাড়া সহজ কোনো পথ নেই।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন. ‘বিশ্বমন্দার শঙ্কা বাংলাদেশের জন্যও দুঃসংবাদ। আমাদের জন্য তিনটি সতর্কতার জায়গা হলো পণ্য বাণিজ্য, অর্থপ্রবাহ ও মানবসম্পদ। পণ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রপ্তানি চাহিদা পড়ে যেতে পারে। আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের সতর্কসংকেত। অন্যদিকে চাহিদা কমে গেলে বিশ্ববাজারে পণ্য মূল্য, জ্বালানি তেলের দাম কমতে পারে। সেই সুযোগও হয়তো আমরা অল্পবিস্তর পেতে পারি। কিন্তু রপ্তানিতে যে ক্ষতিটা হবে, তা আমদানি সাশ্রয় দিয়ে পোষানো যাবে বলে মনে হয় না। এ সময় অর্থপ্রবাহের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়। বৈদেশিক সাহায্য আসে, সেগুলোও থেমে যায়। তাতে নিজেদের দেশে কর আহরণ কমে যায় এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য ব্যয় বেড়ে যায়। জ্বালানি তেলের দাম কমে গেলে আমাদের মানবসম্পদের মূল বাজার মধ্যপ্রাচ্যে তেজি ভাব থাকবে না। আমাদের রেমিট্যান্সও কমে যাবে। ’
এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আমাদের অর্থনীতির কিছু অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা আছে। অন্য অনেক দেশের মন্দা মোকাবেলা করার যে অভ্যন্তরীণ শক্তি আছে, সেটা বাংলাদেশের নেই। এটাই আমাদের জন্য বেশি দুশ্চিন্তার। ’
বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘ হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। এর কারণে জ্বালানি ব্যয় ও সুদের হার বেড়েছে, সরবরাহেও সমস্যা হচ্ছে। এতে আমাদের ব্যবসার খরচ অনেক বেড়ে গেছে। বিদায়ি বছরটি আমরা পোশাক খাতে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো করেছি, কিন্তু নতুন বছর খুবই চ্যালেঞ্জিং। অনেক দেশ মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার কোনো কোনো দেশে মৃদু মন্দা আরো আগে শুরু হয়ে গেছে। এর প্রভাবে আমাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ’
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘ডলার নিয়ে আমরা সংকটের মধ্যে আছি। এটা শিগগিরই কাটবে বলে মনে হয় না। নির্বাচনের বছরে এমনিতেই অর্থনীতি নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। আমাদের রাজস্ব আরো কমে যেতে পারে, তাতে বাজেট কাটছাঁট হবে। আর এটা করা মানেই আমাদের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব আসবে। তাই মন্দা মোকাবেলায় আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ’
বিশ্বব্যাংক: এদিকে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, ২০২২ সালে সরবরাহব্যবস্থায় ব্যাঘাত, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের দরবৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ, খাদ্য নিরাপত্তা, বৈশ্বিক উষ্ণতাসহ যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাতে গত ৫০ বছরে সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছে বিশ্ব। বাংলাদেশের জন্য এই সংকট আরো বেশি। উচ্চ আমদানি ব্যয়ের কারণে ২০২২ সালজুড়ে ডলার সংকট প্রধান আলোচনার বিষয়। আমদানি ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। আমদানিতে বিধি-নিষেধ আরোপের পরও চলতি হিসাবের ঘাটতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
বাংলাদেশ ব্যাংক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক আরেক পূর্বাভাসেও বলা হয়েছে, আগামী বছরে বাংলাদেশকে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এর বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে, তা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনিশ্চয়তা ও বাধা সৃষ্টি করতে পারে বলেও শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
রিজার্ভ ও ডলার সংকট: চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি থাকায় গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্য ছাড়াও শুধু টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সব আমদানি পণ্যের দাম অতিরিক্ত ২৪ শতাংশ বেড়েছে। পর্যাপ্ত গ্যাসের অভাবে দেশের শিল্প-কারখানাগুলো উৎপাদন ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।
বিনিয়োগ: অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। কর্মসংস্থানের ৯৫ শতাংশই বেসরকারি খাতে। ফলে এ খাতে নতুন কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। করোনার আগে থেকেই কর্মসংস্থানের গতি মন্থর। করোনার কারণে ২০২০ সালে তা প্রকট হয়েছে। ২০২১ ও ২০২২ সালজুড়েও তা অব্যাহত রয়েছে।
আশাবাদ: তবে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে আশার আলোও দেখছেন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব পূর্বাভাস আমাদের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। জ্বালানি ও ভোগ্য পণ্যের দাম নিয়ে অনেকেই পূর্বাভাস দিয়েছিল যে দাম আরো বাড়বে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী কমোডিটি প্রাইস ৩০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। বিশ্বের বড় অর্থনীতিবিদরা যে মন্দার কথা বলছেন, সেখানে আমি কিছুটা আশার আলোও দেখছি। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে কেনাকাটা কমেছে। কিন্তু বড় দুই বাজারে বেকারত্ব সেভাবে বাড়েনি। নভেম্বর, ডিসেম্বরে আমাদের রপ্তানির গতি কমেনি। আমাদের নতুন বাজারে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, আরো হবে। ’