Published in বণিক বার্তা on Friday, 18 December 2015
ফোর্বস: দ্য বেস্ট কান্ট্রিজ ফর বিজনেস ২০১৫
ব্যবসার পরিবেশে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে বাংলাদেশ
ইসমাইল আলী
ব্যবসার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিনিয়োগ সুরক্ষা, পরিবেশের স্থিতিশীলতা ও ব্যবসাবান্ধব কর কাঠামো। এছাড়া ঋণের সহজপ্রাপ্তি, সম্পত্তির মালিকানা লাভের প্রক্রিয়া, আধুনিক প্রযুক্তি, নতুন উদ্ভাবন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অনুপস্থিতি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতাও ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এসব মানদণ্ডের কোনোটিতেই ভালো অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। ফলে ব্যবসার জন্য বাংলাদেশ আদর্শ স্থান নয় বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী বাণিজ্য সাময়িকী ফোর্বস।
গত বুধবার প্রকাশিত ফোর্বস ম্যাগাজিনের ‘দ্য বেস্ট কান্ট্রিজ ফর বিজনেস ২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যবসার পরিবেশের দিক থেকে ১৪৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২১তম। আর দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে রয়েছে বাংলাদেশ।
১১টি উপাদানের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের ব্যবসার পরিবেশ বিশ্লেষণ করেছে ফোর্বস। এগুলো হলো— বাণিজ্য স্বাধীনতা, আর্থিক স্বাধীনতা, সম্পত্তি অর্জনের অধিকার, উদ্ভাবন, প্রযুক্তি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা, দুর্নীতি, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, করের বোঝা ও শেয়ারবাজারের অবস্থা। এ উপাদানগুলো বিশ্লেষণে ব্যবহার করা হয় বিশ্বের খ্যাতনামা কিছু গবেষণার তথ্য।
সূচকগুলো বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ফোর্বস বলছে, বিশ্বে ব্যবসা করার জন্য উত্কৃষ্ট দেশ ডেনমার্ক। শীর্ষ পাঁচে এর পর রয়েছে যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও সুইডেন। তালিকায় শেষের পাঁচটি দেশ হলো যথাক্রমে মিয়ানমার, হাইতি, লিবিয়া, গিনি ও শাদ। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা ৯১, ভারত ৯৭, ভুটান ১০১, পাকিস্তান ১০৩ ও নেপাল ১১৮তম অবস্থানে রয়েছে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি হোসেন খালেদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যবসার জন্য বাংলাদেশের পরিবেশ খুব বেশি উন্নত নয়, এটা আগে বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ ও বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ‘বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচক’-এ উঠে এসেছিল। এবার ফোর্বসের প্রতিবেদনেও একই চিত্র উঠে এসেছে। এর মূল কারণ অত্যধিক করহার, ঋণের উচ্চসুদ, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ইত্যাদি। এছাড়া বিনিয়োগকারীর সুরক্ষার অভাব, ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা ও দুর্নীতিও বাধা হিসেবে কাজ করছে।
তিনি আরো বলেন, ফোর্বসের প্রতিবেদনে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, তা হলো ব্যবসা করার জন্য আদর্শ নয়, এমন দেশগুলোর বেশির ভাগই যুদ্ধ বা দুর্যোগকবলিত। আর কিছু দেশ আফ্রিকার খুবই দরিদ্র। তবে বাংলাদেশ এ ধরনের ক্যাটাগরির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না হলেও তলানির দিকেই অবস্থান করছে। এর মূল কারণ সরকারি বিভিন্ন নীতি ও প্রতিষ্ঠান। এগুলোর পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশে উন্নতির খুব বেশি সুযোগ নেই বলেই মনে করেন তিনি।
ফোর্বসের তথ্যমতে, ‘দ্য বেস্ট কান্ট্রিজ ফর বিজনেস ২০১৫’ সূচকটি প্রণয়নে ব্যবহূত প্রথম দুই মানদণ্ড বাণিজ্য স্বাধীনতা ও আর্থিক স্বাধীনতা পরিমাপে ব্যবহার করা হয়েছে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ইনডেক্স অব ইকোনমিক ফ্রিডম ২০১৫-এর তথ্য। এটি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। দুই মানদণ্ডেই বাংলাদেশের অবস্থান বেশ দুর্বল। বাণিজ্য স্বাধীনতায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪ দেশের মধ্যে ১৩৭ ও আর্থিক স্বাধীনতায় ১৩১তম। মানদণ্ড দুটির আওতায় আইনের শাসন, সীমাবদ্ধ সরকারি কার্যক্রম, নিয়ন্ত্রণমূলক দক্ষতা ও উন্মুক্ত বাজার বিবেচনা করা হয়েছে। এগুলোর কোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ খুব বেশি শক্তিশালী অবস্থানে নেই।
বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস ২০১৬-এর তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে করের বোঝা, বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিমাপে। এ তিন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ৭০, ৮০ ও ৯৪তম। এক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়েছে ব্যবসায় শুরু, অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি, বিদ্যুতের প্রাপ্যতা, সম্পত্তি নিবন্ধন, ঋণ প্রাপ্যতা, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর পরিশোধ, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তির বাস্তবায়ন ও দেউলিয়াত্ব।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করে আসা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ফ্রিডম হাউজের তথ্যের ভিত্তিতে পরিমাপ করা হয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪ দেশের মধ্যে ৯২তম। এজন্য বিবেচিত রাজনৈতিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নাগরিকরা আংশিক স্বাধীনতা ভোগ করে বলে মনে করে ফ্রিডম হাউজ।
উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অবস্থান পরিমাপে ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ‘বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদন ২০১৫-১৬’। উভয় মানদণ্ডে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৭তম। এক্ষেত্রে উদ্ভাবনী ক্ষমতা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মান, গবেষণা ও উন্নয়নে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ, গবেষণা ও উন্নয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সংযোগ, আধুনিক প্রযুক্তিপণ্য ক্রয়ে সরকারি ব্যয়, বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী প্রাপ্যতা এবং মেধাস্বত্ব নিবন্ধনের হার বিবেচনা করা হয়েছে।
দুর্নীতির মাত্রা পরিমাপে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘দুর্নীতি ধারণা সূচক ২০১৪’ ও সম্পদ অর্জনের অধিকার পরিমাপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রপার্টি রাইটস অ্যালায়েন্সের ‘দ্য প্রপার্টি রাইটস ইনডেক্স ২০১৫’-এর তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। এ দুই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪ দেশের মধ্যে যথাক্রমে ১২৯ ও ১২৭তম। আর শেয়ারবাজারের অবস্থা পর্যালোচনায় ব্যবহার করা হয়েছে সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গের গত ১২ মাসের তথ্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৩তম।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ব্যবসার পরিবেশ-সংক্রান্ত কিছু মানদণ্ডে বাংলাদেশ ভালো অবস্থায় থাকলেও মৌলিক বিষয়গুলোয় দুর্বলতা রয়ে গেছে। ফলে গত দুই দশক আগে বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে যে বড় ধরনের আশা সঞ্চার হয়েছিল, সে তুলনায় অগ্রগতি খুবই সামান্য। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় যখন ৬-৭ বিলিয়ন ডলার বিদেশী বিনিয়োগ যাচ্ছে, তখন আমাদের দেশে ২ বিলিয়ন ডলারও অর্জন হয়নি। অর্থাৎ প্রতিযোগিতার দিক থেকে আমরা এখন হাঁটছি, অন্যরা তখন দৌড়াচ্ছে। আর এ পিছিয়ে পড়া রোধে সরকারের উচিত বিভিন্ন মৌলিক খাতে দ্রুত সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়া। না হলে ব্যবসার পরিবেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।