বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলার খবর এখন সর্বত্র। বিভিন্ন সময়েই একের পর এক নতুন নতুন দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর প্রকাশ পাচ্ছে। এতে করে যেমন দেশের সাধারণ জনগণ আস্থা হারাচ্ছে তেমনি প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে, নষ্ট হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। এসব নিয়ে সিপিডি সাক্ষাৎকার-এ বলেছেন ড. ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি।
বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত একধরণের নাজুক পরিস্থিতি পার করছে। এখানে আপনি কী ধরণের বিশৃঙ্খলা দেখতে পাচ্ছেন?
দেশের ব্যাংকিং খাতের মধ্যে, রাষ্ট্রায়ত্ত খাত ও ব্যক্তিখাত, উভয়খাতেই বিশৃঙ্খলা এবং স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোতে বড় বড় অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে, নামে-বেনামে বিভিন্ন ধরনের ঋণ দেয়া হচ্ছে এবং এসব ঋণ কু-ঋণে পরিণত হচ্ছে। যার ফলে ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে পড়ে যাচ্ছে। এই মূলধন ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে গত দশ বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা মূলধন পুনর্ভরণ করেছে। এখন আবার সরকারি ব্যাংকগুলো আরও ২০ হাজার কোটি টাকা চাচ্ছে। এই যে টাকাটা দেওয়া হচ্ছে- এটা কাদের টাকা? এটাতো বাংলাদেশের জনগণের করের টাকা। এই করের টাকার বিনিময়ে জনগণ সরকারের কাছ থেকে ভালো সেবা পাওয়ার আশা করে। রাস্তা-ঘাট, বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এই ধরনের সেবা সরকারের দেওয়ার কথা সেগুলোই জনগণ আশা করে কষ্টার্জিত অর্থের বিনিময়ে। কিন্তু এই করের টাকা দিয়ে উল্টো দুর্নীতিবাজদেরকেই সাহায্য করছে সরকার। বছরের পর বছর যদি মূলধন দিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোকে জিইয়ে রাখার এই প্রচেষ্টা চলে তাহলে এই ধরণের ব্যাংক থাকার কী দরকার? এই ধরণের বোঝা টেনে নেওয়ার দরকার নেই।
আবার এখন দেখছি সরকারি ব্যাংকের মত বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও নানান ধরণের অনিয়ম দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা পঞ্চাশের উপরে। তার মধ্যে প্রায় বিশটি ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো নয়। এখন সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়, আগে যেটা ছিল ২৫ শতাংশ। ফারমার্স ব্যাংক তার পুরো মূলধন নষ্ট করে ফেলেছে। এ ধরণের খারাপ ব্যাংকগুলোকে সাহায্য করার জন্য সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ রাখার নির্দেশ বরং তাদের খারাপ কাজকে উৎসাহিত করবে। এখানে ভালো ব্যাংক এবং খারাপ ব্যাংকগুলোকে একই কাতারে বিবেচনা করে সবাইকে একই ধরণের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। এটা এক ধরণের অন্যায় হচ্ছে। খারাপ ব্যাংকগুলো এখন মনে করবে, ব্যাংক খারাপ চললে বা যে কোন ধরণের বিপদে পড়লে সরকার তো এগিয়ে আসবেই। এতে করে, কু-ঋণ কিংবা অর্থ আত্মসাৎ এর মত ঘটনাগুলো থেকে বেরিয়ে আসার তাগাদা থাকবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চুরি হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাত, বেনামী/খেলাপী ঋণসহ নানাধরণের অনিয়ম চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এসব অনিয়ম কেনো হচ্ছে বলে মনে করেন?
এখানে কয়েকটা বিষয় কাজ করছে। ব্যাংকগুলোর ভিতরে সুশাসন ও সুপারভিশন বা মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। আরেকটা হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ঋণ দেয়া। এই ধরণের ঋণের কোন যাচাই-বাছাই করা হয় না। ঋণ যেখানে দেয়া হবে সেটা কোন ভায়েবল প্রজেক্ট কিনা, কিংবা যে ঋণ নিচ্ছে তার কোন ভালো ট্র্যাক রেকর্ড আছে কিনা সেগুলোকে বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। যেহেতু রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ঋণগুলো দেয়া হচ্ছে সুতরাং ব্যাংক কর্মকর্তারা যখন ঋণটা আদায় করতে যায় তখন তাদেরকে সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। এই ঋণগুলোই কু-ঋণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, যারা ঋণ নিয়ে ঋণ ফেরত দিচ্ছে না এবং জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে, যেমন সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির মত ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে, তাদের শাস্তি হচ্ছেই না। তারা কোন না কোনভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় অন্যরা এ ধরণের কাজে উৎসাহ পেয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব অনিয়ম রোধ করে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা আনয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে কী?
অর্থ মন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে সম্পর্কটা যেমন হওয়া উচিত তেমনটা নেই। সেখানে এক ধরণের ফারাক রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি করবে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করবে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ভূমিকা পালন করবে এবং, সর্বোপরি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকের ব্যাংকার হিসেবে কাজ করবে। এসকল কাজে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা ক্রমশঃ দুর্বল হচ্ছে। এখানে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে। যার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাঁর ভূমিকাগুলো সুচারুভাবে পালন করতে পারছে না। যেমন কিছুদিন আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে সিআরআর বা ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও, অর্থাৎ, ব্যাংকগুলো তাদের তলবি এবং মেয়াদী দায়ের যে অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখে, সেই সিআরআর ৬.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫.৫ শতাংশ করা হয়েছে। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক করেনি, এটা অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাংকগুলোর মালিকের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধুমাত্র একটা সার্কুলার জারি করেছে। কিন্তু, সবেমাত্র জানুয়ারি মাসেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি করেছিল জানুয়ারি থেকে জুন ২০১৮ পর্যন্ত ছয় মাসের জন্য। এই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সাথে এই সিআরআর কমানোর উদ্যোগ সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে।
বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতে উন্নয়শীল দেশের কাতারে যাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায়, ব্যাংকিং খাত ঝুঁকির মুখে থাকলে দেশের উন্নয়নে কী প্রভাব পড়বে?
একটা দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যাংকিং খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যাংকিং খাতকে অর্থনীতির চালিকাশক্তি বলা যায়। বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, যেমন, রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণ ইত্যাদি অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিংবা সেবা খাতের উন্নয়ন কাজসমূহের অর্থায়ন ব্যাংকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু, দুর্বল আর্থিক খাত দিয়ে তা সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয় যদি এখানে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন না করতে পারে, তাহলে একদিকে যেমন আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা একটা নৈরাজ্যের মধ্যে পড়বে অন্যদিকে আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্থ হবে। যখনই আমরা উন্নয়নশীল দেশ কিংবা উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে যাবো, তখন কিন্তু আমাদের অবকাঠামোগত খাত যেমন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, সেতু ইত্যাদিতে আরও বেশি করে বিনিয়োগ করতে হবে। উন্নয়নের জন্য আরও বেশি করে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে হবে। সেটার জন্য যে ধরণের ব্যাংকিং খাত থাকা দরকার সেটা আমাদের নেই। ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, কিন্তু ব্যাংকের গুনগত মান বাড়েনি। একটা শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায়, সেটা আমাদের এখন নেই।
ব্যাংকিং খাতের বর্তমান নাজুক অবস্থা থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
সুনির্দিষ্ট পরামর্শ হচ্ছে, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার। দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপকভাবে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বত্র বাড়াতে হবে। এর ফলে, যেকোন ধরণের অব্যবস্থাপনা হলে সেটা দ্রুত ধরা পড়ে। সেই সাথে, ব্যাংকগুলোকে মানব সম্পদ উন্নয়ন করতে হবে। তাছাড়া, বিশেষভাবে যেটি করণীয় তা হল, ব্যাংকিং খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। ব্যাংকের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় বাইরের প্রভাব বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতি ও অর্থআত্মসাৎকারী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা।
—————-
সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন সাজ্জাদ মাহমুদ শুভ, শ্রুতিলিখনে হাসিবুর রহমান খান