Published in প্রথম আলো on Sunday, 22 July 2018
সুদহারের ‘নয়-ছয়ে’ ব্যাংকে বিশৃঙ্খলা
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আইসিএবির সম্মেলন
ব্যাংকাররা বললেন, সুদ কমলে ঋণ বিতরণ আরও বাড়বে। কিন্তু সেই টাকা আসবে কোথা থেকে।
ঋণ ও আমানতের সুদের হার ‘নয়-ছয়ে’ বেঁধে দেওয়ায় দেশের ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। এ নির্দেশনা বর্তমান বাজার পরিস্থিতির বিপরীত। নির্দেশনায় সুনির্দিষ্ট করে কোন খাতে কত সুদের হার হবে, তা বলা হয়নি। ফলে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
দেশের আর্থিক খাত নিয়ে সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদদের সংগঠন ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) আয়োজিত সদস্য সম্মেলনে বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনে গতকাল শনিবার বিকেলে সভাটি হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
ব্যাংক খাত নিয়ে নানা আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংক একটি দেশের অর্থনীতির রক্তসঞ্চালক। বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি ব্যাংকনির্ভর। তাই যেকোনো ভালো নেতৃত্ব ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো সমাধানে নজর দেবে। তিনি বলেন, সময় ও দায়িত্ব বেঁধে দিয়ে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা দরকার। নইলে কাউকে না কাউকে এর দায় বহন করতে হবে। এ সময়ে তিনি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে জনগণের করের অর্থ জোগান দেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, লাভের বিরাষ্ট্রীয়করণ, ক্ষতির রাষ্ট্রীকরণের মাধ্যমে দেশ চলতে পারে না।
ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকারও সমালোচনা করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের যেই স্বায়ত্তশাসন রয়েছে, সেই ক্ষমতার প্রয়োগে সংস্থাটি অনেক ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখিয়েছে। যখন এক পরিবার থেকে পরিচালকের সংখ্যা কমানোর দরকার ছিল, তখন তা বেড়েছে। পরিচালকদের মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে। খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে যখন কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া উচিত ছিল না, তখন তা পুনর্গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি বলব, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আসলেই ব্যর্থ হয়েছে।’
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, গত বছর ঋণ অনেক বেশি বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় আমানত বাড়েনি। এটা ব্যাংকারদেরও ব্যর্থতা যে, তারা আমানত সংগ্রহ করতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট আছে, সেটা আমি বলব না। আমার মনে হয়, বণ্টনের সমস্যা আছে। সরকারি ব্যাংকে ঋণ-আমানত অনুপাত ৪০-৫০ শতাংশ।’
ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) গত মাসে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ ও আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়। এ নিয়ে কথা বলেন প্রাইম ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, সুদের হার নয়-ছয় করার নির্দেশনাটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে আসেনি। এতে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি যে, কোন সুদের হার কত শতাংশ হবে। এটি ব্যাংক খাতে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
অনুষ্ঠানে ব্র্যাক ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল কাদের জোয়ারদার একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ব্যাংক যখন আমানতের বিপরীতে সুদ দিচ্ছে ৪-৫ শতাংশ, তখন সঞ্চয়পত্রে তা ১১ শতাংশের বেশি। মাথায় বুদ্ধি থাকলে যে কেউ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের দিকে যাবে। তিনি বলেন, ব্যাংকে তারল্যসংকটের এখনো সমাধান হয়নি। সুদের হার নয়-ছয়ে বেঁধে দেওয়া শিল্পের জন্য ভালো। কিন্তু ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতির বিপরীত।
আবদুল কাদের জোয়ারদার আরও বলেন, সুদহার কমলে ব্যাংকের ঋণের চাহিদা আরও বাড়বে। কিন্তু বাড়তি ঋণের জন্য টাকা আসবে কোথা থেকে? ঋণ-আমানতের বেঁধে দেওয়া সীমা আগামী ৯ মাসের মধ্যে ব্যাংকগুলো কীভাবে পূরণ করবে।
শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে আইসিএবির সভাপতি দেওয়ান নুরুল ইসলাম বলেন, উদ্বৃত্ত তারল্য থেকে ব্যাংক খাতে হঠাৎ তারল্যসংকট তৈরি হলো। এতে প্রশ্ন উঠেছে যে, টাকা আসলে কোথায় গেছে।
দ্য ডেইলি স্টার-এর বাণিজ্য সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে এত কেলেঙ্কারির পরও সেখানে মানুষ টাকা জমা রাখছে বেশি। বেসরকারি ব্যাংকে তুলনামূলক ভালো ব্যবস্থাপনার পরও মানুষের আস্থা কম। কিছু বেসরকারি ব্যাংকের অব্যবস্থাপনার কারণে সবাইকে মাশুল দিতে হচ্ছে।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আইসিএবির সহসভাপতি মাহমুদুল হাসান। এতে সিটি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমানও বক্তব্য দেন।