Originally posted in বাংলা ট্রিবিউন on 7 May 2025
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে কাঁপছে দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শঙ্কার মেঘ
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করেছে। সীমান্তে পূর্ণমাত্রার সংঘাত শুরু হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ঢাকার শেয়ার বাজারে—বুধবার (৭ মে) দিনের শুরুতেই বড় ধরনের দরপতন দেখা গেছে। কিন্তু শুধু পুঁজিবাজারেই নয়, এই সংঘাতের ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির নানা খাতে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই দেশের এই সংঘাত যুদ্ধে গড়ালে এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্স ও কূটনৈতিক ভারসাম্যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই মুহূর্তে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের কৌশলগত পরিকল্পনা জরুরি। যুদ্ধের ফলে যে বহুমুখী চাপ আসবে, তা মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নিতে না পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপে পড়বে।
ঝুঁকিতে বাণিজ্য ও রফতানি
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা থাকলেও বাংলাদেশের সঙ্গে উভয় দেশেরই বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আমদানিকারক দেশ ভারত। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সীমান্ত বাণিজ্য, ট্রানজিট এবং দক্ষিণ এশিয়ার নৌ-রুটে পণ্য পরিবহন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, ওষুধ ও হালকা প্রকৌশল পণ্যের রফতানিতে বিলম্ব ও অর্ডার স্থগিত হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বিদেশি বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা
দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়লে এই অঞ্চলকে ‘হাই রিস্ক জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এতে বিদ্যমান ও সম্ভাব্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে যেতে পারে। অবকাঠামো, টেক্সটাইল, তথ্যপ্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে চলমান অনেক প্রকল্প থমকে যেতে পারে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্ভাব্য অভিঘাত
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একাধিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পণ্য পরিবহন, রফতানি আদেশ এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে।
বিশেষত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হওয়ায় যেকোনও সামরিক উত্তেজনা সরাসরি রফতানি ও আমদানির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। পাশাপাশি, ভারত যদি তাদের সামরিক ব্যয় বাড়াতে বাধ্য হয়, তবে অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন প্রকল্প ও আঞ্চলিক সহযোগিতা কার্যক্রমে গুরুত্ব কমে যেতে পারে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান যুদ্ধাবস্থা বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বড় শঙ্কার কারণ না হলেও যথেষ্ট উদ্বেগের। দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে উত্তেজনা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার। বাংলাদেশের পণ্য রফতানির একটি বড় অংশ ভারতের বাজারে যায় শুল্কমুক্ত সুবিধায়। সামরিক খরচ বৃদ্ধি ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে, যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের রফতানিতে পড়বে।’
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুধু ওই দুই দেশেই নয়, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেছেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
বুধবার (৭ মে) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আমদানি-রফতানির পথ ব্যাহত হবে। আমাদের সুতা ও কাপড়সহ বিভিন্ন কাঁচামাল বহির্বিশ্ব থেকে আমদানি করতে হয়। যুদ্ধের কারণে এ সরবরাহ চেইনে বিঘ্ন ঘটবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে তৈরি পোশাক শিল্পে।’ তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ কোনও দেশের জন্যই শুভ নয়। যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়লে আমাদের মতো সীমান্তবর্তী দেশগুলোও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
নিরাপদ বাণিজ্য কৌশল জরুরি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে বাণিজ্যিক বিকল্প বাজারের সন্ধান, বহুমুখীকরণ এবং কূটনৈতিক প্রস্তুতি জোরদার করতে হবে। এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের চাহিদা ও দামের ওঠানামার ওপর নজর রেখে রফতানিনির্ভর শিল্পে সুশৃঙ্খল কৌশল গ্রহণের সময় এসেছে।
শেয়ার বাজারে বড় ধস
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে দেশের শেয়ার বাজারে বুধবার (৭ মে) বড় ধরনের ধস নেমেছে। দিন শেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৪৯ পয়েন্ট বা প্রায় ৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮০২ পয়েন্টে— যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থান।
একদিনে এই পতন ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবরের পর সর্বোচ্চ। বাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, যার ফলে ব্যাপক বিক্রির চাপ সৃষ্টি হয়। বুধবার মাত্র ৯টি কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে, কমেছে ৩৮৫টির, এবং ৫টি কোম্পানির দর অপরিবর্তিত ছিল।
মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতি বাজারে মারাত্মক অস্থিরতা তৈরি করেছে। ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করেছে। অনেকেই নিরাপত্তার কথা ভেবে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।’
তিনি জানান, বুধবার সকালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) থেকে একটি চিঠি এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘আগামী ১১ মে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে অর্থ উপদেষ্টা, এফআইডি সচিব ও বিএসইসি চেয়ারম্যান উপস্থিত থাকবেন। বৈঠকে বাজার স্থিতিশীল করতে করণীয় নিয়ে আলোচনা হবে’ বলে জানানো হয়েছে।
তবে এই ইতিবাচক বার্তা তাৎক্ষণিকভাবে বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেনি।
জ্বালানি সংকট ও মূল্যস্ফীতি
সম্ভাব্য যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানিকৃত অপরিশোধিত তেল ও এলএনজির দাম বাড়লে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়বে। এ থেকে শিল্প খাত ও ভোক্তা পর্যায়ে ব্যাপক মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি তৈরি হবে।
বিশেষ করে পরিবহন খরচ ও কৃষি উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে খাদ্যদ্রব্যের দামও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে।
রেমিট্যান্স প্রবাহে শঙ্কা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যার প্রবাসী কর্মী রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায়। সেখানকার রাজনীতিও ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনার ফলে প্রভাবিত হতে পারে। যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে শ্রমবাজারে স্থবিরতা দেখা দিতে পারে, ফলে রেমিট্যান্স আয় কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
কূটনৈতিক চাপে পড়তে পারে বাংলাদেশ
ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে সতর্ক অবস্থান নিতে হতে পারে, যাতে কোনও পক্ষকে খুশি করতে গিয়ে অন্য পক্ষের বিরাগভাজন না হতে হয়। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করাটাই প্রধান কৌশল হতে পারে।