Published in যুগান্তর on Thursday, 25 May 2017
দেশের বাজেট কাঠামো এখন আর শুধু অর্থনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অর্থনীতি ও নৈতিকতা। এ ধরনের অর্থনীতিতে ক্ষমতাসীন দল, শক্তিশালী মহল, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী কাজ করে। এজন্য তাদের আঘাত দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করাকে চ্যালেঞ্জ মনে করে সরকার। যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন। তার মতে, অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য ৫টি সংস্কার জরুরি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ব্যাংকিং খাত, পুঁজিবাজার, স্থানীয় প্রশাসন, কৃষি খাত ও জনপ্রশাসন। এছাড়াও বহুল আলোচিত ভ্যাট আইন পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে আরও প্রস্তুতি দরকার বলে মনে করেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতিমান এ অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনির হোসেন
প্রশ্ন : নির্বাচনের আগে সরকারের পূর্ণাঙ্গ বাজেটে কী কী চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে?
উত্তর : তথাকথিত নির্বাচনী বাজেটের প্রভাব হয়তো এবার থাকবে। তবে সামনের বছরের প্রতিশ্রুতি আরও বেশি নির্বাচনমুখী হবে। আমার দৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য প্রতিটি বাজেটই হওয়া উচিত নির্বাচনী। কারণ এক বছরে সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা যায় না। ধারাবাহিকভাবে করতে হয়। ফলে শেষ সময়ে এসে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের আকাক্সক্ষা থাকতে পারে। কিন্তু তা আর বাস্তবায়ন করা যায় না। কয়েক বছর ধরে বাজেটের চ্যালেঞ্জগুলো একই রকম। প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সম্পদ সমাবেশ। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়াতে রাজস্ব বৃদ্ধির বিশাল চাপ রয়েছে। এবারের বিশেষ পরিস্থিতি হল নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন। এতে কী হারে ভ্যাট দিতে হবে, তার ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করছে।
প্রশ্ন : দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অর্থনীতিতে আলোচিত ও সমালোচিত বিষয় ভ্যাট আইন। এক্ষেত্রে সরকারের যৌক্তিক অবস্থান কী হওয়া উচিত?
উত্তর : ভ্যাট আইন সম্পূর্ণভাবে কার্যকরের জন্য প্রস্তুতি এখনও শেষ হয়নি। আমি মনে করি, এজন্য সরকারের আরও প্রস্তুতি দরকার। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্যও প্রস্তুতির প্রয়োজন। তবে এ ভ্যাট আইন আধুনিক। আমরা নীতিগত অভিন্ন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের পক্ষে। কিন্তু সেজন্য আরও প্রস্তুতি লাগবে। এজন্য সিপিডির পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিল প্রাথমিকভাবে একটু কম হারে প্রয়োগ করা। তিনি বলেন, রাজস্ব খাতে একটি প্রবণতা লক্ষণীয়। যারা কর দেন, প্রতিবছর তাদের ওপর চাপ বাড়ে। কিন্তু সেই তুলনায় নতুন করদাতা আসে না। সিপিডির পক্ষ থেকে বিকল্প একটি প্রস্তাব ছিল। ভ্যাটের কারণে আগামী বছর মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তাই ন্যূনতম করদাতাদের করের হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা উচিত।
প্রশ্ন : বাজেট থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোকে মূলধনের জোগান দেয়া হয়। এটা কতটা যৌক্তিক?
উত্তর : মানুষ আশা করে করের অর্থে তার জীবনযাত্রার মান বাড়বে। সরকার এই টাকা নিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ ও আইনশৃঙ্খলায় খরচ করবে। এতে সে আরও স্বাচ্ছন্দ্যভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। কিন্তু ঋণের নামে এই করের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। সেই ঋণ আদায় না করে বাজেট থেকে আবারও মূলধন জোগান দেয়া হচ্ছে। এটি নৈতিকভাবে অন্যায়। এটি অর্থনীতির কোনো নীতিমালার মধ্যে পড়ে না।
প্রশ্ন : সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ের গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
উত্তর : বাংলাদেশ সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে যে সাফল্য দেখিয়েছে, সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ওই পরিমাণ দক্ষতা দেখাতে পারেনি। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অর্থ ব্যয়ের হার যেভাবে কমছে, তার গুণগতমানের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রশ্ন থেকে যাবে। এডিপিতে কয়েকটি সমস্যা সুনির্দিষ্ট। তা হল টাকা খরচ করা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত যতটুকু খরচ হচ্ছে, তারও গুণগতমান ভালো নয়। তৃতীয়ত পদ্মাসেতুর মতো তথাকথিত কয়েকটি বড় প্রকল্পে টাকা দিয়ে রেখেছে, কিন্তু খরচ না করতে পারায় ফেরত যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। এটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ায়।
প্রশ্ন : প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক সহায়তা পাইপ লাইনে আটকে আছে, এর কারণ কী?
উত্তর : বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য অনেক রেয়াতি সুদে এমনকি বিনা সুদে বিদেশ থেকে অনুদানের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেসব বিদেশি সাহায্য ব্যবহার করতে পারছে না সরকার। বিপরীতে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে। এটি দেশের রাজস্ব আয় ব্যয় ব্যবস্থাপনার মধ্যে গলার ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে রাজস্ব ব্যয়ের এক চতুর্থাংশ অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যবহার হচ্ছে। এটি রাজস্ব ব্যবস্থাপনার বড় ধরনের ত্রুটি।
প্রশ্ন : এ সমস্যা বহুদিনের। এখান থেকে উত্তরণের উপায় কী?
উত্তর : যে কোনো সরকার বাজেট তৈরির সময় একটি আয়-ব্যয় কাঠামো দেয়। তখন থেকে অগ্রাধিকার ইস্যুগুলোকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সঙ্গে মিলিয়ে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। আর এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে অব্যাহতভাবে নীতি সংস্কারের মাধ্যমে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার ২০১২-১৩ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারে দম হারিয়ে ফেলেছে। এর ফলে ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজার বিকলাঙ্গ হয়েছে। এটি শক্তিশালী বিনিয়োগের দুটি পায়ের মতো। কিন্তু বর্তমানে এ দুই পায়ে গ্যাংরিনের মতো পচন ধরেছে। প্রশ্ন হল, সমস্যা উত্তরণে পা কেটে ফেলতে হবে, নাকি চিকিৎসা শেষে আবারও দৌড়ানো শুরু করব আমরা।
আরেকটি বিষয় হল, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা। এছাড়াও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি কমিয়ে কৃষককে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা বেতন বাড়ানো হলেও জনপ্রশাসনে কোনো সংস্কার নেই।
প্রশ্ন : দীর্ঘদিন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের লুটপাট চলছে। ব্যাংকের পরিচালকরাই এর সঙ্গে জড়িত। ঠিক এ সময়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়া অনুমোদন করে পরিচালকদের ক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়েছে।
উত্তর : এ আইনটি নিয়ে সরকার সম্পূর্ণ উল্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ যে কমিটির ভিত্তিতে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়েছে, ২০০৩ সালে ওই কমিটিতে আমি ছিলাম। সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে কমিটি হয়েছিল। সুপারিশে আমরা বলেছিলাম, শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি ব্যাংকেও সুশাসন আনার জন্য পরিবারের ভূমিকাকে সীমিত করে অন্য শেয়ারহোল্ডারদের কণ্ঠ শক্তিশালী করতে হবে। এজন্য আমরা স্বাধীন পরিচালকের কথা বলেছিলাম। যদিও স্বাধীন পরিচালক হিসেবে এখনও যাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তারা সবাই স্বাধীন না। যে কারণে ব্যাংকের আজকের এই পরিস্থিতি। তার সুরাহা না করে ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোকে আরও দুর্যোগের মুখে ঠেলে দেয়া হল। অর্থাৎ সরকার একদিকে সরকারি ব্যাংকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার জন্য, লুটপাটের জন্য টাকা ফেরত নেয় না। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও পরিবারের আধিপত্যের মধ্য দিয়ে ব্যবস্থাপনা নীতির খেলাপ করবে। এটি দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, এ রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ক্ষমতাসীন, শক্তিশালী, প্রভাবশালী অর্থনৈতিক ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় শক্তি কাজ করে। ফলে তাদের বিপক্ষে গিয়ে, তাদের আঘাত দিয়ে নির্বাচনী বাজেট দিতে চাইবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এ আঘাত যদি দেয়া হতো, তবে সাধারণ মানুষ সরকারের পক্ষে আরও বেশি আসত। অর্থাৎ নির্বাচনের চিন্তা করে সরকার যেটা করে, আসলে তার উল্টো ফল পাওয়া যায়। জনগণ এসব দেখছে। কারণ বাংলাদেশের জনগণ খুব সচেতন।
প্রশ্ন : সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচারের ইস্যু বারবার সামনে আসছে। অর্থ পাচাররোধে বাজেটে কী ধরনের সংস্কার পদক্ষেপ থাকা উচিত।
উত্তর : যে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যায়, তার চারগুণ টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। আমরা জানি, কার নামে বিদেশে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাড়ি আছে। কে বিদেশে বিনিয়োগ করছে, ওই দেশের নাগরিকত্ব নিচ্ছে। গরিব মানুষের করের টাকা বিদেশে চলে যাবে, এটা কোন ধরনের নৈতিকতা। বাজেট শুধু অর্থনীতির বিষয়ে সীমাবদ্ধ নেই। রাজনৈতিক অর্থনীতি ও রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রশ্ন এখন বাজেটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
প্রশ্ন : দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হিসাব নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে।
উত্তর : এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়- সেবা খাতের বাইরে শিল্প ও কৃষি খাতে কী পরিমাণ প্রবৃদ্ধি আসছে। বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে একটি সেবা খাতনির্ভর অর্থনীতি হচ্ছে। অর্থাৎ শিল্পায়নের আগেই শিল্প থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিষয় হল, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কী পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। প্রবৃদ্ধি মানে হল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, মানুষের আয় বাড়বে। সিপিডি দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছে, দেশে যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, ওই হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না।
প্রশ্ন : দেশের অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠিত একটি বিষয় হল, বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না। গত কয়েক বছর পর্যন্ত এভাবে মন্দা চলছে। বিনিয়োগ বাড়াতে আপনার সুপারিশ কী?
উত্তর : সরকারি বিনিয়োগ হলেও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ নেই। এর কারণ হল, কোথাও একটি অনিশ্চয়তা বোধ আছে। এ অনিশ্চয়তা থেকেই উদ্যোক্তারা বিদেশে বিনিয়োগ করতে চায়। এক্ষেত্রে আফ্রিকাকে তারা বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন। এটা একটি বড় ধরনের সিগন্যাল (সংকেত)।