‘মসৃণ রূপান্তরে’র জন্য এখন যা করণীয়: ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Published in সমকাল on Saturday, 17 March 2018

বিশেষ লেখা

‘মসৃণ রূপান্তরে’র জন্য এখন যা করণীয়

-ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) শ্রেণি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হবে সমসাময়িক উন্নয়ন অভিজ্ঞতার একটি অনন্য সাফল্য। অনাকাঙ্ক্ষিত বড় ধরনের বাধা না এলে ২০২৪ সাল নাগাদ বাংলাদেশ এলডিসি তালিকা থেকে বেরিয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা করা যায়। এ ক্ষেত্রে এলডিসি পর্যায় থেকে যেসব দেশের উত্তরণ ঘটেছে এবং যেসব দেশ উত্তরণ পর্যায়ে আছে তাদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয়। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ এলডিসি শ্রেণি প্রতিষ্ঠা করে। এ পর্যন্ত ৫২টি দেশ এ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, মালদ্বীপ, সামোয়া ও ইকুয়েটোরাল গিনি- এই ৫টি দেশ এলডিসি তালিকা থেকে বের হয়েছে। প্রত্যেকটি দেশের জনসংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। তাদের অর্থনীতির আকারও ছোট। বতসোয়ানা ভূমিবেষ্টিত একটি ছোট দেশ। ইকুয়েটোরাল গিনিও তেল রফতানিকারক ছোট দেশ। বাকি তিনটি মূলত ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র। এই বিবেচনায় বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যা, অর্থনীতির আকার, রফতানির পরিমাণ ও দারিদ্র্য বিমোচন বিবেচনায় বাংলাদেশই প্রথম বড় দেশ, যার এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণ হতে যাচ্ছে। আবার বাংলাদেশই স্বল্পোন্নত প্রথম দেশগুলোর একটি, যা উত্তরণের তিনটি মানদণ্ডই (মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক) পূরণ করতে যাচ্ছে।

২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১০টি দেশ এলডিসি তালিকা থেকে বের হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এর মধ্যে ইকুয়েটোরাল গিনি ২০১৭ সালে বের হয়েছে। অ্যাঙ্গোলা ও ভানুয়াতুকে উত্তরণের সুপারিশ করা হয়েছে। কিরবিতি, পূর্ব তিমুর ও টুভালু সুপারিশের জন্য পর্যালোচনাধীন। ভুটান, নেপাল, সাও তোমে ও প্রিনসিপে, এবং সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ২০১৫ সালে প্রথমবার উত্তরণের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়েছে। এসব দেশ বিশেষত নেপাল ও ভুটানের আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন নির্দেশকের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা এ ক্ষেত্রে অন্তর্দৃষ্টিমূলক হতে পারে।

সহযাত্রীদের সঙ্গে তুলনা: গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সহযাত্রী দেশগুলোর চেয়ে বেশি। এলডিসিগুলোর মধ্যে মোট বিদেশি উন্নয়ন সহায়তার দিক থেকে অন্যতম বড় গ্রহীতা হওয়া সত্ত্বেও এর প্রতি বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা তুলনামূলক কম। এশিয়াতে যারা এলডিসি থেকে বের হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে তাদের তুলনায় বাংলাদেশের সহায়তা-নির্ভরতা কমছে। ফলে এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে উন্নয়ন সহায়তা কমার সম্ভাব্য প্রভাব বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যৎসামান্য। আবার পরিমাণ বিচারে বাংলাদেশ অন্যতম রেমিট্যান্স গ্রহীতা। জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান বিবেচনায় বাংলাদেশ নেপালের চেয়ে পিছিয়ে। তবে, অন্যান্য সহযাত্রীর তুলনায় এগিয়ে। অন্যদিকে এসব দেশের অধিকাংশের তুলনায় বাংলাদেশের বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ কম। বিশ্বের সর্বনিম্ন কর-জিডিপি অনুপাতের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গড় কর-জিডিপি অনুপাত ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। এ সময়ে ভুটানে এ হার ১১ শতাংশ, নেপালে ১২ শতাংশ, আফ্রিকান এলডিসিগুলোর ১৫ শতাংশ এবং দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর ৩৯ শতাংশ।

অর্থনীতিতে মোট মূল্য সংযোজন এবং কর্মসংস্থানে অবদান বিবেচনায় বাংলাদেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবস্থা অন্যদের তুলনায় শক্তিশালী। ২০০৫-০৯ এবং ২০১০-১৪ সময়কালে নেপালে মোট মূল্য সংযোজন ও কর্মসংস্থানে উৎপাদন ও সেবা খাতের অবদান কমে গেছে। তেল রফতানিকারক আফ্রিকান সহযাত্রীদেরও ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবা খাতের অবস্থা দুর্বল। তবে বাংলাদেশ শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা সহযাত্রীদের তুলনায় পিছিয়ে এবং অন্যদের তুলনায় এ বিষয়ে অগ্রগতিও কম। রফতানি বহুমুখীকরণে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। এলডিসি তালিকা থেকে বের হলে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা হারাবে। এ জন্য বাংলাদেশের জন্য রফতানি বহুমুখীকরণ অপরিহার্য।

পূর্বসুরিদের সঙ্গে তুলনা: বাংলাদেশের গত ৫ বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কেপ ভার্দের উত্তরণপূর্ব অবস্থার মতো। তবে বতসোয়ানা ও মালদ্বীপের প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ছিল। বাংলাদেশ অবশ্য চলতি হিসাব ও পণ্য রফতানিতে অন্যদের চেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে। পিছিয়ে আছে বিদেশি বিনিয়োগ ও কর আহরণে। কাঠামোগত রূপান্তরের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বতসোয়ানা ছাড়া বাকিদের উত্তরণের পরে অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন ও কর্মসংস্থানে কৃষির অবদান কমে যায়। যদিও অবদান কমছে, তারপরও অন্যান্য সাবেক এলডিসির উত্তরণ-পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় বাংলাদেশের কৃষিনির্ভরতা তুলনামূলক বেশি। এর বিপরীতে মূল্য সংযোজন ও কর্মসংস্থানে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদানের দিক থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। আবার বিশ্ববাণিজ্যে রফতানির অংশ বিবেচনায় পূর্বসূরিদের উত্তরণ-পূর্ববর্তী এমনকি পরবর্তী অবস্থার চেয়েও বাংলাদেশের অবস্থা ভালো। কাঠামোগত পরিবর্তনে বাংলাদেশের তুলনামূলক ভালো অবস্থা থেকে অনুধাবন করা যায়, এলডিসি উত্তরণ কোনো দেশের কাঠামোগত রূপান্তর নিশ্চিত করে না।

বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা: সাবেক এলডিসিগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে উত্তরণের আগে ও পরের পর্যায়ের ভালো চর্চাগুলো বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। এলডিসি থেকে উত্তরণের আগে বতসোয়ানা রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ৫০ শতাংশে উন্নীত করে। কেপ ভার্দে ১৯৮০ থেকে ২০১০ সময়কালে জাতীয় পরিকল্পনা ও রাজস্ব আহরণে ব্যাপক উন্নতি করে। দেশটি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য সম্পদ বিনিয়োগ করে। মালদ্বীপ বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সমর্থ হয়। বতসোয়ানা উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন অগ্রাধিকার অনুযায়ী বৈদেশিক সহায়তার কার্যকর ব্যবহার করে। দেশটি সুশাসন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং প্রাজ্ঞ নীতির মাধ্যমে জ্বালানি সম্পদকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগায়। মালদ্বীপ সেবা খাত বিশেষত পর্যটন খাতের দিকে ঝুঁকে অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনে। সামোয়া কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং সেবা খাতে উচ্চমূল্য সংযোজনে যেতে সমর্থ হয়।

বাংলাদেশকে এসব দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। প্রথমত, সুশাসন নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়ন ও রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতি করতে হবে। বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। উচ্চমূল্য সংযোজন হয় এমন শিল্পের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। জাতীয় অগ্রাধিকার বিবেচনায় রেখে বৈদেশিক ঋণের ব্যবহার করতে হবে।

উত্তরণ-পরবর্তী করণীয়: এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের পর একটা মসৃণ রূপান্তরের জন্য বাংলাদেশকে বেশ কিছু দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাজেট ঘাটতি ও চলতি হিসাবে ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বতসোয়ানার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। দেশটি সাফল্যের সঙ্গে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত বজায় রাখতে সমর্থ হয়। উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সক্রিয় আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রেও বতসোয়ানার উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য। সার্বিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বতসোয়ানা তার বৈদেশিক ঋণ জাতীয় আয়ের ১৫-১৭ শতাংশে নামিয়ে আনে। বিকল্প অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা ও নমনীয় ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। যেমন, উত্তরণের পর সামোয়া সরকার ননি জুস ও অন্যান্য কৃষিপণ্যে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চীনে শূন্য শুল্ক্কে রফতানি করতে সমর্থ হয়। কেপ ভার্দে ২০০৬ সালে রূপান্তর সহায়তা গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে এবং বাড়তি দু’বছর ইউরোপিয়ান বাজারে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা পেতে সমর্থ হয়। মালদ্বীপ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ইআইএফ অর্থায়ন কাঠামো থেকে বাড়তি দু’বছর সহায়তা পায়। বাংলাদেশকে রেগুলেটরি কাঠামো শক্তিশালী করার বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।