Published in দেশ রুপান্তর on 3 January 2020
অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাত বিশ্লেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো। তিনি সেইন্ট গ্রেগরী উচ্চ বিদ্যালয় এবং ঢাকা কলেজে লেখাপড়া করেন। মস্কোর প্লেখানভ রাশিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ ইকোনমিক্সে অর্থনীতিতে এমএসসি এবং পিএইচডি অর্জন করেন তিনি। পরে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন এলিজাবেথ হাউজ থেকে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন। তিনি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এ সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০০৭ সালে তিনি জেনেভায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) এবং ইউএন কার্যালয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। নতুন বছরে করোনাকালের অর্থনৈতিক রূপরেখা, আগামী দিনের অগ্রাধিকার ও উত্তরণের নানা দিক, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের অগ্রগতি, করোনাসৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয়সহ নানা বিষয়ে দেশ রূপান্তরের মুখোমুখি হয়েছিলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের অনিন্দ্য আরিফ
দেশ রূপান্তর : ২০২০ সালে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও কভিড-১৯ এর ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছে। এর স্বাস্থ্যগত অভিঘাতের মতো অর্থনৈতিক অভিঘাতও ব্যাপক ছিল। করোনাকালের বছরে আমরা কী শিক্ষা পেলাম?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ করোনা মহামারী বেশ দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পেরেছে। তারপরেও বলতে হবে গত ১০ বছরে আমরা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে যে বিষয়টি বোঝাতে পারিনি করোনার অভিজ্ঞতা সেই বিষয়টিই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। দেশের উন্নতিকে ত্বরান্বিত করতে হলে, দেশের উন্নয়নের সুফল সবার মধ্যে সুষমভাবে বণ্টন করতে হলে এবং এই উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে আমাদের বেশ কিছু নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার। করোনার সময় এই নীতি এবং প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা বেশ চোখে পড়েছে। বিগত অর্থবছরে দেখা গিয়েছে আমাদের কর আহরণ কম ছিল, করযোগ্য অনেক মানুষ করের আওতায় থাকার পরেও কর দেন না, এটা পরিষ্কার হয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তিরা দেশের ভেতর থেকে অর্থ পাচার করেন, সেটাও স্পষ্ট হয়েছে। এজন্য ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে দুর্বলতা সেটাও প্রকট হয়েছে। আরেকটা কথা বলা দরকার যে, সরকারের আয়ের ক্ষেত্রে যেমন নিচু মান বজায় থাকছে, তেমনি সরকারের ব্যয়গুলোও গুণসম্পন্ন নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমরা শুধু জিডিপির অপ্রতুল অংশ বরাদ্দ দিয়েই থাকি না, উপরন্তু এ ক্ষেত্রগুলোতেও সরকারি ব্যয়ের হিসাব গুণসম্পন্ন নয়। সেটি এবার আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। স্বাস্থ্য খাতে আমরা দুর্নীতি এবং অপচয়ের একটা নেতিবাচক অভিজ্ঞতা দেখা গিয়েছে। আরও দেখা গিয়েছে যে, স্থানীয় সরকার যদি কার্যকর না হয়, তাহলে সরকার দুস্থ মানুষদের কাছে যে সহায়তা পৌঁছে দিতে চায়, সেটাও ঠিকভাবে বিলি-বণ্টন হয় না। একইরকমভাবে দেখা গিয়েছে যে, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রের অভিঘাতগুলো মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি একটা বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে থাকে। অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক ব্যবস্থাপনারও উন্নতি হয়েছে। আবার তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বড় ধরনের বৈষম্যের চেহারাও আমাদের কাছে ফুটে উঠেছে। সবার কাছে তথ্যপ্রযুক্তি না থাকার কারণে এর সুফল সবাই সমানভাবে ভোগ না করতে পারার কারণে এ বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। এ সময়টাতে নারীর ওপর নির্যাতনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, শিশুর পুষ্টিহীনতা বেড়েছে। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। সব মিলিয়ে যে সরকারের যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার, প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন, সে বিষয়গুলো এ সময়ে ভালোভাবে উপলব্ধি হয়েছে। এ অভিজ্ঞতা থেকে সরকারের অনেক কিছু অনুধাবন করার আছে, কেননা এসব কারণেই সরকারের অনেক সঠিক নীতি দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার জন্য ভেস্তে যায়।
দেশ রূপান্তর : এখন করোনাকালের মধ্যেই আমরা আবার একটি নতুন বছরে পদার্পণ করছি। নতুন বছরে আমরা কী প্রত্যাশা করতে পারি?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : নতুন বছরের প্রত্যাশার সময়ে আমাদের মনে রাখতে হবে, ২০২০ সালের করোনার কারণে সৃষ্ট বিপর্যয় এ বছরেও অব্যাহত থাকবে। ২০২০ সালের প্রতিকূল পরিস্থিতি দেখে এই ধারণা পোষণ করা যাবে না যে, নতুন বছরটি আমাদের জন্য কম বৈরী হবে। করোনার নানা ধরনের অভিঘাত এ মহামারীর পর দেখা যাবে। ২০২১ সালেও আমরা করোনার অভিঘাত মোকাবিলা করব। সেটা কর আদায়ের ক্ষেত্রে হোক, ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে হোক আর রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেই হোক, সব খাতেই অভিঘাত পরিলক্ষিত হবে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, করোনা সংক্রমণ রোধে যে টিকা আসবে সেটা যেন বিনামূল্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন করা হয়। করোনার টিকা যদি প্রথম বিষয় হয়, দ্বিতীয় বিষয় হবে কর্মসংস্থান। বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়ের কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিয়ে ভালো ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। যেহেতু করোনার অভিঘাতে নিম্ন মধ্যবিত্ত আক্রান্ত হয়েছে, তাই শিক্ষিত যুব সমাজের কর্মসংস্থানের বিষয়টির সুরাহার মধ্যেই আগামী বছরের পুনরুজ্জীবনের বিষয়টি নিহিত আছে। তৃতীয় বিষয় হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ রাখা। এখনো পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি নিচেই আছে। কিন্তু এখন যেভাবে খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে চালের দাম যেভাবে বাড়ছে, সেটা দুশ্চিন্তার বিষয়। এখন যে তিনটি বিষয়ের কথা আমি বললাম অর্থাৎ করোনার টিকা, যুব কর্মসংস্থান এবং মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ, এ বিষয়গুলো খুবই গুরত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে নতুন বছরের অভিঘাত মোকাবিলা করা সহায়ক হতে পারে।
দেশ রূপান্তর : ২০২১ সালটি বাংলাদেশের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই বছরেই আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান আকাক্সক্ষা ছিল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন। এই পঞ্চাশ বছরে আমরা সেই সমৃদ্ধির কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : আমি মনে করি বাংলাদেশ এই ৫০ বছরে অনেক নজরকাড়া অর্জন ঘরে নিয়ে আসতে পেরেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এই দেশটি তার বিপর্যস্ত অর্থনীতি, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা এবং বহুল জনসংখ্যার জন্য সারা বিশ্বে একটি নেতিবাচক ধারণা নিয়ে অবস্থান করছিল। এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো নিজেদের একটি টেকসই, উন্নয়নকামী এবং মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এক ধরনের নেশনহুড আমরা তৈরি করতে পেরেছি। যেজন্য আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছি এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় ঘটিয়েছিলাম, সেই মর্যাদাটা আমরা অর্জন করতে পেরেছি। এটা দুই-একটি বিষয় দেখলেই বোঝা যায়। স্বাধীনতার সময় আমাদের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর আর এখন গড় আয়ু হলো ৭৩ বছর। প্রায় দেড়গুণ বেশি সময় বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, আমাদের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে। আগে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারতাম না, এখন ১৬ কোটির বেশি মানুষকে তিনবেলা খাওয়াতে পারছি। আমরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, সাক্ষরতা অর্জন, মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নের মতো অর্জন সৃষ্টি করতে পেরেছি। আমরা ক্রীড়া, বিজ্ঞানসহ নানা ক্ষেত্রে কম-বেশি উন্নতি করেছি। তাই ৫০ বছরে আমাদের অর্জন অনেক। কিন্তু এই অর্জনের মধ্যে অতৃপ্তি কিংবা দুঃখের বিষয় হলো এসব অর্জনের মধ্যে এখনো অনেক বৈষম্য রয়ে গিয়েছে। সবাই এর সুফল সমানভাবে ভোগ করতে পারিনি। তাই এই বৈষম্য নিরসনই আমাদের আগামী ৫০ বছরের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
দেশ রূপান্তর : ২০০৮ সাল থেকে সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দা প্রত্যক্ষ করছে। এই মন্দা থেকে উত্তরণ না ঘটতেই করোনার মতো অতিমারী এখন বিশ্বকে আক্রান্ত করেছে। প্রায় সব ধরনের অর্থনৈতিক পূর্বাভাস বলছে, করোনার ফলে এই মন্দা আরও তীব্র রূপ ধারণ করবে। এখন বাংলাদেশের পক্ষে এই মন্দার অভিঘাত মোকাবিলায় কী করণীয় আছে?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : এক্ষেত্রে বলা যায় করোনার অর্থনৈতিক অভিঘাত মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে আমাদের কৃষি খাত। বিশ্বের অর্থনীতির মধ্যে আমাদের জায়গা করে নিতে হবে এটা সত্যি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রপ্তানিমুখী সমধিক অভ্যন্তরীণ বাজারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে ফসল তোলার পর কৃষিতে পোস্ট হার্ভেস্টিং, কৃষির আধুনিকীকরণ, যান্ত্রিকীকরণ এবং কৃষির শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া এখন সবচেয়ে মূল বিষয়। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বহুধাকরণ বা বিচিত্রায়ণ এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীরা সবসময় রপ্তানির দিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এটা ঠিক আছে। আমি প্রত্যাশা করি, তারা বেশি না হলেও সমান গুরুত্ব দেবেন অভ্যন্তরীণ বাজারের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে, এর বিচিত্রায়ণ, আধুনিকীকরণ এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকে। আমি মনে করি, মন্দাক্রান্ত বিশ্বের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার সবচেয়ে বড় উপায়।
দেশ রূপান্তর : বাংলাদেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার (২০১৫-২০২০) বাস্তবায়নকাল শেষ হয়েছে গত জুন মাসে। শিগগিরই সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২০২৫) ঘোষণা করতে যাচ্ছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকীর অর্জন এবং কিছু ব্যত্যয় ও বিচ্যুতি কী কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : এটা খুবই একটা অদ্ভুত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা যেখানে কর আদায় হয়নি, ব্যক্তি বিনিয়োগ হয়নি, রপ্তানি আয় প্রাক্কলন অনুযায়ী হয়নি, রেমিট্যান্স ঠিকমতো আসেনি, বৈদেশিক বিনিয়োগ একেবারেই তলানিতে ছিল অথচ আমরা প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। পাশাপাশি, কর্মসংস্থান ঠিকমতো হয়নি। তাই এটা একটা বিচিত্র বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা। উৎপাদনশীল উপাদানের গতিবৃদ্ধি বাকি রেখেই আমরা প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। এখানে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এই প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে ভোগের বৈষম্য বেড়েছে, আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সম্পদের বৈষম্য আরও মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ এই প্রবৃদ্ধির অংশীদার বাংলাদেশের ব্যাপক মানুষ হতে পারেনি। পাশাপাশি, বাংলাদেশে যে বিকাশমান মধ্যবিত্ত বেড়ে উঠেছে, তাদের আয় বাড়লেও সেই সমান্তরালে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সুযোগ বৃদ্ধি পাইনি। এটি একটি বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গিয়েছে। এখন কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সুরক্ষার দিকে গত পাঁচ বছরে যে আমাদের অগ্রগতি হয়নি, সেটি বিবেচনা করে আগামী পাঁচ বছরে আমরা কী কী পদক্ষেপ নিতে পারি এবং বাস্তবায়ন করতে পারি, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এখানে পরিসংখ্যানের বিভ্রান্তি কাটিয়ে প্রকৃত উন্নয়নের অভিজ্ঞতাকে কীভাবে স্বচ্ছভাবে আমরা অষ্টম পঞ্চবার্ষিকীতে আনতে পারি, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্ব আরোপ করার বিষয়। তবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় আমরা কিছু অর্জনও করেছি। আসলে যেকোনো অর্থনীতি তো স্থবির থাকে না, সেটা সামনের দিকে এগোয়। আমরা আসলে পরিকল্পনার সময় যা বলেছিলাম, তার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি সেটাই বিবেচ্য। তবে এ সময়ে আমাদের প্রায় এক কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে উত্তরণ ঘটিয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন দেড়গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সাক্ষরতা ১০/১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, নারীর প্রতি বৈরী আচরণের সূচকে আমাদের অবস্থানের উন্নতি ঘটেছে, খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু এগুলোকে পরিকল্পনার প্রাক্কলনের সঙ্গে সম্পূর্ণ এক করা যাবে না।
দেশ রূপান্তর : রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আগামীতে বৈদেশিক অর্থ সাহায্যের বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চিত যে, বৈদেশিক সহায়তার অবসাদ ঘটবে। এটাকে বলা হয় সাহায্যের অবসাদ। সেটাই সামনে ঘটবে। রাজনৈতিক গুরুত্বও কমে যাবে। এটি একমাত্র বাংলাদেশের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কাই রয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক তৎপরতার দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি ছাড়া এটার সমাধান আশা করা যায় না।
দেশ রূপান্তর : আপনি নানা সময়ে দেশের বিকাশমান মধ্যবিত্তের বিকাশের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। এই বিকাশমান মধ্যবিত্তকে কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : এখানে মনে রাখতে হবে আগের ইতিহাসের ধারা অনুযায়ী, শ্রমিক শ্রেণির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো সর্বাধিক। এখন শ্রমিক শ্রেণির চরিত্রে পরিবর্তন ঘটেছে। কায়িক এবং মানসিক শ্রমের বিভাজনের সমন্বয় সাধিত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি তাদের অনেক অগ্রসর করেছে। তাদের তথ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এদেরই বিকাশমান মধ্যবিত্ত বলা হচ্ছে। আমাদের মতো বাজার নির্ভর অর্থনীতির দেশে এদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বও বাড়ছে। বৈশ্বিক একটা কাঠামোর মধ্যে তাদের চেতনা শাণিত হচ্ছে। তাদের আয় বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্যের দিক থেকে তারা অনেক বঞ্চিত হচ্ছে। করোনাকালে এই সংকটের তীব্রতাকে তারা আরও উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাই তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের গুণ-মান উন্নত করার বিকল্প নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই আমি মনে করি, এই বিকাশমান মধ্যবিত্তের উন্নতি সাধনের মধ্যেই আগামী দিনের দেশশাসনের যোগ্যতা নিহিত আছে।