Published in দৈনিক সমকাল on 16 October 2020
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিশ্ব অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে তাদের সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে এ বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৪ শতাংশ বেড়ে এক হাজার ৮৮৮ ডলারে পৌঁছাবে। অন্যদিকে, ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ১০ দশমিক ৫ শতাংশ কমে এক হাজার ৮৭৭ ডলারে নামবে। বাংলাদেশের জন্য এই পূর্বাভাস একটি উৎসাহব্যঞ্জক খবর। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি অবশ্যই ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলাফল। তবে এই পরিসংখ্যানের কতগুলো বিশেষ প্রেক্ষিত আছে এবং তার আলোকে কতিপয় বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।
যদি দেশজ আয়ের জায়গায় মাথাপিছু জাতীয় আয় বা জিএনআই (প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সসহ) বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ আরও অনেক এগিয়ে থাকবে। কেননা, জিডিপি ও জিএনআইর মধ্যে যেখানে বাংলাদেশের পার্থক্য প্রায় ৫ শতাংশ, সেখানে ভারতের পার্থক্য দেড় শতাংশ। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, ভারতের অর্থনীতি কভিড অতিমারির কারণে এ বছর ১০ শতাংশের বেশি সংকুচিত হতে চলেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বেসরকারি যেসব প্রাক্কলন আসছে, সেখানে তা অন্তত ৩ শতাংশের আশপাশে। পার্থক্য যা-ই থাকুক, বাংলাদেশের অর্থনীতি কভিডের কারণে সংকুচিত হয়েছে- এমন হিসাব এখনও আসেনি।
উপরন্তু তুলনামূলক আলোচনার ক্ষেত্রে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার বিনিময় হারের বিষয়টিও বিবেচ্য। ভারত সাম্প্রতিককালে তার মুদ্রাকে ব্যাপকভাবে অবনমন করেছে। গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে রুপির দর কমেছে ৮ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশের টাকার দর কমেছে ১ শতাংশের মতো। এতে রুপির চেয়ে টাকা স্থিতিশীলভাবে শক্তিশালী। ফলে জাতীয় আয়কে ডলারে রূপান্তরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে থেকেছে।
দুই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধরন বিবেচনা করলে দেখা যায়, উভয় দেশে সাম্প্রতিককালে আয়বৈষম্য বেড়েছে। সম্পদবৈষম্যও বেড়েছে। তবে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে বৈষম্য বেশি। দুই দেশেই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। ১ দশমিক ৯ ডলার আয়ের বিবেচনায় বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্য পরিমাপের পদ্ধতি বিবেচনায় বাংলাদেশে কর্মরত দরিদ্র লোকের সংখ্যা ৯ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে, ভারতে তা ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে যে বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না যে, ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) বিবেচনায় একই পরিমাণ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে বেশি পণ্য কেনা যায়। ভারতের নাগরিকদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা বাংলাদেশের চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি। এর মানে হলো, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হয়তো বেশি হতে পারে, কিন্তু ভোগ-সন্তুষ্টি ভারতের নাগরিকদের বেশি।
মনে রাখতে হবে, ভারতের এ বছরের সংকোচন কভিড অতিমারির কারণে ব্যতিক্রম। এটি তাদের অর্থনীতির স্বাভাবিক সময়ের আচরণ নয়। আর পরের বছরেই, অর্থাৎ ২০২১ সালে ভারতের অর্থনীতি ৯ শতাংশ বাড়বে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বাড়বে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। ফলে মধ্য মেয়াদে কোন দেশে কতটুকু টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি হবে, তা এ মুহূর্তে বলা কষ্টকর। আমরা এখন সময়ের মুহূর্তের একটি পরিসংখ্যানকে ধারণ করছি, কোনো অর্থনৈতিক প্রবণতাকে নয়। অর্থনৈতিক প্রবণতার পরিসংখ্যানের জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।
এটা মনে রাখতে হবে যে, ভারতের অর্থনীতির আকার বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বড়। আবার অনেক বড় দেশ হওয়ায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থার বেশ তারতম্য রয়েছে। যেমন- বিহার ও গুজরাটের অর্থনীতির মধ্যে তারতম্য অনেক ব্যাপক। সুতরাং অর্থনীতির আকার, দেশের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যকার অবস্থার পার্থক্য, কভিড অতিমারির কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক কাঠামো ও তার শক্তি প্রবৃদ্ধির ধরন, বৈষম্য পরিস্থিতি ইত্যাদির বিবেচনায় পুরো বিষয়টি দেখতে হবে।
এবার কভিড-উত্তর অর্থনীতির আলোচনায় আসি। আইএমএফ ২০২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির অনুমান করেছে। ভারতের অর্থনীতি এর চেয়েও বেশি হারে বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। আমাদের মনোযোগ রাখার বিষয় হবে, ভারতের অর্থনীতি যখন ইতিবাচক হবে, তখন বাংলাদেশ তার সুযোগ কীভাবে নিতে পারে।
সাম্প্রতিককালে দুই দেশের সম্পর্ক বাণিজ্য থেকে বিনিয়োগের দিকে গেছে এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রেও সম্পৃক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও যোগাযোগের ত্রিমাত্রিক সহযোগিতাকে কীভাবে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়, তার জন্য সমন্বিত চিন্তার প্রয়োজন। যোগাযোগের ক্ষেত্রে নেপাল ও ভুটানকে যুক্ত করে উপ-আঞ্চলিক বিভিন্ন সুবিধা কীভাবে আরও কার্যকরভাবে পাওয়া যায়, সেদিকে বাংলাদেশকে নজর রাখতে হবে। ভারত এখন বাংলাদেশের ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা কাজে লাগিয়ে তার এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পণ্য পরিবহন করছে। একইভাবে ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশের বিষয়টিও কাঙ্ক্ষিত। সাম্প্রতিক সময়ে উপকূলীয় যোগাযোগ সম্প্রসারণের যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তাকে যথার্থভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে এ অঞ্চলে বাণিজ্য বাড়ানোর সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারতের অধিকতর সহযোগিতাও প্রত্যাশিত। অতিমারি-উত্তর অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা বাড়বে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও ভারত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আগামীতে কী কী পদক্ষেপ নেয়, তা আমাদের আগ্রহের বিষয় থাকবে।
সবশেষে বলব, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সংখ্যার বিবেচনায় না দেখে তা কতটুকু অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে এবং বৈষম্য কমাবে, সে আলোচনা বেশি প্রয়োজন। একদিকে মাথাপিছু গড় আয় বাড়ল তবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আয় বাড়ল না, বিশ্ব তাকে প্রকৃত উন্নয়ন বলে না।
সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি