Originally posted in যুগান্তর on 31 May 2025
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বর্তমানে একটা উত্তরণকালীন সময় পার করছে দেশ। রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে। অর্থনীতিতেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। তবে অভ্যুত্থানের কারণে দেশের মানুষের মধ্যে নতুন প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। সেই প্রত্যাশার মধ্যে রয়েছে মানসম্পন্ন শিক্ষা, ন্যূনতম সরকারি স্বাস্থ্যসেবা, গরিব মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা এবং শিক্ষিত যুবসমাজের জন্য শোভন কর্মসংস্থান। এসব প্রত্যাশাকে মোকাবিলা করাই এবারের বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কর্মসংস্থানের জন্য বাড়াতে হবে বিনিয়োগ। যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন। তার মতে, অর্থনীতিতে সরকারের মনোযোগ কম। এছাড়াও এখন পর্যন্ত যা অর্জিত হয়েছে, তাতে অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা পূরণ করা যায়নি। এক্ষেত্রে তিনটি বড় সমস্যা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-সহযোগিতার ঘাটতি, স্বচ্ছতার অভাব এবং সমন্বয়হীনতা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুভাগ করা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এই ভালো উদ্যোগটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বড় সমস্যা নেতৃত্বের দুর্বলতা। এছাড়াও সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ, সংস্কার ইস্যু, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত এবং পাচারের অর্থ ফেরানো নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যুগান্তরের বিশেষ প্রতিনিধি মনির হোসেন
যুগান্তর: বর্তমানে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং আইনশৃঙ্খলাসহ সবকিছুতেই এক ধরনের অনিশ্চয়তা আছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. দেবপ্রিয়: বর্তমানে দেশ একটা উত্তরণকালীন সময় পার করছে। আমরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছাতে চাচ্ছি। তবে পৌঁছানোর পথটা নিঃসন্দেহে খুব মসৃণ নয়। এখানে অনেক অনভিপ্রেত এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা আছে। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা রাজনীতি, অর্থনীতি এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতিতেও আছে। এসব বিষয় মোকাবিলা করতে একাধিক পদক্ষেপ নিতে হয়। সেই পদক্ষেপের ফলাফল সম্পর্কে যখন আমরা নিশ্চিত নই, তখনই অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। আবার এক অনিশ্চয়তা, অন্য ধরনের অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়। এর ভেতর দিয়েই আধুনিক সমাজে বসবাস করতে হয়। যেহেতু রাজনীতির বা রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে একটা অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে। অর্থনীতিতেও দেখা যাচ্ছে তার প্রতিফলন। এর ফলে বড় যে সমস্যা হচ্ছে, একদিকে সংস্কার নিয়ে আমাদের যে প্রত্যাশা, সেখানে মনোযোগ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য যে ধরনের মনোযোগ দেওয়া দরকার সেটাও দিতে পারছে না সরকার। যেটুকু দিতে পারছে, তাও অনেক সময় সঠিকভাবে হচ্ছে না।
যুগান্তর: বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
ড. দেবপ্রিয়: সামষ্টিক অর্থনীতিতে একটি বিষয় বিবেচনা জরুরি। তা হলো অন্তর্বর্তী সরকার যখন শপথ নেয়, ওই সময়ে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রথমত, দেশের ভেতরে আগের দেড় দশক ধরে যে লুণ্ঠন এবং অপশাসন চলেছে, সে ব্যাপারে একটা সম্মুখ ধারণা পাওয়া। তাই প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে আমরা শ্বেতপত্র তৈরি করি। এতে এক ধরনের স্বচ্ছতা এলো। কিন্তু এই স্বচ্ছতাকে ভিত্তি করে, অনেক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া জরুরি ছিল। আমরা শ্বেতপত্রে উল্লেখ করেছি, একদিকে দেশের আর্থিক খাতে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্ব আদায় অনেক কম। দ্বিতীয়ত, যেটুকু রাজস্ব আদায় হয়, সেটাও পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। তৃতীয়ত, বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর আয় করযোগ্য কিন্তু তারা কর দেন না। অর্থাৎ কর ব্যবস্থার মধ্যে এ ধরনের বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। অপরদিকে রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে তিনটি বড় খাত হলো ভর্তুকি, ঋণের সুদ পরিশোধ এবং বেতন-ভাতা। এই তিন খাতে ব্যয়ের পর উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য একটা পয়সাও থাকে না। ফলে উন্নয়ন ব্যয়ের পুরো ব্যয়টাই দেশি-বিদেশি ঋণনির্ভর। এতে উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষাও সীমিত রাখতে হয়। যেহেতু উন্নয়ন ব্যয়ের কারণে বাজেট ঘাটতি বাড়বে, তাই ঘাটতি মোকাবিলায় টেকসই পদ্ধতি হিসাবে বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহার করা দরকার। কিন্তু শেষ সময়ে দেখা যায়, ব্যাংক থেকে অথবা জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে টাকা নেয় সরকার। অর্থাৎ এই সরকার একটা দুর্বল রাজস্ব কাঠামো পেয়েছে। এটি আয়ের দিক থেকে দুর্বল, ব্যয়ের দিক থেকে অকিঞ্চিৎকর এবং ঘাটতি অর্থায়ন পদ্ধতি টেকসই নয়। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার এবারের বাজেট কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটি সমস্যা হলো, দায়দেনার চাপে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছিল। বিদেশি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা যাচ্ছিল না। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কম। এই দুটি সমস্যার মধ্যে গত ৯ মাসে সরকার দ্বিতীয়টা মোকাবিলায় কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে। এতে টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল হয়েছে। পুরোনো দায়দেনা অনেকগুলোই পরিশোধ করা গেছে। রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) বেড়েছে। এখন পর্যন্ত রপ্তানিও ভালো আছে। তবে অর্থনীতির আরেকটি জায়গায় সমস্যা রয়ে গেছে। সেটা হলো সংকোচনমূলক অর্থনীতির কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর বড় কারণ সরকারি-বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নেই। আর একটু পরিষ্কার করে বললে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার খুবই কম। অপরদিকে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগও কম। এর ফলে সামাজিক সুরক্ষার দায়িত্ব আরও বেড়েছে। এই সামাজিক সুরক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়ানো জরুরি। বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি অন্যতম বড় বিষয় হিসাবে অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।
যুগান্তর: এই পরিস্থিতিতে এবারের বাজেটে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকছে?
ড. দেবপ্রিয়: সুনির্দিষ্টভাবে বললে নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ একটু ভিন্ন। ইংরেজিতে আমরা বলি ‘ম্যানেজিং এক্সপেক্টেশন’। অর্থাৎ প্রত্যাশাকে মোকাবিলা করাই এবারের বাজেটের বড় একটা চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে বাজেট কাঠামোর ভেতরে চলমান ঘাটতিগুলোকে প্রথমে মোকাবিলা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে, সেই প্রত্যাশাটাকে পূরণ করতে হবে। অর্থাৎ বিকাশমান মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত শ্রেণি, গ্রামে বেড়ে ওঠা আরেক ধরনের মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রত্যাশাটা মোকাবিলা করতে হবে। এসব প্রত্যাশার মধ্যে রয়েছে মানসম্পন্ন শিক্ষা, ন্যূনতম সরকারি স্বাস্থ্যসেবা, গরিব মানুষের জন্য সুরক্ষা, শিক্ষিত যুবসমাজের জন্য কর্মসংস্থান এবং সেই কর্মসংস্থানের বড় চালিকাশক্তি হলো ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো। ফলে সবাই মিলে লক্ষ্য রাখবে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে নতুন কি পদক্ষেপ আসছে, প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটল কিনা, দুর্বল হয়ে পড়া ব্যক্তি খাত চাঙা করা গেল কিনা এবং তার মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে কিনা সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যুগান্তর: সংস্কার শব্দটি এই মুহূর্তে ব্যাপক আলোচিত। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো বাজেট বাস্তবায়নে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?
ড. দেবপ্রিয়: একটা বিষয় লক্ষ্য করবেন, সংস্কার নিয়ে টুকটাক কাজ হচ্ছে। হয়তো শ্বেতপত্রে যা বলা হচ্ছিল, সব হচ্ছে না। কিন্তু কিছু কাজ হচ্ছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জনপ্রশাসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং শ্রমের মান নিয়ে কাজ হচ্ছে। কিন্তু এসব কাজে কোনো স্বচ্ছতা এবং মধ্যমেয়াদি কাঠামো নেই। ফলে কোন মানদণ্ডে এর মূল্যায়ন করা হবে, সেটি নেই। উদাহরণস্বরূপ দেশে একটা আইন আছে, ৩ মাস পরপর দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী সংসদে বিবৃতি দেবেন। বর্তমানে সংসদ নেই। কিন্তু মানুষ, দেশ এবং অর্থনীতি সবই আছে। কিন্তু ৯ মাস সরকার যে দায়িত্ব পালন করছে, এ সময়ে কোনো বিবৃতি দেখিনি। এই সরকার গত সরকারের বাজেট নিয়ে চলছে। নিজেরা কোনো বাজেট তৈরি করেনি। অর্থাৎ সরকার বদল হলেও নীতিমালা বা কাঠামো বদল হয়নি। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বন্ধ করেছে, কিন্তু মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা দেয়নি। ফলে বিনিয়োগের ধারাবাহিকতায় আস্থা পাওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রয়োজন ছিল মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার। এরপর ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কী অগ্রগতি হচ্ছে, তা বলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা সৃষ্টি করা। কিন্তু সেটি সরকার করেনি। এই সরকারের অর্থনৈতিক নীতিমালার বিবৃতি নেই। অবশ্য একজন দিয়েছেন। মাসখানেক আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব একটি বিবৃতি দিয়েছেন। এখানে কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে, প্রেস সচিব কেন এই বিবৃতি দেবেন।
যুগান্তর : একদিকে সরকারের রাজস্ব আয় কম। অপরদিকে বর্তমানে আয়ের খাতগুলো অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। বাজেট বাস্তবায়নে এর কী প্রভাব পড়বে?
ড. দেবপ্রিয় : এবারের অর্থনীতিতে সব সূচকের অর্জন দেশজ আয়ের তুলনায় গত বছরের চেয়ে কম হবে। এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। কারণ হলো এই মুহূর্তে অর্থনীতি একটি স্থিতায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এটাকে ইংরেজিতে বলা হয় এডজাস্টমেন্ট। এই স্থিতায়নের ধারাকে সংহত করে প্রবৃদ্ধির ধারায় উত্তরণ আমাদের লক্ষ্য। তবে এর পক্ষেও শক্তি আছে। আবার বিপক্ষেও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এই প্রতিবন্ধকতার জায়গা দুটি। একটি হলো ব্যাংকিং খাত এখনো সচল হয়নি। পাশাপাশি পুঁজিবাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। অপরদিকে জ্বালানি খাতে সমস্যা রয়েছে। এই দুটিকে বলা হয়, অর্থনীতির দুটি ফুসফুস। এর মানে হলো দুটি ফুসফুসই রোগাক্রান্ত। ফলে বাজেটে অন্যতম চ্যালেঞ্জ ব্যক্তি খাতকে সচল করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। কিন্তু এটা করার জন্য পরিপূরক পরিস্থিতি এখনো সম্পূর্ণভাবে সৃষ্টি হয়নি। পরিতাপের বিষয় হলো, অর্থনীতির এই বাস্তব পরিস্থিতি সরকার জনগণের কাছে ভালো করে ব্যাখ্যা করতে পারছে সেটা মনে হচ্ছে না। অর্থাৎ এই মুহূর্তে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জনগণকে আস্থায় নিয়ে যে ব্যাখ্যা করবে অথবা অংশীজনদের কাছে তুলে ধরবে, সেটার ক্ষেত্রে সরকার খুবই দুর্বল। এমন কী নিজেদের কাজও ভালোভাবে বলতে পারছে না।
যুগান্তর: অর্থনীতির দুর্বলতা কাটাতে সরকার ইতোমধ্যে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির কিছু শর্ত পরিপালন করা হচ্ছে। অর্থনীতিতে এর প্রভাব কী দেখেন?
ড. দেবপ্রিয়: আমরা খুশি আইএমএফের ঋণের শেষ দু-তিনটি কিস্তি ছাড় হবে। এজন্য মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় করা, ভর্তুকি কমানো এবং কর রেয়াদ বন্ধ করা অন্যতম শর্ত। এর অনেক কিছুই আমরাও চেয়েছি। এগুলো ইতিবাচক। তবে সমস্যা হলো অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকারের স্বচ্ছতা নেই। আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোনো বিবৃতি নেই। বাজেটেও সেটা থাকবে কিনা নিশ্চিত নই। অর্থাৎ স্বচ্ছতা না থাকলে বাজার এর ওপর আস্থা রাখতে পারে না।
যুগান্তর: এনবিআর দুই ভাগ করা হয়েছে। এরপর লাগাতার আন্দোলনে নেমেছেন রাজস্ব কর্মকর্তারা। আপনি কীভাবে দেখেন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমি এটাকে বলব, একটা ভালো নীতির অপপ্রয়োগের কারণে এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এখানে আমি নেতৃত্বের ঘাটতি দেখি। শ্বেতপত্রে আমরা এনবিআরকে ভাগ করার সুপারিশ করেছিলাম। নীতি প্রণয়ন ও কর আহরণকে আলাদা করতে বলেছিলাম। আইএমএফও সেটি জোর দিয়ে বলেছে। মূল উদ্দেশ্য হলো, এখান থেকে স্বার্থের সংঘাত দূর করা। কিন্তু ঠিক কাজও উলটোভাবে করলে গণ্ডগোল লেগে যায়, এটি তার আরেকটি উদাহরণ। এর মধ্য দিয়ে সরকারের কার্যক্রমের মূল তিনটি সমস্যা সামনে আসছে। একটি হলো সহযোগিতা নেই। অর্থনীতির অন্যান্য অংশীজন বা প্রাসঙ্গিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, নিজেদের ভেতর সমন্বয় নেই। একজনের কাজ সম্পর্কে আরেকজন কতটুকু অবহিত তা আমরা জানি না। তৃতীয়ত, স্বচ্ছতা নেই। যেটুকু কাজ করেন, তা মানুষকে জানানোর উদ্যোগ নেই। এনবিআরের বিভাজনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেনি। কমিটিতে কারা আছে, সে তথ্যও প্রকাশ হয়নি। আবার কাজটি সমন্বয়ের মাধ্যমে হয়নি। ফলে নিজেদের কাজে নিজেরা আটকে গেছে। প্রথমে অত্যন্ত দাম্ভিক আচরণ করেছে। শেষে পরাজয়ের ফলাফল গিলতে হলো। সবকিছু মিলে পুরো দেশটা এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়ে গেছে।
যুগান্তর: পাচারের অর্থ ফেরানোর উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে। আপনি এর কী সম্ভাবনা দেখছেন?
ড. দেবপ্রিয়: পাচারের অর্থ ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটা ইতিবাচক। তবে একটি বিষয় খেয়াল করতে হবে, পাচার বন্ধ হয়েছে কিনা। এক্ষেত্রে শ্বেতপত্রের বড় একটি মূল্যায়ন সঠিক হয়েছে। ফলে আমরা মনে করি, অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অন্যান্য সংস্থা পাচারের অর্থ ফেরানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এটি সহজ নয়। কারণ এক্ষেত্রে বেশ সমস্যা রয়েছে। টাকা পাচারের পদ্ধতি চিহ্নিতকরণ, এই টাকা দিয়ে কী সম্পদ কেনা হয়েছে, সেটি চিহ্নিত করা এবং এই সম্পদ বিক্রি আইনি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে নিয়ে আসা অন্যতম। কিন্তু এই সব তৎপরতার ফলে ইতোমধ্যে লন্ডনে দেশের স্বনামধন্য একটি পরিবারের বড় সম্পদ আটক হয়েছে। এছাড়াও দুবাই এবং মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যারা বাড়িঘর বানিয়েছেন, তাদের নামসহ চিহ্নিত হচ্ছেন। রপ্তানি করে দেশে টাকা না আনার প্রবণতা কমেছে। অতিমূল্যায়িত প্রকল্পের মাধ্যমে টাকা নেওয়াও কমেছে। অর্থাৎ টাকা ফেরানোর ক্ষেত্রে আমি আশাবাদী কিন্তু বাস্তবতার পক্ষে। তবে পাচারের অর্থ ফেরানোর বিষয়টি যেহেতু আমাদের নীতি প্রণয়নের ভেতরে স্থান পেয়েছে, এটাই বড় অগ্রগতি। তবে অনেকে মনে করেছিলেন, এবারের বাজেটের অর্থায়নে পাচারের টাকা নতুন একটা খাত হিসাবে যুক্ত হবে। অর্থাৎ পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে এনে বাজেট বাস্তবায়নে খরচ করা হবে। তবে এক্ষেত্রে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।