Originally posted in দেশ রুপান্তর on 28 January 2024
বেকার কমার ভুতুড়ে হিসাব
ডলার, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের ঋণসুবিধাও কমে গেছে। দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে, সংকুচিত হয়েছে ব্যবসা সম্প্রসারণ। এমন সংকটে দেশের বেশিরভাগ কোম্পানিকে তাদের উৎপাদন সক্ষমতা কমিয়ে আনতে হয়েছে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ব্যয় সংকোচনের অংশ হিসেবে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা কর্মী ছাঁটাইয়ে মনোযোগী। এমন পরিস্থিতিতে দেশে বেকার বেড়ে যাওয়ার কথা। অথচ সরকারি হিসাব বলছে, বেকার কমেছে ৯০ হাজার।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া ত্রৈমাসিক হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালে বেকার কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ লাখ ৭০ হাজারে। আগের বছর যা ছিল ২৫ লাখ ৮০ হাজার। তবে, ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিবিএসের এ তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিবিএসের বেকারের সংজ্ঞায় সমস্যা আছে।
বিবিএসের সাময়িক হিসাবে, ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ে বেকার কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ৫০ হাজারে। আগের প্রান্তিকে যা ছিল ২৪ লাখ ৩০ হাজার। অর্থাৎ ৩ মাসের ব্যবধানে বেকার ৮০ হাজার কমেছে বলে উঠে এসেছে বিবিএসের হিসাবে।
২০২৩ সাল শেষে বেকারত্বের হার কমেছে উল্লেখ করে বিবিএস তার তথ্যে বলছে, এ সময় বেকারত্বের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ, যা আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে ছিল ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
বিবিএসের সংজ্ঞা অনুযায়ী বেকার হলেন সেসব ব্যক্তি, যারা গত ৭ দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টাও কাজ করেনি, কিন্তু কাজের জন্য প্রস্তুত ছিলেন বা গত ৩০ দিনে মজুরির বিনিময়ে কোনো কাজ খুঁজেছেন।
তবে কেউ যদি একটি মুরগিও পালন করে থাকেন তাকে বেকার হিসেবে গণ্য করে না বিবিএস।
সরকারি হিসাবে বেকার কমলেও দেশের অর্থনীতির চিত্র পুরো উল্টো। খরচ কমিয়ে আনার অংশ হিসেবে সরকার অনেক উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত রেখেছে। ন্যূনতম রিজার্ভ ধরে রাখা ও ডলার বাঁচাতে আমদানিও সীমিত করে এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব কারণে বাংলাদেশের শিল্প খাতের জন্য ২০২৩ সাল ছিল সবচেয়ে সংকটের বছর। বছর জুড়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটে অনেক কোম্পানিকে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়েছে। উৎপাদন কমায় আয়, মুনাফা দুটোই কমে গেছে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে, মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে, মোট আমদানি যেমন কমেছে, বিপরীতে কমেছে দেশের রপ্তানি আয়ও।
বেকার কমার হিসাবটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বিবিএসের বেকার কমার এ হিসাবের সঙ্গে আমি একমত নই। আমি গত এক বছরে দেখছি আমাদের শিল্প খাতের ক্যাপাসিটি কমে আসছে। অনেক কারখানাকে বাধ্য হয়ে শ্রমিক ছাঁটাই করতে হয়েছে। বিবিএসের হিসাব বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটির প্রমাণ হচ্ছে আমাদের রপ্তানি আয় ক্রমান্বয়ে কমছে।’
মোহাম্মদ হাতেম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এত দিন ধরে আমরা গ্যাসসংকটের মধ্যে ছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে গ্যাসসংকট নিয়ে চিঠিও দিয়েছিলাম। আমরা জানি না এ সংকট কেন। আমাদের কাছ থেকে বর্ধিত মূল্যও নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছি না।’
তিনি বলেন, ‘গ্যাসসংকটের কারণে এ মাসেও রপ্তানি অনেক কম হবে। আমাদের ক্যাপাসিটি যেহেতু কমিয়ে আনতে হচ্ছে, তাই নিয়মিত কর্মী ছাঁটাই করতে হচ্ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ডলার সংকটের কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ২৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ৩১ দশমিক ২১ শতাংশ। ভোক্তাপণ্য আমদানিও কমেছে ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ। তা ছাড়া এ সময়ে আমদানি ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ১৮ দশমিক ১৯ শতাংশ।
দেশের বিদেশি মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত রপ্তানি আয়ের গতিও মন্থর। রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। পোশাক মালিকদের দাবি, কয়েক মাস ধরেই পোশাক খাতের রপ্তানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ছিল ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ, সেখানে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস শেষে প্রবৃদ্ধির গতি কমে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২৩ শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের রপ্তানি আয় ধারাবাহিকভাবে কমতে দেখা গেছে। অক্টোবরে প্রায় ১৪ শতাংশ রপ্তানি কমে যায় পোশাক খাতের। পরের মাস নভেম্বরে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ ও ডিসেম্বরে ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ রপ্তানি কমেছে তৈরি পোশাকের।
জ্বালানী সংকটের পাশাপাশি দেশের শিল্প খাতে বছর জুড়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানি কমলেও বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপের সাময়িক হিসাব বলছে দেশের শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে। ২০২৩ সাল শেষে শিল্প খাতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী ১ কোটি ২২ লাখ ২৪ হাজার। অথচ ২০২২ সাল শেষে তা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ৭০ হাজার।
কোন খাতে কত জনগোষ্ঠী এ হিসাবে বিবিএস শিল্প খাত ছাড়াও কৃষি ও সেবা খাতের হিসাব দিয়ে থাকে। শ্রম জরিপের হিসাবে, ২০২৩ সাল শেষে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মোট জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৭ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার। ২০২২ সালে যা ছিল ৭ কোটি ৪ লাখ ৭০ হাজার।
সেবা খাতেও নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর হার বেড়েছে। ২০২৩ সালের সাময়িক হিসাবে যা ছিল ২ কোটি ৭২ লাখ ২০ হাজার অথচ ২০২২ সালে তা ছিল ২ কোটি ৬৫ লাখ ২০ হাজার।
কৃষিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এক বছরে আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। সদ্য শেষ হওয়া বছরে কৃষিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী ছিল ৩ কোটি ১৫ লাখ ২০ হাজার, ২০২২ শেষে এ সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজার।
অর্থনীতির সব সূচকে নেতিবাচক খবরের পরও বিবিএসের বেকারত্ব কমার তথ্য প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিবিএসের বেকারের সংজ্ঞায়ও সমস্যা আছে। যারা গত এক সপ্তাহে কাজ খুঁজেছেন কিন্তু পাননি, কিন্তু অনেকে কাজ খোঁজাও বন্ধ করে দেন সেটি আবার হিসাবেও আসে না। এসব সমস্যাগুলো আছে।
তিনি বলেন, ‘প্রশ্ন হলো, আমরা কতটুকু শোভন কাজ সৃষ্টি করতে পেরেছি। এখন অর্থনীতিতে রিজার্ভের কারণে আমদানির ঋণপত্র খোলা থেকে শুরু করে সব খাতেই বিলম্ব হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি যেটি ১৪ দশমিক ১ শতাংশ হওয়ার কথা ছিল, সেটি প্রথমে ১১ শতাংশে কমিয়ে আনা হলো। এবারের মুদ্রানীতিতে তা ১০ শতাংশে নামানো হলো। ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ যদি কম হয়, তাহলে সেটি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপরই প্রভাব ফেলে।’
এই অর্থনীতিবিদের মতে, মানুষের যখন কাজ থাকে না, তখন অপ্রাতিষ্ঠানিক ছোট কাজ করে। সেসব কর্মসংস্থান শোভন কর্মসংস্থানও না, শোভন মজুরিও সেখানে দেয় না।
তিনি বলেন, ‘আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আমরা কী ধরনের কাজ সৃষ্টি করতে পেরেছি। সেবা খাতে নিম্ন আয়ের কাজ সৃষ্টি এক বিষয়, আর শিল্প খাতের কর্মসংস্থানের শোভন কাজ আরেক বিষয়।’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের শিক্ষিত বেকারত্বের হার বাড়ছে। তাদের জন্য যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়, সে উদ্যোগ নিতে হবে। ১০ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি করার অর্থ হচ্ছে বিনিয়োগ কম হচ্ছে, কর্মসংস্থান কম সৃষ্টি হচ্ছে। সব মিলিয়ে কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
প্রায় দুই বছর ধরে দেশের মূল্যস্ফীতির হার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ডিসেম্বর শেষেও ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতিও কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সামান্য মূল্যস্ফীতি হলে কর্মসংস্থানের ওপর সেটির প্রভাব তেমন পড়ে না। কিন্তু যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়, তখন চাহিদার দিক থেকে এক ধরনের সংকোচন হয়। এর ফলে উৎপাদনের যে লক্ষ্য, সামষ্টিক যে চাহিদা সেটির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমরা এখন যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি আমাদের অর্থনীতিতে দেখছি, সেটি ইতিবাচক নয়। কারণ সামষ্টিক অর্থনীতিকে সংকুচিত করছে, উৎপাদনের প্রণোদনাও কমে গেছে।