নতুন মার্কিন বাণিজ্য ব্যবস্থা মোকাবিলায় যা করতে হবে – খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Originally posted in সমকাল on 18 July 2025

যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার, বিশেষত ৭১টি দেশ, যাদের সঙ্গে তার উচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, আলোচনা বিশ্বকে নতুন বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। এই বাণিজ্য ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যমূল্যভিত্তিক উচ্চ শুল্কের কারণে, যা আরোপিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ বাণিজ্য ঘাটতির দেশগুলোর ওপর। এটা আরোপ হয়েছে মোস্ট-ফেভারড-নেশন শুল্কের পাশাপাশি যেখানে নির্দিষ্ট পণ্যভিত্তিক শুল্ক রয়েছে। পৃথক এই শুল্কের হার অভিনব এক সূত্রের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে, যেখানে শুল্কের হার মার্কিন পণ্য আমদানির সঙ্গে বিপরীতভাবে সম্পর্কিত এবং মার্কিন বাজারে অ-মার্কিন পণ্য রপ্তানির সঙ্গে ইতিবাচকভাবে সম্পর্কিত। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডব্লিউটিওর নিয়মে নির্ধারিত শুল্কহারের সঙ্গে এ সূত্রের মিল কমই। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের দাবি জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত ডব্লিউটিওর বিধান অনুসরণে এ শুল্ক আরোপিত– যুক্তিটির ন্যায্যতা দেওয়া কঠিন।

বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে আরোপিত দ্বিপক্ষীয় শুল্কের কার্যকারিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত করার পর থেকে ভুক্তভোগী দেশগুলোর বেশির ভাগই আমেরিকার সঙ্গে বিভিন্ন স্তরে আলোচনা করেছে। আলোচনা শুধু সামগ্রিক পণ্যমূল্যভিত্তিক শুল্ক নিয়ে নয়; নির্দিষ্ট পণ্যের মূল্যভিত্তিক শুল্কও এতে অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে আলোচনায় বিভিন্ন বাজারে মার্কিন পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক বা প্রবেশাধিকার অন্তর্ভুক্ত।

অতএব, নতুন বাণিজ্য আলোচনায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে একাধিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত, নতুন মূল্যভিত্তিক শুল্কের অধীনে মার্কিন বাজারে তাদের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সাহায্য করার জন্য আরও মার্কিন পণ্য আমদানি করতে হবে। তৃতীয়ত, দেশগুলো সেসব দেশে পণ্য রপ্তানিতে অসুবিধার মুখে পড়বে, যেসব দেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পণ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি আছে। চতুর্থত, দেশগুলো মার্কিন বাজারে উচ্চ আমদানি শুল্ক বা বিধি-নিষেধের মুখোমুখি অন্যান্য দেশ থেকে সস্তায় পেলেও পণ্য আমদানি করতে পারবে না, তাদের কৃত্রিমভাবে মার্কিন পণ্য আমদানি করতে বাধ্য করা হতে পারে।

এ ধরনের বাণিজ্য প্রক্রিয়া শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আওতাধীন দেশগুলোর রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকেই ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, বরং তাদের কম প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে মার্কিন পণ্য কিনতে বাধ্য করবে অথবা কম খরচের উৎস থেকে আমদানি করতে বাধা দেবে। যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বাণিজ্য পছন্দের কারণে অ-মার্কিন দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন চাপের সম্মুখীন হবে, যা অর্থনীতি-বহির্ভূত সম্পর্কেও প্রসারিত হতে পারে।

নতুন বাণিজ্য ব্যবস্থার এই বহুমাত্রিকতা থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেওয়া দরকার। প্রথমত, বাংলাদেশ এখন মার্কিন বাজারে আরও বেশি প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার ওপর সম্পূর্ণ মনোযোগ দিচ্ছে। এটি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে: ক. যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক হ্রাস; খ. বিপুল পরিমাণে মার্কিন পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতি, যা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসে অবদান রাখবে; গ. বাংলাদেশি পণ্যের ওপর মূল্যসংশ্লিষ্ট শুল্কহার হ্রাসের আশা; এবং ঘ. মার্কিন বাজারে শুল্ক হ্রাস নিশ্চিত করতে রপ্তানি পণ্যের স্থানীয় মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি। একই সঙ্গে আরও কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, যদিও সেগুলো এখনও জনসমক্ষে আসেনি। যেমন বাংলাদেশে কিছু দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ। তবে বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে, এ ধরনের প্রতিশ্রুতি অ-মার্কিন ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বিরুদ্ধে যাবে।

বাংলাদেশে মার্কিন প্রধান রপ্তানি পণ্য, যেমন সয়া বীজ, এলএনজি, গম, রাসায়নিকের আমদানি বৃদ্ধির যে কোনো প্রতিশ্রুতি অন্যান্য দেশের রপ্তানি স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ব্রাজিল, কানাডা ও ইউক্রেন গমের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। একইভাবে কাতার এলএনজি আমদানির প্রধান উৎস। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের মতো গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতি বিদ্যমান উৎস চীন বা ভারতসহ অন্যান্য দেশের রপ্তানিস্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যদিও এসব দেশের পণ্যগুলোর অন্যান্য রপ্তানি গন্তব্য রয়েছে, বাংলাদেশে রপ্তানি বাজারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হারানোকে তারা গুরুতর আঘাত বিবেচনা করতে পারে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের বেশি অর্থনৈতিক স্বার্থের ক্ষেত্রগুলোতে ‘প্রতিশোধমূলক’ ব্যবস্থা নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কাতারে জনশক্তি রপ্তানি প্রতিকূল প্রভাবের সম্মুখীন হতে পারে। কানাডায় রপ্তানি পণ্য অতিরিক্ত শুল্কের সম্মুখীন হতে পারে। চীন অধ্যুষিত ব্যাংক এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক বা এক্সিম ব্যাংক অব চায়না থেকে ঋণ সহায়তা হ্রাস হতে পারে।

অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজনের প্রয়োজনীয়তা ৪০ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি প্রাথমিকভাবে দেশীয় শিল্পের জন্য ইতিবাচক বলে মনে হতে পারে। তবে এ শিল্পগুলো এখনও গুণমান ও সময়োপযোগিতা বজায় রেখে প্রয়োজনীয় পরিমাণে সরবরাহে প্রস্তুত নয়। অতএব, রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। যদি মূল্য সংযোজনের মানদণ্ড বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে চীন বা ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ উৎস থেকে কিছু কাঁচামালের আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে হবে। এই অ-মার্কিন অংশীদাররা, বিশেষত চীন ও হংকং অনুকূল বাজার হারানো ইতিবাচকভাবে গ্রহণ না-ও করতে পারে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক চাপের মুখে পড়তে পারে।

মার্কিন পণ্যের উচ্চ আমদানির প্রতিশ্রুতি দেওয়া দেশগুলোর সঙ্গেও বিদ্যমান রপ্তানির পরিমাণ বজায় রাখতে বাধার সম্মুখীন হতে পারে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক দুই ট্রিলিয়ন ডলারের রপ্তানির (২০২৪ সাল) ৫ হাজার ৫৩০টি পণ্য তালিকার কিছু পণ্য বাংলাদেশও রপ্তানি করে। যেমন প্লাস্টিক পণ্য, কৃষিপণ্য, রাসায়নিক, যন্ত্রাংশ, সরঞ্জাম যা সরাসরি প্রতিযোগিতা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। কারণ একই বাজারে মার্কিন পণ্যগুলোই অগ্রাধিকার পাবে। এশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার বাজারেও ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকরা এ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারেন।

ধারণা করা হচ্ছে, ব্রাজিল, কানাডা, চীন ও ভারতের মতো দেশের প্রধান বৈশ্বিক কৃষিপণ্য, কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য ও তৈরি পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের ফলে মার্কিন বাজারের বাইরে এগুলো কম দামে পাওয়া যাবে। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাবই থাকতে পারে। একদিকে এই সস্তা কৃষিপণ্য ও কাঁচামাল বাংলাদেশের মতো দেশকে কম দামে আমদানি করতে সাহায্য করবে। তবে মার্কিন বাজারে শুল্ক কমাতে উচ্চতর অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে বাংলাদেশ সুযোগটি কাজে লাগাতে পারবে না। অন্যদিকে যদি বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্যগুলো আমদানি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের বাজার থেকে কম দামের পণ্য কেনার সুযোগ হারাবে। এ ধরনের ব্যয়বহুল ক্রয় অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে।
অনেক ইউরোপীয় ও এশীয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি স্পষ্ট। বাংলাদেশ কি ওইসব দেশকেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো অগ্রাধিকারমূলক বাজার দিতে প্রস্তুত? সম্ভবত না। অতএব, বাণিজ্য বিষয়ে চিন্তাহীন প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশকে অন্যান্য দেশের চাপের মুখোমুখি করতে পারে।

সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের উচিত জাতীয় বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ক্রয়নীতির কাঠামোর অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লেনদেন করা। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আলোচনায় শুধু মার্কিন বাজারে আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামূলক স্বার্থ স্থান পাওয়া উচিত নয়। বরং চীন, ব্রাজিল, কানাডা, কাতার, জাপান, সৌদি আরব, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারের সঙ্গেও একই আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামূলক স্বার্থের কথা বিবেচনায় নিতে হবে। সরকারকে বিবেচনা করতে হবে, একক দেশকেন্দ্রিক বাণিজ্যচুক্তি স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বিভিন্ন প্রভাব ফেলতে পারে।

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক; এই নিবন্ধের ইংরেজি ভাষ্য দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত