শ্রমিকদের জন্য মাল্টিস্টোরিড আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলতে হবে – ড. মোয়াজ্জেম

Originally posted in The Business Standard on 20 September 2025

নিম্নমানের আবাসনে পোশাক শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গাদাগাদি করে থাকার কারণে শ্রমিকরা স্ট্রেস, উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও ঘুমের সমস্যায় ভোগেন, যা উৎপাদনশীলতাকেও প্রভাবিত করে।’

ছবি: টিবিএস

আশুলিয়ার একটি টিনশেড ঘরে থাকেন ৩০ বছর বয়সী পোশাক শ্রমিক শারমীন আক্তার। ১১০ স্কয়ারফুটের সেই কক্ষে ৯ স্কয়ারফুটের একটি জানালা ছাড়া ভেন্টিলেশনের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ঘর গরম থাকায় পর্যাপ্ত ঘুম হয় না তার। এর ফলেই প্রায় প্রতিদিনই মাথাব্যথায় ভোগেন তিনি, নিয়মিত খেতে হয় ওষুধও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোশাক শ্রমিকদের এমন নিম্নমানের আবাসন তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন জানান, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন না থাকায় এসব ঘরে অক্সিজেন ঘাটতি ও ইনডোর দূষণ বেড়ে যায়, যা সরাসরি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গাদাগাদি করে থাকার কারণে শ্রমিকরা স্ট্রেস, উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও ঘুমের সমস্যায় ভোগেন, যা উৎপাদনশীলতাকেও প্রভাবিত করে।’

ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই ধরনের টিনশেড রুমগুলোতে, যেখানে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থাও নেই, প্রচুর তাপ শোষণ করে থাকে। ফলে এসব রুমে কখনোই মানুষ স্বাস্থ্যকরভাবে বসবাস করতে পারে না। পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের অভাবের ফলে রুমে কার্বন ডাই-অক্সাইডও বেশি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, আর এমনটি হলে তা স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলার পাশাপাশি অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দিতে পারে।’

সরেজমিনে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রতিবেদক দেখেছে, আশুলিয়া ও সাভার এলাকায় হাজারো শ্রমিক এমন পরিবেশে বছরের পর বছর বসবাস করছেন। একটি বাড়িতে টিনের ছাউনি দেওয়া ২৫টি কক্ষ ভাড়া দেওয়া হয়েছে মাসে ৩৫শ টাকায়। প্রতিটি কক্ষে পরিবারভেদে দুই থেকে পাঁচজন থাকেন। রান্নার জন্য নেই আলাদা জায়গা, গলির ভেতরে বসানো গ্যাসচুলাতেই রান্না করতে হয়।

বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, অল্প বেতনে কাজ করায় উন্নত বাসায় থাকার সুযোগ নেই তাদের। তবে তারা মনে করেন, ভাড়ার তুলনায় বাসস্থানের মান আরও উন্নত হওয়া উচিত। অনেক বাড়িতে আবার যথেষ্ট টয়লেট বা গোসলখানাও নেই।

বাড়ির মালিকরা জানান, এসব টিনশেড বাড়ি নির্মাণে কোনো সরকারি অনুমতি লাগে না। একেকটি রুম নির্মাণেই তাদের খরচ হয় প্রায় ১০ লাখ টাকা, আর এ ভাড়াই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস।

একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পোশাক কারখানার সহকারী ব্যবস্থাপক বলেন, ‘দীর্ঘদিন শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে দেখেছি যে বেশিরভাগ শ্রমিকই আসলে প্রায়শই নানান অসুস্থতায় ভোগেন, যার প্রভাব পড়ে কারখানার উৎপাদনে। কখনো কখনো শ্রমিকদের অনুপস্থিতির হার এতটা বেশি হয় যে উৎপাদন ঠিক রাখতে আমাদের বিপাকে পড়তে হয়।’

শ্রমিকদের এমন অসুস্থতার জন্য তাদের বসবাসের স্থান অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে আমাদের শ্রমিকরা যেসব বাসাবাড়িতে বসবাস করেন তা কোনো মানুষের বসবাসের উপযুক্ত না।’

বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপতি তাসলিমা আখতার টিবিএসকে বলেন, ‘শিল্পাঞ্চলগুলোতে বাড়ি বা যে রাস্তাঘাট নির্মাণ হয়, তার কোনটাই পরিকল্পিত নয়। শ্রমিকদের জন্য আবাসনের দাবি আমরা অনেক দিন ধরেই করে আসছি, কিন্তু এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ আমরা এখনও দেখিনি। একদিকে বেতন কম, চিকিৎসারও সুযোগ নেই অন্যদিকে বাড়িভাড়া প্রতিনিয়ত বাড়ছে—পুরো বিষয়টিই আসলে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকার কারণে শ্রমিকরা একটি দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে গেছে। ফলে এই জায়গাটিতে সরকারের পরিকল্পনা প্রয়োজন এই শিল্পের স্বার্থেই। কারণ উৎপাদন ভালো রাখতে গেলে, শিল্পকে ভালো রাখতে গেলে শ্রমিকদের ভালো থাকা গুরুত্বপূর্ণ।’

বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু জানান, মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব হয় না। আবার বাসাবাড়িও পরিকল্পিত নয়, কোনো সরকারি নজরদারিও নেই।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, শ্রমিকদের ভাড়া স্কয়ারফুট হিসাব করলে রাজধানীর উন্নত এলাকার সমান। অথচ তাদের বেতন বা সামাজিক সুবিধা বাড়েনি। তিনি বলেন, ‘শ্রমিকরা সরকারি স্কুল, হাসপাতাল, বাজার—কোনোটাই কাছাকাছি পাচ্ছেন না। এতে তাদের জীবনে যেমন সমস্যা তৈরি হচ্ছে, তেমনি উৎপাদনেও প্রভাব ফেলছে।’

তিনি আরও বলেন, সরকারি নীতি সহায়তার পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে মাল্টিস্টোরিড আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলতে হবে। সঠিকভাবে ডিজাইন করা বাসায় ভেন্টিলেশন, রান্নাঘর, টয়লেট, বারান্দা থাকলে শ্রমিকরা ভালো জীবনযাপন করতে পারবেন।

ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘সুস্থ জীবনের জন্য অন্তত ২০০-২৫০ স্কয়ারফুট ভেন্টিলেশনসমৃদ্ধ কংক্রিট কক্ষ দরকার। অথচ শিল্পাঞ্চলে বিল্ডিং কোড মানা হয় না। তিনি মনে করেন, এ সমস্যার সমাধানে সরকার, মালিকপক্ষ ও বায়ারদের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।’