রাজস্বনীতি সম্প্রসারণমূলক আর মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক হলে তখন সেটা কাজে আসে না – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in আমাদের সময় on 11 July 2024

ব্যয়ের অঙ্কে মিলছে না আয়ের হিসাব

টানা ১৬ মাস ধরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত জুন মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমার পরও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে। সহজ করে বললে, দৈনন্দিন জীবনে খাবার, পোশাক, যাতায়াত, চিকিৎসা, পরিষেবাসহ বিভিন্ন খাতে আগের চেয়ে বর্তমানে বেশি খরচ করতে হচ্ছে। অথচ, এর বিপরীতে আয় সেভাবে বাড়েনি। অন্যদিকে, পয়েন্ট টু পয়েন্ট হিসাবে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে গড় মজুরি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির মধ্যকার ব্যবধান ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। আয়-ব্যয়ের এই ঘাটতি সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার খরচের অঙ্ককে আরও কঠিন করে তুলেছে। প্রতিটি খাতে বাড়তি খরচ সামাল দিতে খেই হারিয়ে ফেলছে সাধারণ মানুষ।

রাজধানীর কদমতলী এলাকার বেসরকারি চাকরিজীবী মো. এনামুল হকের মাসিক বেতন ৩০ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়া, খাবার, পোশাক, যাতায়াতের মতো অত্যাবশকীয় খরচ মেটাতেই বেতনের প্রায় সবটুকু ফুরিয়ে যায় তার। এরপর চিকিৎসাসহ অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে হয় বলে জানান তিনি। এনামুল বলেন, দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে বেতন বাড়েনি। সীমিত বেতনের টাকায়

কোনটা রেখে কোনটা করব ভেবে পাই না। খাবার, পোশাকে খরচ কমিয়েছি, বিনোদন বাদ। তারপরও মাসের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছি না।

একই এলাকার বাসিন্দা নাসিমা আক্তারের কাছে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। মধ্যবয়সী এ নারী শ্রমিক বলেন, ‘কারখানায় কাজ করে ৮ হাজার টাকা বেতনের পুরোটাই খরচ হয়ে যায় বাড়িভাড়া আর বাজারের পেছনে। লেখাপড়া বাদ দিয়ে ছেলেটারেও কাজে দিয়েছি। দুই জনের আয়ের টাকাতেও জামাকাপড়, ওষুধসহ অন্যান্য খরচ মিটছে না। একটা করতে গেলে আরেকটা বাদ দিতে হয়।’

সম্প্রতি প্রকাশিত বিবিএসের মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদন বলছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ কমার পরও সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। আগের মে মাসে যা ছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। গত জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও কিছুটা কমেছে। তবে এখনো তা ১০ শতাংশের উপরেই অবস্থান করছে। জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার নীতি সুদহার বাড়ানোসহ সুদের হার বাজারভিত্তিক করার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে কমছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক সময়ে সঠিক নীতি গ্রহণ না করায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বৈশ্বিক কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করলেও এখন অভ্যন্তরীণ সংকটের ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। শুরুর দিকে প্রথাগত নিয়মের বাইরে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা কাজে আসেনি। সরকার এখন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সময় লাগবে। শুরু থেকেই যদি সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হতো তাহলে এত বেগ পেতে হতো না।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় সরকার মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও পরে তা বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক বেশি, প্রায় ১০ শতাংশ। বিবিএসের হিসাব বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। ২০২৩ সালের মার্চে দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে পৌঁছায়। এরপর থেকে মূল্যস্ফীতির হার আর ৯ শতাংশের নিচে নামেনি।

এটি বেশ উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। একই সঙ্গে নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৬ শতাংশ বাস্তবসম্মত নয় বলেও মনে করেন তিনি। আমাদের সময়কে বলেন, জীবনযাপনের প্রত্যেকটি খাতে খরচ বেড়ে গেছে। মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। শুধুমাত্র একটি পলিসি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে না। বাজেট কেমন হলো, রাজস্বনীতি, বাণিজ্যনীতি কেমন হলো, বাজার ব্যবস্থাপনা- সব কিছু মিলে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, রাজস্বনীতি সম্প্রসারণমূলক আর মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক হলে তখন সেটা কাজে আসে না। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।

মূল্যস্ফীতি গণনায় পরিসংখ্যাণ ব্যুরো খাবার, পোশাক, যাতায়াত, পরিষেবা, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ মোট ১২টি খাতের পণ্যমূল্য গণনা করে। বিবিএসের চলতি বছর জুন মাসের মূল্যস্ফীতির খাতওয়ারি চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট হিসাবে খাবারে ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ, পোশাকে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ, যাতায়াতে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ, আসবাবসহ গৃহস্থালি পণ্যে ১১ দশমিক ৩৩ শতাংশ, চিকিৎসায় ১৩ দশমিক ০১ শতাংশ এবং বিনোদনে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩ সালের জুনে এসব খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ, ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ, ৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ, ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ১০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে এ বছর জুনে এসব খাতে খরচের চাপ আরও বেড়েছে।

এই অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান বাড়াতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, মানুষের আয় সেভাবে না বাড়ায় ক্রয়ক্ষমতা কমছে। বাড়তি খরচ সামাল দিতে তাদের সঞ্চয় কমে যাচ্ছে। অন্য অনেক খাতের খরচ কমিয়ে ফেলতে হচ্ছে। ফলে জীবনযাপনের মান কমে যাচ্ছে।