Originally posted in abnews24.com on 5 July 2022
গাড়ি কেনা বন্ধ, ভাতা স্থগিত, সরকার ব্যয় কাটছাঁট করছে কেন?
ব্যয় সংকোচনের লক্ষ্যে নতুন অর্থবছরে সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের জন্য যানবাহন কেনা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন কমিটির সম্মানী ভাতাও স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
রবিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখার এক পরিপত্রে এই সিদ্ধান্তগুলো জানানো হয়। পরিপত্র উল্লেখ করা হয় যে ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধনের লক্ষ্যে’ এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
যানবাহনের পাশাপাশি বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, কম্পিউটার বা আসবাব কেনার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের অর্ধেকের বেশি ব্যবহার করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে ওই পরিপত্রে।
এ ছাড়া ‘শুধু জরুরি ও অপরিহার্য’ ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা আপ্যায়ন বা ভ্রমণের জন্য বরাদ্দ অর্থেরও অর্ধেকের বেশি ব্যয় করতে পারবেন না।
এর আগে মে মাসে পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়।
সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করার পেছনে কারণ হিসেবে সেসময় বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টার কথা জানিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়।
‘মূল্যস্ফীতি’ মোকাবেলার চেষ্টা?
বাংলাদেশে সরকারি ব্যয়কে কেন্দ্র করে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। বাজারমূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি দামে পণ্য বা সেবা কেনা, প্রকল্পের অর্থ খরচ করে অহেতুক বিদেশ ভ্রমণ করার মতো অভিযোগের খবর নানা সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে সমালোচনাও কম নেই।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ব্যয় সঙ্কোচনের জন্য এই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম এই উদ্যোগকে বর্ণনা করছেন- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ‘সতর্কতামূলক’ পদক্ষেপ হিসেবে।
শামসুল আলম বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি মোকাবেলার জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটও আমরা সংযত করেছি। ব্যয় বাড়ানো হলে অনেক সময় তা মূল্যস্ফীতিকে ইন্ধন যোগায়, তাই এবারের বাজেটের আকারও স্বাভাবিক সময়ে যতটা বড় হতে, তার চেয়ে কম হয়েছে।’
তার মতে, সরকারি ব্যয় সংকোচনের জন্য নেয়া সাম্প্রতিক পদক্ষেপ বাজেটের ‘মূল্যস্ফীতি মোকাবেলার উদ্দেশ্যে’ নেয়া নীতির ধারাবাহিকতায় নেয়া হয়েছে।
শামসুল আলম বলেন ব্যয় কম করা সম্ভব হলে গুরুত্বপূর্ণ খাতে বেশি পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া সম্ভব হবে, যা দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে।
মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় প্রয়োজনে পরবর্তীতে এই ধরণের আরও পদক্ষেপও নেয়া হতে পারে বলে জানান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী।
ব্যয় কমিয়ে কি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?
নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের দাম সবার নাগালের মধ্যে রাখা, অতি জরুরি সেবার ক্ষেত্রে বা অভ্যন্তরীণ উৎপাদন উৎসাহিত করতে কোনো দেশের সরকার বিশেষ পণ্য বা সেবার ওপর ভর্তুকি দিয়ে থাকে।
বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দাম বেড়ে গেলে অনেক সময় সরকার এসব পণ্যের ওপর ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় যেন সব ধরণের আয়ের মানুষ সেসব পণ্য ও সেবা নিতে পারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মন্তব্য করেন, এরকম ক্ষেত্রে নির্ধারিত কিছু খাতে ব্যয় কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি রাখা সম্ভব।
‘যে ধরনের ব্যয়ের ফলে উৎপাদন বা কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়বে না, সারা পৃথিবীতেই সেই ধরণের ব্যয় সংকোচনের জন্য নানারকম উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়, যখন অনুৎপাদনশীল ব্যয় ও বিলাসী পণ্য বা সেবার ওপর ব্যয় সঙ্কোচন করতেই হবে’, বলেন ফাহমিদা খাতুন।
ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করেন নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে এবং তারা যেন সুলভ মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারে সরকারেরই সেই সহায়তা দেয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্য ও পরিবহন সেবা যেন নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকে, তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার কৃষি ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দিয়ে থাকে।
তিনি বলেন, ‘এবার বাজেটের মধ্যে প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকির হিসাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু যেভাবে আমরা দেখছি যে মূল্যস্ফীতির চাপ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে, সেক্ষেত্রে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।’
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘সে সময় অতিরিক্ত ভর্তুকি দেয়ার জন্য বর্ধিত ব্যয় প্রয়োজন হবে। কিন্তু আমরা যদি অনুৎপাদনশীল বা কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় সংকোচন না করি, তাহলে অতিরিক্ত ভর্তুকির অর্থ জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়বে।’
ফাহমিদা খাতুন ধারণা পোষণ করেন যে সারাবিশ্বে যেভাবে মূল্যস্ফীতি চলছে, সেই প্রেক্ষিতে সামনে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়ানো প্রয়োজন হতে পারে।
‘সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে যে বাড়তি অর্থ প্রয়োজন হবে, তা যেন আমাদের অর্থনীতির ভেতর থেকেই সৃষ্টি হয় তা নিশ্চিত করতেই সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে।’