মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে এটা অবাস্তব – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in voabangla on 19 June 2024

বাংলাদেশে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। জাতীয় সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনা চলমান রয়েছে। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেটটি কেমন হলো– এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ এবং অংশীজনের মতামত জানতে চেয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা।

নানান অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে কেমন হলো এবারের প্রস্তাবিত বাজেট? এ নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা হয় ভয়েস অফ আমেরিকার।

ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মলয় বিকাশ দেবনাথ।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে ইতিবাচক দুটি দিক কোনগুলো? কেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বর্তমানে যে অর্থনৈতিক সংকট যাচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে সেটার স্বীকৃতি আছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক। অপরটি হলো, সরকার কম করে হলেও সামষ্টিক অর্থনীতিতে সঞ্চয়ী বা সংযমী হওয়ার চেষ্টা করেছে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ এবারের বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ১৪ শতাংশ। এর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে? এ খাতে খরচ কমিয়ে আনার জন্য সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া প্রয়োজন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: ঋণ নেওয়া হলে ঋণ পরিশোধ করতে হবে, এটা স্বাভাবিক বিষয়। এখানে ঋণ পরিশোধের জন্য যে বাজেট রাখা হয়েছে, তা থেকে কমানোর সুযোগ কম। কেননা, এটা নির্দিষ্ট করা আছে কোন সময়ে কত পরিশোধ করতে হবে। তবে যেটা শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন, আগামী দিনে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কতটা সংযমী হবো। পাশাপাশি কোন উৎস থেকে ঋণ নেবো, কোন প্রকল্পে ব্যবহার করব– এ বিষয়ে আরও বিশ্লেষণের সুযোগ আছে। এবং একটি টেকসই ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যাওয়া। যেন ঋণ ক্রমান্বয়ে ঝুঁকিতে পরিণত না হয় যা ইতোমধ্যে হয়েছে। কেননা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ঋণের ওপর করতে হচ্ছে এবং ঋণ করে ঋণ শোধ করছি। অর্থাৎ ঋণ ব্যবস্থাপনাটা একটা উন্নয়ন কৌশলের বড় বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সরকার সেদিকে মনোযোগ দেবে, এটাই প্রত্যাশা।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লক্ষ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। ঘাটতি মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ খাত থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হবে তার ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকাই ব্যাংকিং খাত থেকে সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার নিজেই যদি এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়, তাহলে কী ধরনের প্রভাব দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ওপর পড়বে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: ঘাটতিটা আসলে খুব বড় বিষয় নয়। কেননা, এটা ৪ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে আছে। এটা নিঃসন্দেহে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। বিষয় হলো, ঘাটতিটা কীভাবে অর্থায়ন করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬০ শতাংশ; যার বেশির ভাগ ব্যাংকিং খাত থেকে যাবে বলে আলোচনা আছে। যদিও ঘাটতি কমানোর সুযোগ ছিল। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যে সমস্ত প্রকল্প এখন না করলে হয়, সেগুলো স্থগিত করা। একইভাবে পরিচালন ব্যয়ের ভেতরে যেমন দামি গাড়ি কেনা, বড় বড় স্থাপনা– যা হয়তো এখন স্থগিত করা যেত। অর্থাৎ সাশ্রয়ী হবার সুযোগ ছিল। কিন্তু অর্থায়নের একটা বড় অংশ হলো, এখন ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করা হচ্ছে এবং খুব উচ্চ সুদে। এটা আরেকটা নতুন উৎস হচ্ছে করের বোঝা বাড়ার। আমরা একদিকে সঞ্চয়পত্র থেকে বের হচ্ছি, অন্যদিকে ট্রেজারি বন্ডের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি। এটা আগামী দিনে আবার কষ্ট দেবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেট বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বড় বিষয় হলো, বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাচ্ছে। এর মানে বিনিয়োগ কমবে, কর্মসংস্থান কমবে। বিনিয়োগ কম হবার জন্য প্রবৃদ্ধি কমবে। বিনিয়োগ করার জন্য এখন পরিবেশ খুবই প্রতিকূল। একদিকে কর আহরণের জন্য বিস্তৃতি বাড়াচ্ছে, ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া যাচ্ছে না, অপরদিকে আমদানির জন্য বিদেশি মুদ্রা দেওয়া যাচ্ছে না। এসব কারণে কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব আসবে অবধারিত। আমার কাছে মূল চিন্তার বিষয় যুব বেকারত্ব এ সময় বাড়বে। একমাত্র বড় কর্মসংস্থানের খাত হলো বিদেশে শ্রমিক পাঠানো। কিন্তু সেটা সমাজের একটা অংশমাত্র। কিন্তু শিক্ষিত যুবসমাজের জন্য আগামীতে একটা বড় চ্যালেঞ্জ কর্মসংস্থান।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে এবারের বাজেটে। অনেকে এ নিয়ে সমালোচনা করে বলছেন, বৈধ আয়ের ক্ষেত্রে যেখানে সর্বোচ্চ আয়কর ৩০ শতাংশ, সেখানে কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট ১৫ শতাংশ। ফলে এতে কর ফাঁকিকে উৎসাহিত করবে। নৈতিকতার প্রশ্নটি বাদ রেখেও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ কতটা ইতিবাচক ফল দেবে বলে আপনি মনে করেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এর মূলত চারটি সমস্যা। যে কারণে কালো টাকা সাদা করা হচ্ছে, এটা কোনো যৌক্তিক কারণ হতে পারে না। জমির মৌজামূল্য বাড়িয়ে অর্থাৎ বাজারদর অনুযায়ী করলে সেখানে করের হার কমিয়ে দিলে ক্রেতা-গ্রহীতার ওপর চাপ পড়বে না। দ্বিতীয়টি হলো, সাধারণ জনগণের জন্য ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে যারা অদৃশ্য উপায়ে অর্থ উপার্জন করেছে, তাদের জন্য ১৫ শতাংশ– এটা নৈতিকতা বিরোধী। আইন ভঙ্গ করে উপার্জন করলেও সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না– এটা মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থি। আরেকটি হলো, বাংলাদেশ সরকার দ্বিপাক্ষিক কিংবা বহুপাক্ষিক আলোচনায় অনেক দেশকে কথা দিয়েছে– তারা দুর্নীতিবিরোধী আচরণে থাকবে। শেষেরটি হলো, রাজনৈতিক যে অঙ্গীকারের ভিত্তিতে এ দল নির্বাচনে গিয়েছিল, এখানে তারও লঙ্ঘন হয়েছে। কথায় আছে– ‘জাতও গেল, পেটও ভরল না’।

ভয়েস অফ আমেরিকা: মূল্যস্ফীতি গত দু’বছর ধরে ৯ শতাংশের ওপর। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এটি কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব? এ জন্য বাজেট ঘাটতি কমানো ও কৃচ্ছসাধনের ওপর মন্ত্রী জোর দিয়েছেন? এগুলো বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা সরকারের কতটা রয়েছে? মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, এটা অবাস্তব। সব থেকে বড় কথা হলো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনো সুগঠিত, সুচিন্তিত, বাস্তবসম্মত কৌশল বাজেটে নেই।

ভয়েস অফ আমেরিকা: জনপ্রশাসন খাতে খরচ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা; যা শীর্ষ পাঁচ ব্যয় বরাদ্দ খাতের একটি। অথচ আমরা প্রতিবছরই দেখি বাজেট বাস্তবায়ন ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। যার জন্য জনপ্রশাসনের অদক্ষতাকে সমালোচকরা একটি প্রধান কারণ বলে মনে করে থাকেন। বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধি না করে জনপ্রশাসন খাতে এ বিপুল বরাদ্দ কতটা যৌক্তিক? বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এখানে বড় সংকট হচ্ছে জনপ্রশাসনের কোনো জবাবদিহিতা নেই। আর এটি না থাকলে বা এখানে সংস্কার না করা হলে দক্ষতা বাড়বে না, অপচয় কমবে না, সর্বোপরি দুর্নীতিও কমবে না। বাজেটে এ ধরনের উদ্যোগের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। এতে অন্য যে নীতিগুলোর উল্লেখ আছে, তারও কার্যকারিতা থাকবে বলে আমার মনে হয় না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: করের আওতা না বাড়িয়ে যারা কর দেয়, তাদের ওপরই করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে এবারের বাজেটে, বলে সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এখানে দুটো সমস্যা হয়েছে। এক হলো, যারা প্রত্যক্ষ কর দেয় তাদের আওতা না বাড়িয়ে যারা কর দেয়, তাদের প্রান্তিক হার বাড়িয়েছেন। দ্বিতীয়ত, যে কর আসবে তার দুই-তৃতীয়াংশ আসবে পরোক্ষ কর থেকে অর্থাৎ যাদের কর দেবার সামর্থ্য কম তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।

ভয়েস অফ আমেরিকা: রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য সব ক্ষেত্রেই অভিন্ন ভ্যাট হার নির্ধারণ করাটা কতটা কার্যকর হবে? এবারেই কি এটি করা উচিত ছিল? কতদিনের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জনের টার্গেট নেওয়া উচিত?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সামগ্রিকভাবে সময় নিয়ে হলেও একটা অভিন্ন ভ্যাট আসতে হবে। তবে পৃথিবীর সব দেশেই এক ধরনের একক ভ্যাট চালু থাকলেও জনগুরুত্বপূর্ণ অনেক খাতে রেয়াদ দেওয়া হয়; যেমন– শিশুখাদ্যে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আলাদাভাবে জেন্ডার বাজেট করার দাবি অনেকে করছেন। আপনি কি একমত? জেন্ডার বাজেট হলে কী ধরনের সুবিধা হবে? জেন্ডার বাজেটে কোন কোন দিকে প্রায়োরিটি দিতে হবে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: জেন্ডার বাজেট আগের চেয়ে ভিন্ন হয়েছে। এটা ভালো। কিন্তু সমস্যা হলো বাজেট দিলাম, মূল্যায়ন করলাম না– সেটা হবে না। আগামী দিনে বাজেটের ভেতর জেন্ডার বাজেটের বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট খাতওয়ারি বিভাজিতভাবে মূল্যায়ন রাখতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয় না। কেন? এবারের বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট? এর তিনটি ইতিবাচক দিক বলবেন? প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দর ক্ষেত্রে কোন কোন দিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, যা এবারের বাজেটে সেভাবে দেওয়া হয়নি।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমাদের দেশে প্রতিরক্ষা খাতে বাজেটের একটা বড় অংশ ব্যবহার করতে হয় শান্তিরক্ষীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য। এবং এটা এখন জাতীয় না, আন্তর্জাতিকভাবে এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিরা প্রতিরক্ষা বাজেটের পরিবীক্ষণ করেন। আমাদের দেশে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তা দেখভাল করে কিনা, আমার জানা নেই। কেননা, এটা দৃশ্যমান নয়। তবে এটা থাকা প্রয়োজন।