Originally posted in প্রথম আলো on 13 December 2022
ব্যাংকে টাকা রেখে ঠকছেন মানুষ
ঋণের সুদহার এখন ৯ শতাংশে নির্দিষ্ট করে রেখেছে সরকার। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তা বাড়ানো দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্যাংকে টাকা রেখে ঠকছেন আমানতকারীরা। ব্যাংক যে হারে সুদ দিচ্ছে, তার তুলনায় মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। এতে প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এখন ব্যাংকে অর্থ রাখা মানেই লোকসান।
এমনিতেই ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কম। এ অবস্থায় আমানত রেখে ঠকলে মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা আরও কমে যাবে। বিশ্বব্যাপী একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে সংকটের সময় সাধারণত মানুষ ব্যাংকে অর্থ রাখে না, বরং জমি বা বাড়ির মতো অনুৎপাদনশীল খাতে তারা ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। এতে অর্থনীতিতে সংকট আরও বাড়ে।
সুদহার জোর করে নয়-ছয় করে রাখার কারণেই সাধারণ মানুষের এই বিপত্তি। ২০২০ সালের শুরুতে সরকার ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। সেই হার এখনো বহাল আছে। অথচ বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় সংকট চলছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে দেশগুলো সুদহার বাড়িয়েছে। ব্যতিক্রম তুরস্কসহ কয়েকটি দেশ। আর সুদহারে কোনো পরিবর্তনই আনেনি বাংলাদেশ।
মূলত কিছু ব্যবসায়ীকে খুশি করতেই ঋণের সুদহার কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে ঋণ নেওয়া সস্তা হয়ে গেছে। এতে মূল্যস্ফীতির মধ্যেও মুদ্রা সরবরাহ বাড়ছে। সেই ঋণ দেওয়া হচ্ছে বেনামে ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে, এর বড় অংশ খেলাপি হচ্ছে, আরেক অংশ হচ্ছে পাচার।
এ অবস্থায় সুদহার বাড়ানোর বিকল্প নেই বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সুদহার কিছুটা বাড়ানোর এখনই সময়। কিন্তু সরকার অনড়। সরকারের নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ মনে করে, সুদহার বাড়ালে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবশ্য সরকারের মধ্যেও ভিন্নমত আছে। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম শামসুল আলম সুদহার বাড়ানোর পক্ষে কথা বলেছেন। তবে সূত্রগুলো বলছে, ব্যবসায়ীদের তুষ্ট করতেই সুদহার কমানো হয়েছিল। সুতরাং নির্বাচনের আগের বছরে সরকার সেই পথ থেকে সরে আসতে চাইছে না।
যেভাবে সাধারণ মানুষ ঠকছে
অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় সুদের হার কম হলে তখন প্রকৃত সুদের হার ঋণাত্মক হয়। এখন যেমন হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১০। আর সে সময়ে দেশের ব্যাংক খাতের আমানতের গড় ভারিত (ওয়েটেড এভারেজ) সুদহার ছিল ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। ফলে একজন আমানতকারীর প্রকৃত সুদহার ছিল ঋণাত্মক ৫ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ (৯.১০-৪.০৯=৫.০১)। এর অর্থ হচ্ছে, ব্যাংকে ১০০ টাকা রাখলে এক বছর পর আমানতকারী প্রকৃতপক্ষে পাচ্ছেন ৯৪ টাকা ৯৯ পয়সা। অর্থাৎ প্রকৃত সুদের হার কমে গিয়ে বছর শেষে তাঁর মূল আমানতও ৫ টাকা ১ পয়সা খেয়ে ফেলছে মূল্যস্ফীতি। এখানেই শেষ নয়। একজন আমানতকারীর সুদ আয়ের ওপর দিতে হয় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত আয়কর। ফলে প্রকৃত আয় আসলে আরও কমে যায়। নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে। ফলে পরিস্থিতি প্রায় একই রকম আছে।
ব্যাংকগুলোর কী হাল
ব্যাংকগুলোও সুদহার নিয়ে বিপাকে আছে। দেশের ভালো ১৩টি বেসরকারি ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, তাদের এক মাস মেয়াদি স্থায়ী আমানতে সুদের হার অনেক কম। এ ক্ষেত্রে ১ শতাংশ সুদ দিচ্ছে এমন ব্যাংকও আছে। তবে বেশির ভাগেরই সুদহার ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে। আর দুটি ব্যাংক দিচ্ছে এর চেয়ে কিছু বেশি। তবে তিন মাস, ছয় মাস ও এক বছর মেয়াদি স্থায়ী আমানতই ব্যাংকে বেশি রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে সুদহার ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে। এ ছাড়া আছে সঞ্চয়ী আমানত, যার সুদহার অনেক কম, দেড় থেকে সাড়ে ৩ শতাংশের মধ্যে। কেবল দুটি ব্যাংক সঞ্চয়ী আমানতে এর থেকে কিছু বেশি সুদ দিচ্ছে।
আমানত সংগ্রহে ব্যাংকগুলোর খরচ আছে। ১৩টির মধ্যে কেবল ১টি ব্যাংকের আমানত সংগ্রহে ব্যয় হয় ২ শতাংশের কম। বেশির ভাগ ব্যাংকের এই ব্যয় ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যেই অর্থাৎ ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহে ব্যয় হয় ৩ থেকে ৪ টাকা। সুতরাং আমানত সংগ্রহের খরচের সঙ্গে সুদ দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে ৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ দিয়েও ব্যাংক তার একটি বড় অংশ ফেরত পাচ্ছে না। ফলে আয়ের জন্য ব্যাংকগুলোকে এখন নির্ভর করতে হচ্ছে সুদবিহীন আয়ের দিকে। এতে বাড়ছে ব্যাংকের অন্যান্য সেবার মাশুল।
সঞ্চয়ে উৎসাহ নেই
ব্যাংকের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না বলেই গত এক মাসে ব্যাংক থেকে অনেকেই আমানত তুলে নিয়েছেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দৈনন্দিন খরচ মেটাতেও অনেকে সঞ্চয় ভাঙছেন। আবার ব্যাংক খাত নিয়ে নানা গুজব ও আতঙ্কের কারণেও কেউ কেউ অর্থ তুলে নিয়েছেন। এ অবস্থায় আতঙ্কিত না হতে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রধানমন্ত্রীও গুজব বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সদ্য বিদায় নেওয়া মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস গত সপ্তাহে বিআইডিএসের এক সেমিনারে জানিয়েছেন, এ সময়ে গ্রাহকেরা ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছিলেন। সেই অর্থ আবার ব্যাংকে ফেরত এসেছে বলেও তিনি দাবি করেছেন।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, মানুষকে সঞ্চয়ী করতে হলে প্রণোদনা দিতে হবে। খারাপ সময়ে এই প্রণোদনা দেওয়া আরও জরুরি। অথচ এখন ব্যাংক থেকে দূরে রাখা হচ্ছে আমানতকারীদের। সুদ দেওয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম হারে। সঞ্চয় করতে নিরুৎসাহিত হওয়ার অর্থই হচ্ছে অর্থনীতিতে বিনিয়োগযোগ্য মূলধন কমে যাওয়া। আর আমানত কমলে ব্যাংকের তারল্য-সংকট বৃদ্ধি পাবে। তাতে উৎপাদন বা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডেও ভাটা পড়ে, মন্দাও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
অকার্যকর মুদ্রানীতি
বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে সমস্যা এখন মূল্যস্ফীতি। এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মরিয়া প্রায় সব দেশ। এ জন্য সবাই বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে দিতে চাইছে। এ জন্য বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়াতে মুদ্রানীতিকেই মূলত ব্যবহার করছে, বাড়াচ্ছে নীতি সুদের হার। এর প্রভাবে ঋণের সুদের হারও বাড়ছে। কয়েকটি দেশ অবশ্য ভিন্ন পথে গেছে। যেমন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান মনে করেন, সুদহার বৃদ্ধি নয়, বরং কমানোই সমাধান। ফলে তাঁর চাপে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার কমিয়ে দিচ্ছে। এরদোয়ানের লক্ষ্য হচ্ছে চলতি বছরের মধ্যে সুদহার ৯ শতাংশে নিয়ে আসা।
সুদের হার কমায়নি জাপানও। দেশটির মৌলিক নীতিই হচ্ছে সুদহার শূন্য রাখা। সেই নীতিতে এখনো তারা বহাল। যদিও জাপানের মূল্যস্ফীতির হার এক বছরের মধ্যে আধা শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। সুদহার কমিয়েছে রাশিয়াও। এমনিতেই যুদ্ধের কারণে তারা সংকটেই আছে, রাশিয়ার মূল্যস্ফীতি এখন বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। আরেক ব্যতিক্রম হচ্ছে বাংলাদেশ।
অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে কার্যকরী পথ হচ্ছে মুদ্রানীতিকে ব্যবহার করা। কাজটি স্বাধীনভাবে করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক স্বেচ্ছায় তার প্রধান অস্ত্র মুদ্রানীতিকে অকার্যকর করে রেখেছে। এতেই দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের সংকট। এর আগে টাকার মূল্যমান জোর করে ধরে রেখেও সমস্যা তৈরি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
তখন আর এখন
২০২০ সালের এপ্রিলে সুদের হার নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সে সময় দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ। পরবর্তীতে তিন মাস ও এর বেশি মেয়াদের আমানতে সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হতে পারবে না বলে গত বছরের আগস্টে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন সুদের হার নির্ধারণে আগের তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির হারকে বিবেচনায় নিতেও বলা হয়েছিল। সে সময়েও দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৫ শতাংশের কিছু বেশি। আর সেই মূল্যস্ফীতি এখন ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই নির্দেশনাও অকার্যকর হয়ে গেছে, ব্যাংকগুলোও আর মানছে না।
কী করতে হবে
অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, সুদহার যে আজীবনের জন্য একই রকম রাখতে হবে, তা ঠিক নয়। বরং যখন মূল্যস্ফীতি কম ছিল, তখন সুদহার কমানো হয়েছে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এখন যেহেতু আমদানি করা ও অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি দুটিই বেশি, এ রকম অবস্থায় আমানতকারীদের প্রকৃত আয় ঋণাত্মক হয়ে গেছে। ফলে সঞ্চয় করার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। সুতরাং বিষয়টি অবশ্যই পর্যালোচনা করা দরকার।
মোস্তাফিজুর রহমান এ নিয়ে প্রথম আলোকে আরও বলেন, আমানতের সুদহার বাড়াতে হলে ঋণের সুদহারও বাড়াতে হবে। সুতরাং আমানতের সুদহার ৯ শতাংশ করতে হলে ঋণের সুদ ১২ বা ১৩ শতাংশে আনতে হবে। এর একটা প্রভাব তো বিনিয়োগের ওপর পড়বেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। তা ছাড়া সুদহার বিনিয়োগের অনেকগুলো পূর্বশর্তের একটি। আরও অনেক বিষয়ের ওপরই নির্ভর করে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। সুতরাং ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার অন্যান্য ব্যয় কমাতে হবে, বাধাগুলো দূর করতে হবে। সেটা না করে কেবল সুদের হার এখনকার মতো রেখে দিলে আরও অনেক সমস্যার উদ্ভব হবে। যেমন বিনিময় হার এক জায়গায় রেখে দেওয়ার ফল আমাদের ভোগ করতে হয়েছে। সুতরাং সুদহারকে এখন বাজার ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করা দরকার।