মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমলেও স্তর অনেক উপরে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in দেশ রূপান্তর on 7 January 2025

মূল্যস্ফীতিতে আশা জিডিপি চ্যালেঞ্জে

মূল্যস্ফীতিতে আশা জিডিপি চ্যালেঞ্জে

দেশে দীর্ঘদিন ধরেই লাগামহীন মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া। সদ্য সমাপ্ত হওয়া ২০২৪ সালের শুরুর দিকে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতা আর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রভাবে বছর জুড়েই মূল্যস্ফীতির চাপে চিড়েচ্যাপ্টা দেশের মানুষ। হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির বোঝা টানতে হিমশিম খাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে সরকারের প্রচেষ্টার প্রভাব কিছুটা পড়তে শুরু করেছে। গত ডিসেম্বরে কিছুটা কমেছে মূল্যস্ফীতি। যদিও ২০২৪ সালের গড় মূল্যস্ফীতি ১৩ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আবার গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি কমলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি। সব মিলে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বিদায়ী ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের মূল্যস্ফীতি তথ্য প্রকাশ করেছে। একই দিনে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের জিডিপির তথ্য প্রকাশ করা হয়। বিবিএসের তথ্য বলছে, জাতীয়ভাবে ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৬৩ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।

এ ছাড়া খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ।

বিবিএস জানায়, সারা দেশের ৬৪টি জেলার ১৫৪টি হাটবাজার থেকে নির্ধারিত সময়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ডিসেম্বর ২০২৪ মাসের সিপিআই (কনজুমার প্রাইস ইনডেক্স) প্রস্তুত করা হয়েছে। বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে দেশে সাধারণ মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের যেই পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, গত মাসে পেতে অতিরিক্ত ১০ দশমিক ৮৯ টাকা খরচ করতে হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ইতিপূর্বে দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে মূল্যস্ফীতির হিসাব দেখানো হচ্ছিল, তা প্রকৃত তথ্য ছিল না। তবে এখন বিবিএস একটা স্বচ্ছতার সঙ্গে এই হিসাবগুলো করছে। যেহেতু প্রকৃত তথ্য এখন বের হয়ে আসছে সে কারণে এই বছরের হিসাবটা বেশি আসছে। কারণ তারা আগে যে কমিয়ে দেখানোর প্রবণতা ছিল সেটা থেকে তারা বের হয়ে আসছে। তিনি আরও বলেন, ডিসেম্বরে যে কিছুটা কমলেও এতে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু তৈরি হয়নি। মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অবনমন ধারাবাহিকভাবে গত তিন বছরে হয়েছে, মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমলেও এর স্তর এখনো অনেক ওপরে। যেহেতু প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত আসতে শুরু করেছে আমরা আশা করছি এখন আমদানি-রপ্তানি সেভাবে করা হবে এতে সুফল পাওয়া যাবে। কিছু আশার বিষয়, আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু জিনিসের দাম কমতির দিকে বিশেষ করে তেলের দাম, এটা আমদানিকৃত পণ্যে কিছুটা স্বস্তি দেবে। এ ছাড়া আমাদের ডলার পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হওয়ার কারণে এলসি খোলা স্বাভাবিক হচ্ছে। ফলে সরবরাহ ভালো হবে। সামনে কিছুটা স্বস্তি ফিরবে।

বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর চেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি দেখা গিয়েছিল ২০১১ সালে, ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০২৩ সালে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিবিএস।

২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল দেশে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনের পর টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকারও গঠন করে। কিন্তু বছরের মাঝামাঝিতে এসে চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। এরপর অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে চেষ্টা চালালেও এখনো মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে হিমশিম খাচ্ছে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশে একটা সংকট চলছে এটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিগত কভিড পরিস্থিতির সময় সারা পৃথিবী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যে পথে হেঁটেছে বাংলাদেশ তার উল্টো পথে চলেছে। তার প্রভাবে বর্তমানে এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এর থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে। যদিও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখন মুদ্রানীতি অনেকটা টাইটভাবে চলছে। তারপরও বাংলাদেশে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের দেশের একটা বড় সমস্য হচ্ছে ‘লোভ্যস্ফীতি’। আমাদের ব্যবসায়ীদের লোভ অনেক বেশি। অল্প লাভে তাদের হয় না। মূল্যস্ফীতির আরেকটি বড় কারণ লুটপাট-চাঁদাবাজি। যা এখনো কমেনি। সবকিছুর প্রতিফলনে আজকে মূল্যস্ফীতির এই অবস্থা। লুটপাট-চাঁদাবাজি না থামাতে পারলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।

এদিকে ডিসেম্বর মাসে সামান্য বেড়েছে মজুরি হার। এ মাসে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ, যা নভেম্বর মাসে ছিল ১ দশমিক ১০ শতাংশ। এ ছাড়া কৃষি খাতে মজুরি হার সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ, যা তার আগের মাসে ছিল ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। শিল্প খাতে মজুরি হার সামান্য বেড়ে ডিসেম্বরে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা নভেম্বর মাসে ছিল ৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। সেবা খাতেও সামান্য বেড়ে মজুরি হার হয়েছে ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ, যা নভেম্বর মাসে ছিল ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ।

অন্যদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার কমে ১.৮১ শতাংশে নেমেছে, যা গত ১৫ প্রান্তিক কিংবা প্রায় চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২০-২১ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে ০.৯৩ শতাংশে নেমেছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও পরবর্তী পরিস্থিতির কারণে শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।

চলতি অর্থবছরের জিডিপির সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, জিডিপির আকার ১২ লাখ ৬৬৫ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ছিল ১৯ লাখ ৭০৩ হাজার ১০ কোটি টাকা। ওই সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার ছিল ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ। কৃষি, শিল্প ও সেবা এ তিন খাতের উপাত্ত নিয়ে জিডিপি প্রকাশ করা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে কৃষি খাতে, ০.১৬ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ০.৩৫ শতাংশ। শিল্প খাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২.১৩ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮.২২ শতাংশ। সেবা খাতে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১.৫৪ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫.০৭ শতাংশ।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আনতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে। দেশের বেশ কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। এদের সম্পদ পর্যালোচনা কার্যক্রম শিগগিরই শুরু করা হবে। বর্তমানে দেশে এলসি খুলতে কোনো জটিলতা নেই। গত চার মাসে অতিরিক্ত ৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসী কর্মীরা, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আসছে জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামবে। আর আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।

এক অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সবাই বলছেন, এত কিছু করার পরও মূল্যস্ফীতি কমছে না কেন। এর প্রধান কারণ, আগের সরকারের ভুলনীতি। এতদিন বিবিএসসহ অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব তথ্য দিয়েছে, সেসব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আমি অর্থ মন্ত্রণালয়কে তথ্যপ্রবাহ সঠিক রাখার নির্দেশ দিয়েছি। সঠিক তথ্য না এলে অন্য তথ্যগুলোও ভুল আসবে। তখন যথাযথ নীতিমালা প্রণয়ন করা যাবে না। এতদিন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ছিল না বলে এ সমস্যা হয়েছে। একের পর এক দুর্নীতি ও অন্যায় হয়েছে, যার মাশুল দিচ্ছেন দেশের জনগণ। ভবিষ্যতের জন্য এমন নীতি করা হচ্ছে, যাতে কেউ আর অর্থ পাচার করতে না পারেন।