মূল্যস্ফীতি কমেছে, কিন্তু মানুষের খরচ আরও বেড়েছে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in সাম্প্রতিক দেশকাল on 2 October 2025

মূল্যস্ফীতির হার কমার পর কতটা স্বস্তিতে মানুষ?

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার কমেছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সহযোগিতায় পরিকল্পনা কমিশনের প্রকাশ করা তথ্যে বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা শাখাওয়াত রনি বিস্মিত।

সাম্প্রতিক দেশকালকে তিনি বলেন, “কোথাও ৯০ থেকে ১০০ টাকার নিচে সবজি পাওয়া যাচ্ছে না। চালের দামও তো বেশি।

“মাঝারি আকারের সাবানের দাম গত বছরও ৪০ টাকার ভেতরে ছিল, এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ টাকায়। কসমেটিকসের যত আইটেম আছে সবকিছুর দাম বেড়েছে। তাহলে মূল্যস্ফীতি কমে কীভাবে?”

পরিকল্পনা কমিশনের অধীনে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি সাত মাস ধরে পতনের ধারাবাহিকতায় আগস্টে তা ৮.২৯ শতাংশে নেমেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারও কিছুটা কমে ৯ শতাংশ হয়েছে।

তবে ক্রেতাদের সরাসরি অভিজ্ঞতা এবং বাজার পর্যবেক্ষণ দেখাচ্ছে, খাদ্যদ্রব্য, বিশেষ করে মাছ, ডিম, মুরগি ও শাকসবজির দাম ক্রমশ বাড়ছে, যা সাধারণ ভোক্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।

অর্থনীতির একজন বিশ্লেষক বলছেন, মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধির হার কিছুটা কমেছে, তার মানে এই নয় যে গত বছরের চেয়ে মানুষের ব্যয় কমেছে। ব্যয় আসলে বেড়েছে, তবে গত বছর এই সময়ে আগের বছরের তুলনায় যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল, সেই তুলনায় কিছুটা কম হারে বেড়েছে।

মূল্যস্ফীতির হার কমার যে হিসাব প্রকাশ হয়েছে, তার সঙ্গে মানুষের খরচ বৃদ্ধির হিসাবের অসামঞ্জস্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পরিসংখ্যান ব্যুরোর ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং উইংয়ের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, তার এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার নেই।

কাঁচাবাজারে সবজির দরদাম করছেন এক ক্রেতা।

এই কর্মকর্তা উপদেষ্টা, সচিব বা মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে অফিসের টেলিফোন নম্বরে ফোন করলে একজন কর্মকর্তা আবার রফিকুল ইসলামের সঙ্গেই কথা বলার পরামর্শ দেন।

কী বলছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক?

বেসরকারি খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরো ৩২৬ টির পণ্য ও সেবার মূল্য কতটা বেড়েছে, সেভাবে হিসাব করেছে। এর বাইরেও মানুষের খরচ আছে।

“তবে মূল্যস্ফীতির স্তর অনেক উপরেই আছে। সেটার হার যদিও কিছুটা কমেছে, তবে স্তর অনেক উপরেই।”

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার কমলেও মানুষের খরচ আগের চেয়ে আরও বেশি বেড়েছে—এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ধরুন ১০০ টাকারটা ১২ শতাংশ বেড়ে গত বছর ১১২ হয়েছিল। এবার বৃদ্ধির হার ১২ শতাংশ থেকে কমে ৯ শতাংশ হয়েছে, তার মানে খরচ কমেছে তা নয়। ১১২ থেকে ৯ শতাংশ বেড়ে সেটা ১২০ হয়েছে।

“যেহেতু মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার এখনও বেশি, সুতরাং মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অবনমন অব্যাহত আছে।”

ঢাকার কাঁচাবাজারে কী চিত্র

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ঢাকার কাঁচাবাজারে ক্রেতারা ঊর্ধ্বমুখী দামের চাপ অনুভব করেছেন।

এই সময়ে ফার্মের বাদামি ডিম প্রতি ডজন ১২০–১২৫ টাকা থেকে বেড়ে ১৪০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৫০–১৬০ থেকে ১৭০–১৮০ টাকা, সোনালি মুরগি ২৮০–৩০০ থেকে ৩১০–৩২০ টাকা হয়েছে।

মাছের বাজারে ঊর্ধ্বমুখী দামের চাপ অনুভব করেছেন ক্রেতারা।

এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছের দাম জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২ হাজার–২২০০ থেকে ২৩০০–৩২০০ টাকা হয়েছে; রুই মাছের দাম ৩০০ থেকে ৩২০, কাতল ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা হয়েছে।

সবজির মধ্যে করলা/বেগুন/পটলসহ সব কিছুর দামই এই সময়ে বেড়েছে।

পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের দামও প্রতি কেজিতে অন্তত ১০ টাকা বেড়েছে।

মোহাম্মদপুরের টাউন হলে বাজার করতে এসেছেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের ক্রেতা সানোয়ার পারভেজ। তিনি বলেন, “ডিম, মুরগি, মাছ—সবই ক্রমশ বাড়ছে। বাজারের অস্থিরতা ভোক্তাদের জন্য বড় বোঝা।”

“ভেবেছিলাম ইলিশের দাম কমবে, ভারতে রপ্তানি বন্ধ হবে। সেটা না হয়ে বরং এত বেড়েছে যে হাতের নাগাল ছাড়িয়ে গিয়েছে।”

বসিলা কাঁচাবাজারে কথা হচ্ছিল নারী কর্মজীবী সাবরিনা চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, “সবজির দাম হঠাৎ বেড়ে গেছে, বাজার করা কঠিন হয়ে গেছে। পেঁপে ছাড়া ১০০ টাকা কেজির কমে কিছু পাওয়া মুশকিল।”

ক্রেতার অপেক্ষায় বসে আছেন মুরগী বিক্রেতারা।

কারওয়ান বাজারে নিয়মিত ক্রেতা সংবাদকর্মী হাসান মাহমুদ বলেন, “চালের দামই কেবল তেমন বাড়েনি, কিন্তু মাছ-মুরগি ও ডিমের দাম বেড়ে গেছে। মাস শেষে বাজারের ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে।”

কী বলছে বেসরকারি সংস্থার জরিপ?

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সাম্প্রতিক জরিপে অংশ নেওয়া ৭০ শতাংশ মানুষ দ্রব্যমূল্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ একাধিক কারণে প্রায় ২০ শতাংশ পরিবার গুরুতর আর্থিক সংকটে রয়েছে বলেও প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

গত মে মাসে দেশের ৮ হাজার ৬৭টি খানার মধ্যে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।

জরিপে অংশ নেওয়া নমুনার মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ আর্থিক সংকটের মধ্যে আছে। এদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় এবং ২৭ শতাংশ ঋণ পরিশোধ নিয়ে সংকটে। সন্তানের শিক্ষা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন ৬৫ শতাংশ মানুষ।

সার্বিকভাবে নানা সংকট ও উদ্বেগের কারণে প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা হারিয়ে ফেলেছে।