দেশের ভেতরে একটি রাজনৈতিক শূন্যতা বিদ্যমান – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in প্রথম আলো on 13 September 2025

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ছবি: প্রখম আলো

জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন প্রসঙ্গে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, মঞ্চ প্রস্তুত করুন, দর্শকদের অধৈর্য করবেন না।

জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হওয়ার প্রশ্নে হতাশাবাদীরা প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন উল্লেখ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজনীতির নিয়ম হলো যতটুকু সম্ভব, ততটুকু করতে হবে। বাকিটার ক্ষেত্রে আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে। এই বাস্তববাদিতা থাকা দরকার।

আজ শনিবার বিকেলে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব বলেন।

‘নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার পথ’ শিরোনামে এ বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার ব্যাপারে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমার একটা খুবই সবিনয় বক্তব্য আছে। সেটা হলো সংবিধান নিয়ে যদি আমরা বেশি নাড়াচাড়া করি, তাহলে আরও অনেক গভীর সাংবিধানিক বিষয় সামনে আসতে পারে। ইতিমধ্যে সেই আলোচনা এসেছে।’

কী কী বিষয় সামনে আসতে পারে তা-ও তুলে ধরেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তাঁর মতে, সেই বিষয়গুলো হলো সরকার সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদে গঠিত হয়েছে, তাঁর ক্ষমতা কতটুকু বিস্তৃত ইত্যাদি। তিনি বলেন, তখন কেঁচো খুঁড়তে সাপও বেরিয়ে আসতে পারে। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা থেকে বেরিয়ে বিচারিক আলোচনায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যাবে। এতে পরিবর্তনের প্রত্যাশায় এত দিন যতটুকু এগোনো গেছে, সেখানে পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

সংবিধানে কোনো কিছু লিখে দিলেই তাতে কাজ হয় না বলেও মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে সংবিধান করার পর তিন বছরের মধ্যে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছে। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ছিল। বিচারিক প্রক্রিয়া ও কলমের খোঁচায় তা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।

‘আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, সংবিধানের বিভিন্ন জিনিস সংস্কারটা প্রয়োজনীয় শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়। পর্যাপ্ত শর্ত হলো জনমানুষের অংশগ্রহণ, নাগরিকদের কাছে জবাবদিহির জায়গাটাকে সোচ্চার করা। এবং রাজনীতি, মিডিয়া, নাগরিক সমাজ, ব্যক্তি খাত—ইত্যাদি, ইত্যাদিরা সবাই সোচ্চার থাকা’, যোগ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

‘পর্যাপ্ত শর্ত’ পূরণের দিকে মনোযোগী না হলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন থাকবে বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, সংস্কারের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বেশি জটিলতাতে গেলে কেউ কেউ সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবে এবং ঐকমত্য কমিশনের বৈধতা নিয়েও কথা উঠবে।

সংস্কারের বিষয়টি ঠিকমতো নিষ্পত্তি না হলে চারটি অর্থনৈতিক বিষয়ে এর প্রতিঘাত আসবে বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সেগুলো হলো ১. দ্রব্যমূল্য। ২. শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা। ৩. কর্মসংস্থান ও ৪. বিনিয়োগ।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, দেশের ভেতরে একটি রাজনৈতিক শূন্যতা বিদ্যমান। রাজনৈতিক শূন্যতা রাজনীতিহীনতা নয়। রাজনৈতিক শূন্যতা হলো সেই পরিস্থিতি, যেখানে শাসনকর্তারা দেশের ভেতরে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা এবং তাঁদের লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করতে যথোপযুক্তভাবে কার্যকর হন না। এই পরিস্থিতি অর্থনীতি, সামাজিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বিরাজ করছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজনীতিশূন্যতার ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাস দুই ধরনের সমাধান দেয়। প্রথমত, ক্ষমতায় থাকারা আরও শক্তিশালী হন এবং সেটা অর্জন করতে না পারলে নির্বাচন ও সংস্কার করা সম্ভব হয় না। দ্বিতীয় সমাধান হলো, আরও শক্তিশালী না হতে পারলে সরকারের পতন ঘটে। দুটোর একটা না ঘটলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথরেখা এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়।

খুলনায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলার কথা জানিয়ে এবং তাঁদের বরাত দিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মানুষ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা বলছে। আবার যে নির্বাচন হবে, সেটা গ্রহণযোগ্য হবে কি না এবং গুণমানসম্পন্ন হবে কি না, সে প্রশ্নও মানুষের মধ্যে আছে। নির্বাচন ঠিকমতো না হলে রাজনৈতিক সংকট কাটবে না। তাহলে কি আবার নির্বাচন করতে হবে? সব মিলিয়ে রাজনৈতিক শূন্যতা কাটানোই বড় বিষয় হয়ে গেছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, মানুষ বলছে দর্শক প্রস্তুত, মঞ্চ তো প্রস্তুত নয় তাঁর চেয়ে বড় কথা এই মঞ্চে নায়ক, নায়িকা বা অন্যরা যে ভূমিকায় আসবেন, তাঁদের সূত্রধর (সরকার অর্থে) কি প্রস্তুত? তিনি বলেন, ‘মঞ্চটা দ্রুত প্রস্তুত করেন। দর্শকদের ধৈর্যহারা করবেন না।’

প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান, হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে আজাদ, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ওসমানী সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মাহফুজুর রহমান, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফাও রয়েছেন অনুষ্ঠানে।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গোলটেবিল বৈঠক শুরু হয়। এতে সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।