রাজস্ব আদায় ধীরগতির কারণে বাজেট সহায়তার ওপর নির্ভরতা বাড়ছে: ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in The Business Standard on 22 September 2025

আর্থিক চাপের মধ্যে এআইআইবির কাছে ১.৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা চায় সরকার

ইনফোগ্রাফিক: টিবিএস

চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটানো ও সংস্কার উদ্যোগে সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকার এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)-এর কাছে ১.৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা চেয়েছে, যা উচ্চ সুদের বিদেশি ঋণের ওপর সরকারের নির্ভরতা বাড়ারই প্রতিফলন। বিশেষত, ব্যাংকিং খাতের সংকটাপন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সামনে আসার প্রেক্ষাপটে চাওয়া হচ্ছে এ সহায়তা।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর সূত্র জানায়, জলবায়ু নীতি-ভিত্তিক বাজেট সহায়তা কর্মসূচির আওতায় গত ১৩ আগস্ট এআইআইবি-কে এ প্রস্তাব পাঠানো হয়। ঋণদাতার পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে ইতিবাচক আশ্বাসও পাওয়া গেছে।

বেইজিংভিত্তিক এআইআইবি সাম্প্রতিক এক চিঠিতে জানিয়েছে, তারা ইআরডি, অর্থ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে এবং প্রস্তাবিত কর্মসূচি পর্যালোচনা করবে। চিঠিতে বলা হয়, “আমরা সব অংশীজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যাতে এ প্রক্রিয়া সময়মতো এবং গঠনমূলকভাবে এগিয়ে যায়।”

ইআরডি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এআইআইবি ছাড়াও বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে চলতি অর্থবছরে আরও ১.৮৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাজেট সহায়তা মূলত বাজেট ঘাটতি মেটাতে ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জোরদারে নেওয়া হয়। তবে চলতি অর্থবছরে কি পরিমাণ বাজেট সহায়তার প্রয়োজন হবে তা অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক শেষে চূড়ান্তভাবে জানা যাবে।

ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেট সহায়তার মূল উদ্দেশ্য হলো সংস্কার কর্মসূচিকে সহায়তা করা। উদাহরণ হিসেবে তিনি ব্যাংক খাতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, দুর্বল ও সমস্যাগ্রস্ত অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের পুনর্গঠনে তহবিলের দরকার।

তিনি বলেন, “কিছু প্রতিষ্ঠানকে হয়তো লিকুইডেট (অবসায়ন) করতে হবে, আবার কিছু প্রতিষ্ঠানকে পুনঃমূলধনীকরণ করতে হবে। এ ধরনের সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য বাজেট সহায়তা প্রয়োজন।”

তার মতে, আসল প্রশ্ন হলো সহায়তা পাওয়া কর্মসূচি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াচ্ছে কি না, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা উন্নত করছে কি না, বা ঝুঁকি কমাচ্ছে কি না। “যদি সেটা করে, তবে বাজেট সহায়তা দেওয়া যৌক্তিক এবং অর্থনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য,” যোগ করেন তিনি।

গত অর্থবছরে ৩.৪ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড বাজেট সহায়তা

সদ্য বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অর্তবর্তীকালীন সরকার সর্বোচ্চ ৩.৪ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পেয়েছিল। ইআরডি’র তথ্যমতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজেট সহায়তার ঋণ দ্রুত বেড়েছে—কোভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত এ প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রাখে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট সহায়তা ঋণ ছিল ১ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ২.৫৯ বিলিয়ন ডলারে—মূলত করোনা মহামারি মোকাবিলার কর্মসূচিগুলোয় বর্ধিত সহায়তা হিসেবে।

অন্যদিকে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে রাজস্ব আদায় আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ বাড়লেও—নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬,৫০০ কোটি টাকা। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত অর্থবছরের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কারণে এমনিতেই রাজস্ব আহরণ কম ছিল।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সীমিত রাজস্ব আদায়ের কারণে বাজেট বাস্তবায়নে চাপ তৈরি হয়েছে, ফলে বাজেট সহায়তার প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। “রাজস্ব সংগ্রহ ধীরগতিতে হলে সরকার বিকল্প হিসেবে বাজেট সহায়তার ওপর নির্ভর করে। আগে এ সহায়তা মূলত আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি বা জাপান থেকে আসত। এখন নতুন উৎস হিসেবে এআইআইবি-র মতো সংস্থার কাছেও হাত বাড়ানো হচ্ছে।”

তিনি বলেন, যদিও এ সহায়তা মূলত ঋণ হিসেবে আসে, যা সরকারের ঋণ বাড়ায়, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এর সঠিক ও দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা। “যদি বাজেট সহায়তা সঠিকভাবে ব্যয় হয়, তবে লক্ষ্যপূরণ সম্ভব। তবে অপব্যবহার ও অপচয় ঠেকানো না গেলে কার্যকারিতা নষ্ট হবে,” বলেন তিনি।

এআইআইবি’র ঋণের বৈশিষ্ট্য

ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, এআইআইবির ঋণ বাজারভিত্তিক সুদ হারে নিতে হয়। এ কারণে কারণে সংস্থার ঋণ হার্ড লোন হিসেবে বিবেচিত হয়। যে কারণে এই ঋণ সরকারের অনমনীয় ঋণ সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদনও নিতে হয়।

এ ঋণের মেয়াদ ৩৫ বছর, এর মধ্যে পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ড। সুদের হার ৬ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যদি বর্তমান সিকিউরিড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট বা সোফর প্লাস ফির হিসাব করা হয়।

এর আগে, গত জুনে এআইআইবি “ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (সাব-প্রোগ্রাম-২)” এর আওতায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে।

পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশ সরকারের জন্য বাজেট সাপোর্ট এখন একেবারে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে কয়েকটি কারণে। প্রথমত, ২০২২ সালের জুন-জুলাই থেকে শুরু হওয়া সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা। এরপর বৈদেশিক খাতের চাপ, রিজার্ভ সংকট এবং স্থানীয় মুদ্রার প্রায় ৪০ শতাংশ অবমূল্যায়ন পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়ানো, রিজার্ভ ধীরে ধীরে পুনর্গঠন করা এবং এক্সচেঞ্জ রেট স্থিতিশীল রাখাই সরকারের অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়ায়।

তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত, রাজস্ব ঘাটতি। কোভিড-পরবর্তী সময়ে রাজস্ব আহরণে দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং প্রবৃদ্ধির ধীরগতি অর্থনীতিতে নতুন ভঙ্গুরতা সৃষ্টি করেছে। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে নেমে আসার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরকারের হাতে খরচের সক্ষমতাও সংকুচিত হচ্ছে। এ অবস্থায় বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় সাপোর্ট গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃতীয়ত, সংস্কার বাস্তবায়নের গতি ত্বরান্বিত করা। গত এক বছরে সরকার নানান সংস্কার পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। উন্নয়ন সহযোগীদের বাজেট সাপোর্ট শুধু আর্থিক সহায়তাই নয়, বরং সংস্কার কার্যক্রমে বহিঃপ্রণোদক হিসেবেও কাজ করছে।

তবে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, বিদেশি ঋণের পরিমাণ ও ঋণ পরিশোধের দায় ইতিমধ্যে অ্যালার্মিং পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই নতুন করে নন-কনসেশনাল বা হার্ড লোন বাড়ানো হলে ঋণ ব্যবস্থাপনা আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। বাজেট সাপোর্ট বা প্রকল্প ঋণ গ্রহণ করতে হলেও তা অবশ্যই অগ্রাধিকারমূলক ও উচ্চ অর্থনৈতিক রিটার্নসম্পন্ন খাতে ব্যবহার করা জরুরি।

অন্যান্য উৎসের বাজেট সহায়তা

ইআরডি সূত্র জানায়, বর্তমানে এডিবির সঙ্গে তিনটি বাজেট সহায়তা কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলছে, যার আওতায় অন্তত ৮৫০ মিলিয়ন ডলার ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ অর্থ ব্যয় হবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক সহনশীলতা জোরদারে।

এ ছাড়া এডিবির বাজেট সহায়তা পাইপলাইনে ব্যাংকিং খাত সংস্কার সাব-প্রোগ্রাম-২ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেখান থেকে ২০২৭ সালে ৫০০ মিলিয়ন ডলার আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত অর্থবছরে সরকার এডিবি থেকে সর্বোচ্চ ১.৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পেয়েছিল।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের কাছে থেকে আগামী দুই অর্থবছরের জন্য ২.৭৭ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবিত পাইপলাইন তালিকা পাওয়া গেছে। যেখানে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের একটি বাজেট সহায়তা প্রস্তাবও রয়েছে। সরকার চেষ্টা করছে এ অর্থ চলতি অর্থবছরের মধ্যেই নিশ্চিত করতে। আগের অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক থেকে ১ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়া গিয়েছিল।