Originally posted in বণিক বার্তা on 7 May 2023
নিজস্ব অর্থে নয় মাসে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ৩৬.৬৮%
নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি নাকি অর্থের টান?
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয় সরকারি অর্থায়ন, বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার ঋণ বা অনুদান ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে। এর মধ্যে দাতা দেশ ও সংস্থার প্রকল্প সহায়তা থেকে ব্যয়ের হার চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) বেড়েছে। যদিও কমেছে সরকারি অর্থায়ন ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার তহবিল থেকে ব্যয়ের হার। বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহার্য নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেই এমনটি হয়েছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা। তাদের ভাষ্যমতে, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় ঠিকাদাররা ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সরকারের দেয়া অর্থ ব্যয় হচ্ছে না। যদিও অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অর্থের ঘাটতি থাকায় কৃচ্ছ্রসাধন করতে হচ্ছে সরকারকে। এ কারণেই এডিপি বাস্তবায়নে সরকারি অর্থায়নে ব্যয়ের হার কমেছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের এডিপিতে সংশোধিত বরাদ্দের পরিমাণ ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এতে সরকারি অর্থায়ন ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে সরকারি অর্থায়নের মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৫৬ হাজার ১৫১ কোটি টাকা বা ৩৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ। যেখানে এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে সরকারি অর্থায়নের ৪১ দশমিক ৭৯ শতাংশ ব্যয় হয়েছিল। পাশাপাশি এ সময়ে সরকারি সংস্থাগুলোর নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের ৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এ সময় প্রকল্প সহায়তা হিসেবে পাওয়া অর্থ থেকে বরাদ্দের ৫১ দশমিক ৯৮ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৪৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ বাড়লেও কমেছে প্রকল্পের সংখ্যা। ২০২২-২৩ এডিপিভুক্ত প্রকল্প ছিল ১ হাজার ৬৮৩টি। এগুলো বাস্তবায়নে জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে ব্যয় হয়েছে ৯৮ হাজার ৫২১ কোটি টাকা বা ৪১ দশমিক ৬৫ শতাংশ অর্থ। মোট ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে এ অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে মোট বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি ব্যয় করতে পেরেছে মাত্র ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। আবার সরকারি বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি ব্যয় করতে পেরেছে চারটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এগুলো হলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সেতু বিভাগ।
পরিসংখ্যান বলছে, গত এক দশকে জিডিপির অনুপাতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়েনি। যদিও এ সময় জিডিপির অনুপাতে সরকারের ঋণে ব্যাপক উল্লম্ফন ঘটেছে। অন্যদিকে কমেছে রাজস্ব আয়-জিডিপির অনুপাত। এ অবস্থায় সরকার প্রতি বছরই বড় অংকের ঘাটতি রেখেই বাজেট ঘোষণা করছে। লক্ষ্যমাফিক রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতায় সরকারের ঘাটতি বাজেটের আকার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ ঘাটতি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সরকারের ঋণের বোঝাও।
এ মুহূর্তে বাজেটের অন্যতম বড় ব্যয়ের খাত হয়ে উঠেছে ঋণের সুদ পরিশোধ। বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। আবার এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছচ্ছে না সরকারি অর্থের ব্যবহার। মূলত লক্ষ্যমাফিক রাজস্ব আহরণ করতে না পারার কারণেই সরকার তহবিলে ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
এডিপিতে সরকারি ব্যয়ের হার হ্রাস পাওয়ার পেছনে মূল্যস্ফীতি ও নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিই মূল প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে বলে দাবি করছেন নীতিনির্ধারকরা। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ সময়ে আমাদের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্য বিশেষ করে রড-সিমেন্টের দাম অনেক বেড়েছে। এর ফলে ঠিকাদাররা অনেক ভৌত অবকাঠামো প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে কাজে শ্লথগতি দেখা গেছে। এ কারণে আমাদের এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে। এটি বাস্তব পরিস্থিতি। পরবর্তী সময়ে আমরা মূল্য তালিকা সমন্বয় করেছি। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ চলছে। তাছাড়া সরকারি বিল সাধারণত মে-জুনে পরিশোধ করা হয়ে থাকে। ফলে অর্থ পরিশোধের পরই আমরা আর্থিক অগ্রগতি দেখাতে পারি। ঠিকাদাররা টাকা পাওয়ার জন্য মে-জুনের মধ্যে বিল জমা দিয়ে থাকেন। তাই এ সময়ে প্রকল্পের কাজেও গতি বাড়ে। আশা করছি এ বছরের জুনের মধ্যে এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি যেতে পারব।’
গত এক বছরে রড, সিমেন্ট, ইট, পাথর, বালি, বিটুমিন ও আলকাতরার মতো নির্মাণসামগ্রীর দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ঠিকাদাররা। মূল্যবৃদ্ধির গতি এত বেশি ছিল যে এ সময়ে সরকার দুই দফায় মূল্য তালিকা সংশোধন করলে দাম সেটিকে ছাড়িয়ে গেছে। এ কারণে ঠিকাদারদের অনেকেই লোকসানের শঙ্কায় প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন।
এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ ঠিকাদার সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারি আনোয়ার কামাল ফিরোজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০২২ সালে সরকার একবার মূল্য তালিকা সংশোধন করে। কিন্তু দেখা যায় পরবর্তী সময়ে নির্মাণসামগ্রীর দাম এ তালিকাকে ছাড়িয়ে যায়। এর কারণে ২০২৩ সালেও আরেক দফা মূল্য তালিকা সংশোধন করা হয়। কিন্তু এবারো নির্মাণসামগ্রীর দাম সেটিকে ছাড়িয়ে গেছে। ইট, পাথর, সিমেন্ট, বিটুমিন, আলকাতরা সবকিছুরই দাম বেড়েছে। যে ইট আগে ৮-১০ টাকা ছিল সেটি এখন হয়েছে ১৪ টাকা। লোকসানের ভয়ে অনেকেই কাজ বন্ধ রেখেছেন। আবার জরিমানার শঙ্কায় কেউ কেউ কোনো রকমে কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন।’ সব মিলিয়ে গত এক বছরে নির্মাণসামগ্রীর দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানান তিনি।
তবে নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিকে এডিপি বাস্তবায়নে সরকারি বরাদ্দ কমার একমাত্র কারণ হিসেবে দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, রাজস্ব আয় কমায় সরকারের প্রকল্প অর্থায়নের সক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে। নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি এ পরিস্থিতিকে আরো সঙ্গিন করে তুলেছে মাত্র।
২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে সংস্থাটির রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যের তুলনায় ঘাটতি রয়েছে ২৯ হাজার ৮ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের কোনো খাতেই এ সময় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি এনবিআর। অর্থবছরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য পূরণ করতে হলে বাকি তিন মাসে সংস্থাটিকে গড়ে ৪৮ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করতে হবে। এ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে শেষ তিন মাসে শুরুর নয় মাসের প্রায় দ্বিগুণ রাজস্ব আহরণ করতে হবে এনবিআরকে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রকল্পে ব্যয় করার মতো টাকার অভাবের কারণেই এডিপি বাস্তবায়নের হার কমে গেছে। সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের যে সক্ষমতা সেটি বর্তমানে সংকীর্ণ। সরকারের বিনিয়োগ অভিলাষের সঙ্গে অর্থায়নের সামর্থ্যের বৈপরীত্য তৈরি হয়েছে। কভিড-উত্তর সময়ে আমরা মহামারীর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারিনি। বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব থাকে। পাশাপাশি এ বছর সরকার বেশকিছু নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে শুধু টাকার অভাব নয়, পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সংকটও এক্ষেত্রে কাজ করেছে। আগে যদি সরকারের কাছে টাকার ঘাটতি থেকে থাকে তো বর্তমানে এর সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা সংকট যোগ হয়েছে। আগে বিভিন্ন প্রকল্প পুনর্বিবেচনা করে প্রয়োজন হলে বরাদ্দ বাড়াতে দেখা যেত, বর্তমানে কিন্তু এটি হচ্ছে না।’