সরকারি পদক্ষেপের বোধ ও বিবেচনা
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অপসারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন জাতিকে যেমন আহত করেছে, তেমনি বিপর্যস্ত করেছে ব্যাংকটির লাখ লাখ গ্রাহককে। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনাম হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকার দুনিয়াজোড়া যে বিরূপ মন্তব্যের মুখে পড়েছে, তা আমাদের ভাবমূর্তিকে এগিয়ে নিতে কতটা সহায়ক, তা বলা কঠিন। বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে ট্যাক্সিচালক পর্যন্ত সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, এটা কেমন সরকার, যারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে, যাদের শাসন ধর্মনিরপেক্ষ, তারা কেন এমন কাজ করল? গত ৩ মার্চ দেশে ফেরার পথে দিল্লি বিমানবন্দরে এক বাঙালি অভিবাসন কর্মকর্তার প্রশ্নের মাধ্যমে ঘটনাটির বৈশ্বিক অভিঘাত আমার ওপরও এসে পড়ল। তাঁকে আমার পাসপোর্টটি দেওয়ামাত্রই তিনি বিষণ্নবদনে জানতে চাইলেন, ‘কেন তোমাদের সরকার তোমাদের নোবেল বিজয়ীকে সরিয়ে দিতে চায়?’ হতে পারে তা অন্যায্য কিন্তু বৈশ্বিক সম্প্রদায় নিরন্তরভাবে আমাদের সরকার সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছে, সরকারের তরফে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন কিংবা বিচার-প্রক্রিয়ার ফল দিয়ে কোনোভাবেই তা মোচন করা যাবে না। মেয়াদের বাকি বছরগুলোতেও এই নিন্দা সরকারকে তাড়া করে ফিরবে। এই ক্ষতিকর সংঘাতের ফলে সরকার কী পেল আর কী হারাল, তার কোনো খতিয়ানের চেষ্টাও তাদের পক্ষ থেকে করা হয়েছে বলে মনে হয় না।
তাহলে সরকার কেন অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে গঠিত গ্রামীণ ব্যাংক পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনের অপেক্ষা না করেই এমন চরম সিদ্ধান্ত নিল? ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ কার্যকর করা এবং ১ দশমিক ৮ কোটি টাকার প্রাথমিক মূলধন দেওয়া ছাড়া গত ৩০ বছরে ব্যাংকটির বিকাশে সরকারি ভূমিকা অতি নগণ্য। বিপরীতে, দরিদ্র গ্রাহকেরা, যাঁদের বেশির ভাগই নারী, তাঁদের অংশীদারির অনুপাত হলো মোট শেয়ারের ৭৫ শতাংশ এবং একটানা তাঁরা ব্যাংকটির মূলধনি ভিত্তি বাড়িয়ে চলেছেন। তাঁদের সামান্য সঞ্চয় দিয়েই তাঁরা এটা করেছেন এবং এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩ কোটি টাকা। পরিণামে, এই নারীরা এখন ব্যাংকের পরিশোধিত স্টক শেয়ারের ৯৬ দশমিক ৫ শতাংশেরই মালিক।
গ্রামীণ ব্যাংক এখন ব্যাংকঋণের মাধ্যমে অথবা সময়ে সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সুদের বিনিময়ে ঋণপত্রের মাধ্যমেও পুঁজি গঠন করছে। তহবিল জোগানদাতাদের মধ্যে এমনকি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকও রয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেয়াদের মধ্যেই সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। অন্যদিকে সরকার করদাতাদের দেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর মূলধনি ভিত্তি গঠন করতে বাধ্য হয়েছে কিন্তু এসব ব্যাংকের অভিজাত গ্রহীতারা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করে দিয়েছেন।
এই দীর্ঘ সময়ে গ্রামীণ ব্যাংককে কোনো সরকারি বেইল আউট নিতে হয়নি কিংবা বাইরে থেকে তহবিল আহরণে সরকারি হস্তক্ষেপেরও দ্বারস্থ হতে হয়নি। তহবিলদাতারা নিজেরাই সেধে এসে গ্রামীণকে তহবিল দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক নিরীক্ষণে দেখা গেছে, ব্যাংকটি সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়েছে এবং এর আর্থিক কাজকারবার সুচারু ও মানসম্মতভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। এমনকি ব্যাংকের সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারমালিকদের দিক থেকে অথবা এর গ্রাহকদের পক্ষ থেকে কখনো সরকারের কাছে অনিয়মের বা সম্পদের অপব্যবহারের অভিযোগও আসেনি। এ রকম যখন অবস্থা, তখন এটা বোধগম্য নয়, ৩০ বছর যাবত গ্রামীণের নিষ্ক্রিয় ও দুর্বল অংশীদারির ভূমিকায় থাকার পর সরকার কেন হঠাৎ জেগে উঠে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে মালিকসুলভ আচরণ শুরু করল? সাধারণভাবে এ ধরনের আচরণ অনিয়মের কারণে আর্থিক বিপত্তির মুখে পড়া প্রতিষ্ঠানের জন্য সংরক্ষিত থাকে। যে সরকার শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, জ্বালানিসংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, লিবিয়া থেকে প্রবাসী কর্মীদের ফেরত আসাসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানে মহামারি আকারের অব্যবস্থাপনার মতো গুরুতর সমস্যায় হিমশিম খাচ্ছে, সেই সরকার কেন আর্থিকভাবে গতিশীল ও সক্ষম একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা নিয়ে বিবাদে জড়াল, যেখানে আবার তাদের অংশীদারি নগণ্য, সেটা এক রহস্য বটে।
এজমালি সম্পত্তির তছনছ
একটি আইনি খুঁটিনাটির ছুতো ধরে অধ্যাপক ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করার সময় সরকার প্রতিষ্ঠানটির সফলতার ইতিহাস এবং এর ব্যাপক বিস্তৃত খ্যাতিকে গুরুত্বই দেয়নি। প্রতিষ্ঠানটির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মালিক সেই ৮০ লাখ দরিদ্র নারীর আর্থিক স্বার্থও তাদের কাছে পাত্তা পায়নি। এমনকি তারা অনুসন্ধানও করে দেখেনি যে, ১৯৯৯ সালে কেন গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ যত দিন না দায়িত্ব হস্তান্তরে সক্ষম হন, তত দিন পর্যন্ত অধ্যাপক ইউনূসকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালনের অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দেখা যাক, কেন সে সময় পর্ষদ সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল।
সে সময়, পর্ষদের সব সদস্যের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে গ্রামীণ ব্যাংক কোনো সাধারণ প্রতিষ্ঠান নয় এবং এর পরিচালক অধ্যাপক ইউনূসও অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গোছের কেউ নন। ১৯৭৬ সালে ফিরে গিয়ে দেখি, গ্রামীণ ব্যাংক এক অনন্য চিন্তার ফসল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সহায়হীনদের মঙ্গলার্থে কোনো রকম অতিরিক্ত জামানত ছাড়াই ঋণ দেওয়ার নীতির ভিত্তিতে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তাঁর উদ্যোগেই এটি দিনে দিনে একটি সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে আইনবলে প্রতিষ্ঠিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। দরিদ্রদের জন্য এনজিও বানানোর বদলে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়ায় ইউনূস সরকারকেও জড়িত করেছিলেন। তাঁর আশা ছিল যে সরকারও দরিদ্রদের সহায়তা করায় অংশীদার হয়ে উঠবে। এই কাজে তিনি তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদার ও সক্রিয় সহযোগিতা পান। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এমন এক বিরল অর্ডিন্যান্স কার্যকর করেছিলেন, যাতে এমন একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক গঠিত হবে, যার আংশিক মালিকানা থাকবে এর দরিদ্র গ্রহীতাদের হাতে, যাতে তাঁরা বিনা জামানতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নিতে পারেন।
এই পরীক্ষামূলক সূত্রপাত থেকে পরের ২৫ বছর ধরে ইউনূস দিনরাত পরিশ্রম করে, একদল নিবেদিতপ্রাণ সহযোগীর সমর্থনে গ্রামীণ ব্যাংককে রূপান্তর করেন বিশ্বের মধ্যে এ ধরনের সংস্থাগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্ববৃহৎ সংস্থা হিসেবে। তাঁর ও তাঁর ব্যাংকের নামে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি এরই ফল। তখন থেকেই গ্রামীণ মডেলের আদলে বিশ্বে অজস্র প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও তা ঘটেছে। এই প্রক্রিয়ায়, বিশেষত প্রতিষ্ঠান নির্মাণের প্রথম দুই দশকে ইউনূস বাংলাদেশের আনাচকানাচে সফর করেছেন। এটা তিনি করেছেন যাঁরা ঋণ নিচ্ছেন এবং গ্রামীণের মালিক হচ্ছেন তাঁদের ভালো করে জানতে এবং তাঁদের সমস্যার পাহাড়ের সঙ্গে পরিচিত হতে। এই প্রক্রিয়ায় তিনি গ্রামীণের নারী মালিকদের সঙ্গে এমন এক ব্যক্তিগত আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন, যার পরিণতিতে তাঁরা গ্রামীণের সঙ্গে কারবারে ভরসা পান। ৩০ বছর ধরে কোটি কোটি নারীকে বুঝিয়ে বারবার গ্রামীণের কাছে নিয়ে আসা, ৫১ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করানো ও পরিশোধ করানো এক পর্বতপ্রমাণ সাফল্য। বিশেষত এমন এক দেশে এটা সম্ভব হয়েছে যেখানে কার্যত এসব নারীর শতভাগই জীবনে কখনো ব্যাংকে যাননি। এই লাখ লাখ ঋণগ্রহীতার কাছে ব্যক্তি ইউনূস হলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের অচেনা জগতে এক আস্থার প্রতীক, নিরাপত্তার চাদর।
যে মানুষটির ভরসায় লাখো নারী তাঁদের আশা, ভয় ও সঞ্চয় বিনিয়োগ করেছেন, কেবল বয়স ৬০ হয়ে যাওয়ার জন্য তিনি আর তাঁদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারবেন না, এটা জানাকে তাঁরা মেনে নিতে পারবেন না। যাঁরা এর মালিক এবং এখানে যাঁদের বিনিয়োগ রয়েছে, গ্রামীণের সেই সব গ্রহীতা/মালিকের এই মনোভাবই সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে গ্রামীণের পরিচালনা পর্ষদের নয় নারী প্রতিনিধির সিদ্ধান্তে। ১২ বছর পরে সম্প্রতি এ ধরনের অন্য নয়জন নারীই ব্যাংকটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইউনূসের অপসারণের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। ইউনূস যখন আদালতে হাজির হয়েছেন, তখন টেলিভিশনের পর্দায় এঁদেরই দেখা গেছে তাঁর প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে। সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সর্বশক্তিমান জ্ঞান করে ব্যাংকের ৯৬ শতাংশ স্টক-শেয়ারের মালিক এই লাখো কোটি নারীর উদ্বেগ ও মতামত তুচ্ছ করলে কোনোভাবেই সেই আচরণকে বিবেচক, গণতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল বলা যায় না। এই মানুষদের গণতান্ত্রিক ও করপোরেট অধিকার রদ করাকে ন্যায্য বলে প্রতিপন্ন করাও কঠিন। এই নারীরাই হলেন ব্যাংকের সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিক এবং তাঁরা যে ভোটার, সেটা প্রধান বিরোধী দলেরও নজর এড়ায়নি।
পরিচালনা পর্ষদের কাছে অধ্যাপক ইউনূসের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি এবং ব্যাংকের কাছে তাঁর মূল্য মোটেই ঠুনকো ব্যাপার নয়। এমনকি ১৯৯৯ সালেও ইউনূস দেশের মধ্যে যেমন, আন্তর্জাতিক স্তরেও ছিলেন তেমন খ্যাতিমান। ইউনূসের এই মানমর্যাদা গ্রামীণের অগণিত বিনিয়োগকারীর মধ্যে কেবল ভরসার অনুভূতিই জাগায় না, তা ব্যাংকের জন্য একটি বড় পুঁজিও বটে। এমনকি এক দশক আগেও অধ্যাপক ইউনূস যেকোনো বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এবং করপোরেট বিনিয়োগকারীদের থেকে মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করার মতো অবস্থানে ছিলেন। অধ্যাপক ইউনূস তাই হয়ে উঠেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের সম্পদ। দরিদ্র নারীদের কাছে তাঁর নামের এই মূল্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের থেকেও বেশি। গ্রামীণের পরিচালনা পর্ষদ অন্য যেকোনো পদ অলংকৃত করে থাকা ব্যাংকারের মতো করে ইউনূসকেও স্বেচ্ছায় অবসর নিতে দিলে সেটা হতো ব্যাংকের পরম একটি সম্পদ নষ্ট করার মতো বিরাট করপোরেট অপরিণামদর্শিতা ও দায়িত্বহীনতা।
এক দশক পরে, ইউনূস এবং তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত। গ্রামীণের মডেল এখন দুনিয়ার সর্বত্র অনুসরিত হচ্ছে। এখন তাঁর জন্য দুনিয়ার সব উন্নত দেশ এবং তাবৎ উন্নয়নশীল দেশ যথা—চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, ভিয়েতনাম; এমনকি ভেনেজুয়েলার মতো দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দরজা খোলা। এখন তিনি ফোন তুলেই বিশ্বের প্রধান প্রধান ৫০০ কোম্পানির (ফরচুন ৫০০ তালিকাভুক্ত) যেকোনো সিইওর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। এই ৫০০ কোম্পানির যে কেউই তাঁকে তাঁদের পরিচালনা বোর্ডের সভায় উপস্থিত থাকার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দিতে রাজি। অথচ এসব না করে তিনি বাংলাদেশে থাকাই সাব্যস্ত করেছেন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক লাখ লাখ দরিদ্র নারীকে তাঁর নাম মূলধনের মতো ব্যবহার করতে দিচ্ছেন। কী পরিমাণ বোধ-বিবেচনাহীন হয়ে পড়লে এবং বাণিজ্যিক বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেললে নিছক মামুলি আইনি বিধির অজুহাতে এই লাখ লাখ নারীকে তাঁদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হাতছাড়া করতে বাধ্য করা যায়?
সংঘাত থেকে রাষ্ট্রনায়কতার দিকে
সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে সরকারের মুখপাত্র জানিয়েছেন, ইউনূসের সঙ্গে সরকারের কোনো রাজনৈতিক বিবাদ নেই। তাঁরা কেবল আইনের শাসনের সুরক্ষা চান। আমি সরকারের তরফে এই বক্তব্যকে তাঁদের অবস্থান হিসেবে ধরে নিতে চাই। যদি আইনের শাসনই মূল বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আদেশে যেমন বলা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান আইনি বিচ্যুতি হলো ১৯৯৯ সালে ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পুনর্নিয়োগের বেলায় আগেভাগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন না নেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক ইস্যুটি তোলে গ্রামীণ ব্যাংকের বার্ষিক অডিট প্রতিবেদনে এবং সে সময় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিবেদনের যাবতীয় প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দেয়। গ্রামীণ ব্যাংকের সেই উত্তর যদি বাংলাদেশ ব্যাংক বা বাংলাদেশ সরকারের মনঃপূত না হয়, তাহলে তারা গ্রামীণ ব্যাংককে আবারও নোটিশ দিয়ে তাদের এই অনিয়মকে সংশোধন করতে বলতে পারত। কিন্তু তিনটি গণতান্ত্রিক সরকার, দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং ১৯৯৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের চারজন গভর্নরের সময়েও তাঁদের দিক থেকে গ্রামীণ ব্যাংককে আর কোনো নোটিশ পাঠানো হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই একটানা নীরবতাকে খুবই যুক্তিসংগত কারণেই গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট প্রতিবেদনের প্রতি অনুমোদন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ইউনূসের পুনর্নিয়োগকে গ্রাহ্য করা বলে ধরে নেওয়া যায়।
এমনকি আজও ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সে রকম কোনো চিঠি পাঠাতে কোনো বাধা ছিল না। তাহলে গ্রামীণ ব্যাংক তাদের কাজের একটা ব্যাখ্যা দিতে পারত এবং/অথবা হয়তো ইউনূসের দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার অনুমোদনও চাইতে পারত। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকও গত ১২ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর করা ইতিবাচক অডিট প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভাবতে পারত যে অধ্যাপক ইউনূস যেহেতু দক্ষতার সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা করছেন, সেহেতু তাঁর অনুমোদন প্রাপ্য। কেন এ রকম একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ নেওয়া হলো না, তার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আমরা ক্রমাগত এ ধরনের আইনি সংঘাত ঘটতে দেখছি, যা কার্যত আমাদের শাসন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়ও না, এই অপ্রয়োজনীয় সমস্যার সমাধানও এ থেকে হওয়ার নয়।
তাহলে আমরা এখান থেকে কোথায় যাব? গ্রামীণ ব্যাংকের বিকাশে অধ্যাপক ইউনূসের ঐতিহাসিক ভূমিকা, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তিনি যে আস্থার সঞ্চার করেন, তা এবং তাঁর নামের যে করপোরেট সম্পদমূল্য, যা আবার অর্থমন্ত্রী এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। এ অবস্থায় তাঁর জন্য ‘সম্মানজনক প্রস্থানের’ পথ খোঁজা তো আসল সমস্যা থেকে চোখ সরানো। সেই আসল হলো গ্রামীণ ব্যাংকের কল্যাণ এবং এর লাখ লাখ গ্রাহকের জীবনযাত্রা। গ্রামীণ ব্যাংকের ভালো চাইলে কিংবা এর ৮০ লাখ সদস্যের কথা মাথায় রাখলে কেউ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ইউনূসের প্রস্থান, তা সম্মানজনক বা অন্য যেকোনো রকমই হোক, চাইতে পারে না। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতাকে বের করে দেওয়ার যেকোনো হঠকারী পদক্ষেপ কেবল এর গ্রাহকদের আস্থাকেই নাড়িয়ে দেবে না, ব্যাংক থেকে তাঁদের সঞ্চয় উঠিয়ে নেওয়ার এবং তাঁদের ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও সৃষ্টি করবে। গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে এমন আচরণের সংক্রামক প্রতিক্রিয়া দেশজোড়া অন্যান্য ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্থিতিশীলতাকেও বিপর্যস্ত করতে পারে। তাই প্রাসঙ্গিক হলো, ইউনূসের প্রস্থান নয়, বরং গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক নিজে থেকে গুটিয়ে নেওয়ার আগ পর্যন্ত কী কী শর্তে তিনি দায়িত্ব পালন করে যেতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা।
বর্তমান অবস্থায় তাহলে এগিয়ে যাওয়ার যুক্তিসংগত পথ কী? অধ্যাপক ইউনূস ইতিমধ্যে তেমন এক পথের প্রস্তাব করেছেন। ৭০ বছর বয়সেও তাঁর রয়েছে তরুণের শক্তি ও সৃষ্টিশীলতা। এমনকি তিনি যদি নিজেকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সম্পূর্ণ প্রত্যাহারও করে নেন, তবু তিনি দরিদ্রদের সেবায় নিয়োজিত বেশ কয়েকটি গ্রামীণ ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে থাকছেন। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা কিংবা ফরচুন ৫০০-ভুক্ত কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে তিনি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার এনে এসব প্রতিষ্ঠান অথবা ভবিষ্যতে তাঁর তৈরি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার করতে পারবেন। এ ধরনের কর্মোদ্যম, সুখ্যাতি এবং তহবিল সংগ্রহের ক্ষমতা যাঁর, তাঁকে অবশ্যই গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। বয়সের বাধা এখানে বিবেচ্য হওয়ার কথা নয়।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই দায়িত্ব থেকে অপসারণে বয়স কোনো প্রশ্ন নয়। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর বয়স ৭৭ বছর। আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রীর বয়স ৮০ বছরের কাছাকাছি। মন্ত্রীদের মধ্যে অথবা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োজিত মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিদের মধ্যেও কয়েকজন আছেন, যাঁদের বয়স হয় ৭০ পেরিয়েছে বা পেরোবে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীও ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের নির্বাহী দায়িত্ব পালনের সময়সীমার থেকেও বেশি দিন ধরে—গত তিন দশক ধরে—নিজ নিজ দলের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। যদি অ্যাটর্নি জেনারেলের কথামতো মানি যে ৬০ বছরই হলো অবসর গ্রহণের সর্বজনীন বয়স, তাহলে এসব জাতীয় ব্যক্তিত্বের সবারই অনেক আগেই অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। সৌভাগ্যবশত ওপরে বর্ণিত সব ব্যক্তিই জীবনের শিখরে পৌঁছেছেন, নিজ নিজ দল ও সরকারের আস্থা তাঁরা উপভোগ করেন এবং দেখা যাচ্ছে, যত দিন তাঁরা ইচ্ছা করেন, তত দিন দায়িত্ব পালনে তাঁরা সক্ষম। তাহলে যে ব্যক্তিটি শূন্য থেকে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং যার সঙ্গে তিনি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত; সেই প্রতিষ্ঠান থেকে বয়সের দোহাই দিয়ে তাঁকে অপসারণ করা ন্যায্যও নয়, সঠিক কর্মকৌশলও নয়।
গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে ইউনূসের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে বর্তমান সংকটের একটি মানানসই সমাধানের প্রস্তাব ইতিমধ্যে ইউনূসের তরফ থেকেই এসেছে। নিদেনপক্ষে এক বছর আগে ইউনূস অর্থমন্ত্রীর কাছে ইঙ্গিত করেছিলেন যে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্ব পেশাদারির দিক থেকে যোগ্য একজন ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দিতে চান। সেই ব্যক্তিকে হতে হবে সুষ্ঠু অনুসন্ধান-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মনোনীত, যিনি গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক সেই লাখ লাখ গ্রাহকের আস্থা অর্জনেও সক্ষম হবেন। এ ধরনের এক রদবদল সম্পন্ন করায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো গ্রামীণ ব্যাংকের ধারাবাহিকতায় ছেদ না ঘটানো, যাতে ব্যাংকের সদস্যদের আস্থা অটুট থাকে। এ রকম অবস্থায় আদর্শ সমাধান হলো, অধ্যাপক ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক পর্ষদের সভাপতির পদে আমন্ত্রণ জানানো। তাঁর এই মাত্রার উপস্থিতি ব্যাংকটির বৈশ্বিক বিস্তারকে যেমন অব্যাহত রাখবে, তেমনি তাঁর মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নীতিনির্ধারক মহল থেকে শুরু করে আর্থিক পরিমণ্ডলে ব্যাংকটির গ্রহণযোগ্যতাও টিকে থাকবে। এটা করা হলে তা ব্যাংকের ৮০ লাখ গ্রাহকের সবচেয়ে পুরস্কৃত যে সম্পদ, তা নিয়োজিত থাকবে তাঁদের প্রতিষ্ঠানে, যে প্রতিষ্ঠান তাঁদের সংসার ও জীবনের সঞ্চয়ের প্রতীক। চলমান অর্থহীন রকম ধ্বংসাত্মক সংঘাতের এ রকম একটি যৌক্তিক ও গঠনমূলক সমাধানের প্রতি অবজ্ঞা দেখানো হলে গোটা দুনিয়া বুঝে নেবে যে গ্রামীণ ব্যাংকের স্বার্থের বাইরের অন্য কোনো বিষয়ই কাজ করছে সরকারের মনে।
আমাদের ইতিহাসের এই দুঃখজনক অধ্যায়ের গঠনমূলক সমাপ্তি টানার উদ্যোগ নিতে পারেন যিনি, তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং যাঁর পক্ষে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক কোটি কোটি নারীর উদ্বেগের প্রতি অসহিষ্ণু হওয়া কিংবা তাঁদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার রাজনৈতিক পরিণতি বহন করা কঠিন। তাঁর পক্ষে ভুলে যাওয়াও কঠিন, যে কষ্টকর পথে তিনি অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক স্তরে কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছেন; সেই অর্জনকে এমন একটি ইস্যুতে খুইয়ে ফেলা উচিত হবে না, যে ইস্যুটি তাঁর আশু রাজনৈতিক কার্যসূচির দিক থেকে প্রান্তিক। যাঁরাই তাঁকে এমন পরামর্শ দিন না কেন, প্রধানমন্ত্রীর জন্য সময় এসেছে এ ঘটনার রাজনৈতিক মূল্যটি আবারও খতিয়ে দেখার। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর করার ভুল সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার বেলায় তো তিনি রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও পরিপক্বতার নিদর্শন রেখেছিলেন। তাঁর এখন উচিত গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে এই ন্যক্কারজনক ও ধ্বংসাত্মক অধ্যায় থেকে বেরিয়ে আসা। এটা করা যেতে পারে তাঁর এবং অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ইউনূসের বৈঠকের দাওয়াত দেওয়ার মাধ্যমে; সেখানে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে যেসব নেতিবাচক ধারণা তাঁর মনে জন্মেছে, সেসব নিয়ে গঠনমূলক আলোচনাও হতে পারে। তারপর প্রধানমন্ত্রীর নিজেরই উচিত অধ্যাপক ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের পর্ষদের সভাপতির পদ গ্রহণে আমন্ত্রণ জানানো। এর মাধ্যমেই হতে পারে গ্রামীণ ব্যাংক এবং রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা। এ ধরনের এক বন্দোবস্তের মাধ্যমেই গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য আন্তর্জাতিক মানের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের খোঁজ শুরু করা যেতে পারে। পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংকের সেবার মান বাড়ানোসহ যেকোনো রকম সংস্কারের সুযোগ উন্মোচন করা এবং তা এগিয়ে নেওয়াও যেতে পারে।
এ ধরনের এক সমঝোতার মানসিকতা থেকে প্রধানমন্ত্রীর উচিত অধ্যাপক ইউনূসকে তাঁর প্রতিপক্ষ মনে না করা। ইউনূস সেটা হতেও পারেন না। কারণ শেখ হাসিনা হলেন দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। ইউনূস বরং হতে পারেন এমন এক দিনবদলের সম্পদ, যেখানে দারিদ্র্য ও অবিচার বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হবে। প্রতিপক্ষকে বন্ধুতে পরিণত করাই নেতার যোগ্যতার মাপকাঠি। আর রাষ্ট্রনায়কের পরিমাপ সেখানেই, যেখানে তিনি আগামী প্রজন্মের উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণের স্বার্থে তাঁর প্রতিপক্ষের সঙ্গেও হাত মেলাতে পারেন।
রেহমান সোবহান: অর্থনীতিবিদ; সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান।