বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরকালীন পরিস্থিতিতে রয়েছে – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বণিকবার্তা on 28 February 2025

নতুন বিদেশী ঋ‌ণের প্রতিশ্রু‌তি কমেছে, হ্রাস পেয়েছে অর্থছাড়ও

ছবি : বণিক বার্তা

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম সাত মাসে বিদেশী ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যানুসারে, এ সাত মাসে বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে ২৩৫ কোটি ডলারের।

যেখানে গত অর্থবছরের একই সময় প্রতিশ্রুতি এসেছিল ৭১৭ কোটি ডলারের। এ সময় বিদেশী ঋণগ্রহণ নিয়ে আটটি ও অনুদানের বিষয়ে ৩১টি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৪ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে। এরপর সবচেয়ে বেশি ৭০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এডিবি। এছাড়া এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের কাছ থেকে ৪৫ কোটি এবং এশিয়া ও জেইসির কাছ থেকে ১৬ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছে।

প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি কমেছে আগের প্রতিশ্রুত বিদেশী ঋণের অর্থছাড়ও। এ সাত মাসে বিদেশী ঋণের অর্থছাড় হয়েছে ৩৯৪ কোটি ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছাড় হয়েছিল ৪৪০ কোটি ডলার। এ সময়ে বিদেশী ঋণের অর্থছাড় কমেছে ৪৬ কোটি ডলার বা প্রায় ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ ছাড় করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থাটির ছাড়কৃত অর্থের পরিমাণ ১১০ কোটি ডলার। বিশ্বব্যাংক ছাড় করেছে ৮৭ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের কাছ থেকে এসেছে ৭৬ কোটি ডলার। চীনের কাছ থেকে এ সময় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কোনো অর্থছাড় হয়নি। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ৬৯ কোটি ডলার এবং এশিয়া ও জেইসি থেকে এসেছে ৪১ কোটি ডলারের ঋণ। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ইইউ ছাড়া অন্য সব জায়গা থেকে বিদেশী ঋণের অর্থছাড় কমেছে।

বিদেশী ঋণের প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় কমে যাওয়ার পেছনে দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকটকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, দেশের অর্থনীতি এখনো সংকট থেকে বের হতে পারেনি। বরং শিল্পোৎপাদন ও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখিতা অর্থনীতিকে বেশ চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পাশাপাশি দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। আশাব্যঞ্জক নয় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও। বিদ্যমান এ পরিস্থিতিতে নতুন করে বিনিয়োগের জন্য কোনোভাবেই ভরসা পাচ্ছেন না দেশী বিনিয়োগকারীরা। বিদেশী বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় দাতারাও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নতুন করে ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড়ের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দাতাদের কাছ থেকে অর্থপ্রবাহ সামনের দিনগুলোয় আরো কমে আসতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে স্বল্পসময়ের জন্য। অন্যদিকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক সরকারের মেয়াদ হয় পাঁচ বছর। তাছাড়া সামনে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তারা তাদের প্রতিশ্রুতি অনুসারে নতুন নীতি গ্রহণের পাশাপাশি বিদ্যমান নীতিতে পরিবর্তনও আনবে, এটাই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় বর্তমান এ অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বিদেশী সহায়তা কমাটাই স্বাভাবিক। আরেকটি দিক হচ্ছে বর্তমানে অর্থনীতি এক প্রকার স্থবির হয়ে আছে। আমাদের বাস্তবায়ন সক্ষমতাও কম। অর্থনীতিসংশ্লিষ্ট সরকারের যেসব মন্ত্রণালয় আছে তারা বর্তমানে সংকট মোকাবেলায় ব্যস্ত রয়েছে। একটার পর একটা সংকট লেগেই আছে। ফলে এসব সংকট মোকাবেলা করতেই তারা সর্বশক্তি দিয়ে নিয়োজিত রয়েছে। এ অবস্থায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কিংবা দীর্ঘ বা মধ্যমেয়াদি কোনো পদক্ষেপ বাস্তবায়নে তাদের নজর দেয়ার সুযোগটা সীমিত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিদেশী উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থছাড়ের প্রত্যাশা করাটা সংগত নয়। চলমান ও স্বল্পকালীন ক্ষেত্রে বহুপক্ষীয় দাতাদের কাছ থেকে কিছু অর্থ ছাড় করা হতে পারে। অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয় দাতারা পরিস্থিতি কোনদিকে যায় সেটি পর্যবেক্ষণ করছেন। বর্তমান অনিশ্চিত ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়ে যেখানে দেশী বিনিয়োগকারীরাই বিনিয়োগের জন্য আগ্রহী হচ্ছেন, না সেখানে বিদেশীরা তো আরো বেশি সতর্ক থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। এ ধরনের পরিস্থিতি চলমান থাকলে সামনে বিদেশীদের কাছ থেকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় আরো কমবে। যতদিন পর্যন্ত অর্থনীতি ঘুরে না দাঁড়াবে ততদিন পর্যন্ত এটি নিম্নমুখী হওয়ার প্রবণতা প্রবল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’

প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় কমলেও বেড়েছে বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বিদেশী ঋণের অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে ২৪২ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১৫৫ কোটি ডলারের মূল ঋণ ও ৮৭ কোটি ডলার সুদ পরিশোধ করা হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধ করা হয়েছিল ১৮৬ কোটি ডলারের ঋণ। সে অনুযায়ী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ৫৬ কোটি ডলার বা ৩০ শতাংশ।

ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়বে ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারেরও বেশি। পর্যায়ক্রমে এ ঋণ পরিশোধের চাপ সামনের বছরগুলোয় আরো বাড়বে। কেননা গত অর্থবছরে বিদেশী ঋণের আসল পরিশোধ যে গতিতে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি গতিতে বেড়েছে সুদ বাবদ খরচ। টাকার অবমূল্যায়নের ফলে বিদেশী ঋণের সুদের পরিমাণ বেড়ে গেছে। তাছাড়া প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণের চাপও সামনে বাড়তে থাকবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণেও নতুন করে সহায়তার প্রতিশ্রুতি কমে গেছে। সরকার যেসব সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, সেগুলোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে এলে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহায়তার পরিমাণ বাড়বে। দেশে বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বিগত সরকার বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ নিয়েছে। এসব প্রকল্পের অনেকগুলোই বাস্তবায়ন হয়েছে। বেশ কয়েকটির কাজ এখনো চলমান। এরই মধ্যে বাস্তবায়িত অনেক প্রকল্পের বিদেশী ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। এতে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা ও রিজার্ভ দুটোই কঠিন চাপে রয়েছে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেও বিভিন্ন ধরনের বকেয়া ও ঋণ পরিশোধের চাপ সামলাতে হচ্ছে। বাড়তি এ চাপ সামাল দিতে এরই মধ্যে আইএমএফ, এডিবি, বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে বাড়তি অর্থ চেয়েছে সরকার। যদিও শর্ত পূরণ করতে না পারায় এরই মধ্যে আইএমএফের ঋণের কিস্তির অর্থছাড় আগামী জুন পর্যন্ত পিছিয়ে গেছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মোট বরাদ্দের ২১ দশমিক ৫২ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২৭ দশমিক ১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকার এডিপি বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ব্যয় হয়েছে ৫৯ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। আর গত জানুয়ারিতে মোট বরাদ্দের ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ বা ৯ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকার এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। যেখানে গত বছরের জানুয়ারিতে ব্যয় হয়েছিল মোট বরাদ্দের ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ বা ১২ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট প্রণয়নের কাজ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। প্রাথমিকভাবে সরকারের উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি থেকে কমিয়ে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৮১ হাজার কোটি টাকা। যদিও এ পরিমাণ বিদেশী ঋণ আসবে কিনা সেটি এখনই নিশ্চিত হতে পারছেন না ইআরডির কর্মকর্তারা। তাছাড়া বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উন্নয়ন ব্যয়ের অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে কিনা সেটি নিয়েও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা সংশয়ে আছেন।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অন্যান্য বছরে যখন স্বাভাবিক গতিতে প্রকল্পের কাজ চলমান থাকত, তখনো আমরা শতভাগ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হতাম না। আর এবার তো প্রকল্প কাটছাঁট করা হয়েছে, অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে, দুই মাসের মতো সময় সেভাবে কাজ হয়নি। ফলে এবার বিদেশী সহায়তার পরিমাণ কমবে, এটিই স্বাভাবিক। বিদেশী সহায়তার ক্ষেত্রে আগেরগুলো বাস্তবায়ন না হলে সেগুলো থেকে যায়। এ অবস্থায় নতুন করে কেউ প্রতিশ্রুতি দেবে না। বরং আগেরগুলোই ঘুরেফিরে আসবে। চীনের কাছ থেকে নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতি না আসার কারণ হিসেবে আমার কাছে মনে হয় তারা হয়তো বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। সামনে নির্বাচনের আগে নতুন বিনিয়োগ কিংবা ঋণ সেভাবে আসবে না; বিশেষ করে দ্বিপক্ষীয় দাতাদের কাছ থেকে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপক্ষীয় দাতাদের বিষয় আলাদা। তারা সংকটকালেও কাজ করে। ফলে তাদের কাছ থেকে কিছু আসতে পারে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বর্তমানে একটি রূপান্তরকালীন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। সবাই সেটি পর্যবেক্ষণ করছে। তাই দেশে যত দ্রুত রাজনৈতিক সরকার আসবে সেটিই সবদিক দিয়ে ভালো।’