অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষা সংস্কারে কোনো কমিশন করেনি – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in প্রথম আলো on 9 May 2025

অর্থনীতিবিদ ও গণনীতি বিশ্লেষক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। আজ শুক্রবার সকালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচির পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে। বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তন | ছবি: দীপু মালাকার

অর্থনীতিবিদ ও গণনীতি বিশ্লেষক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বহু কমিশন গঠন করলেও শিক্ষা সংস্কারে কোনো কমিশন করেনি। সরকার শিক্ষাবৈষম্য দূর করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

আজ শুক্রবার সকালে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের উদ্যোগে ঢাকা মহানগরের স্কুলপর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের বইপড়া কর্মসূচির পুরস্কার বিতরণ উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কর্মসূচির সহযোগিতায় রয়েছে গ্রামীণফোন। অনুষ্ঠানের আয়োজক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচির পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান | ছবি: দীপু মালাকার

অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কাঠামোগত সমস্যা হলো মানসম্পন্ন শিক্ষাকাঠামো না থাকা। বর্তমানে শিক্ষিতদের মধ্যে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন বেকার। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বহু কমিশন গঠন করলেও শিক্ষা সংস্কারে কোনো কমিশন গঠন করেনি। বৈষম্য নিরসনের এ সরকার শিক্ষাবৈষম্য দূর করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

অগ্রসর হতে হলে মানসম্পন্ন শিক্ষাকাঠামোর কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘আগামীর বাংলাদেশ বলি কিংবা বিশ্বায়নের বাংলাদেশ, অগ্রসর হতে হলে মানসম্পন্ন শিক্ষাকাঠামোর কোনো বিকল্প নেই। সরকার পাঠক্রম পুনর্বিবেচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করলেও পরবর্তীতে সেখান থেকে পিছু হটে গেল। এটা আমাদের আফসোসের জায়গা।’

শিক্ষায় সবচেয়ে বড় বৈষম্য বিরাজ করছে বলে উল্লেখ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, কেউ ভালো শিক্ষা পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। যার সামর্থ্য আছে, তিনি মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়ছে। কিন্তু যার সক্ষমতা নেই, তারা ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কাজেই সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষদের কথা ভেবে এগোতে হবে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে মানুষ গণতান্ত্রিক চেতনা ও কোটাবিরোধী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। কিন্তু এ আন্দোলনের একটা অন্যতম কারণ ছিল বেকারত্ব। বিগত সময়ে বাংলাদেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ছিল না। ব্যক্তি খাতে কোনো কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। ফলে বেকারত্বে হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তরুণেরা বেকার থাকায় তাঁরা চাকরির খোঁজে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, পাঠ্যবই মানে চাকরি, বৈষয়িক উন্নতি। এখানে আলো খুঁজে পাওয়া যায় না। কাজেই পাঠ্যবইয়ের বাইরে পৃথিবীর সেরা লেখকেরা যা লিখেছেন, সেটা জানতে হবে। সেখান থেকে আনন্দ খুঁজে বের করতে হবে।

মানবসভ্যতা বইয়ের কাছে ঋণী বলে উল্লেখ করেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বলেন, যিনি কখনো বই পড়েন না, বইকে সম্মান করেন না, বই হাত থেকে পড়ে গেলে তিনিও সেটাকে তুলে নিয়ে সযত্নে চুমু খান। কারণ, বই মানুষের অন্ধকার দূর করে। মানুষকে পথ দেখিয়ে আলোকিত করে। একবার কোনো শিক্ষার্থীর রক্তে বইয়ের নেশা লাগলে সারা জীবন সে এই আসক্তিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে লালন করে।

পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ | ছবি: দীপু মালাকার

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের বলেন, ‘এ অনুষ্ঠান আমাদের মনের মধ্যে আশার সঞ্চার করে। শিক্ষার্থীদের বইপড়ার এ প্রতিযোগিতা আমাদের আরও উজ্জীবিত করে।’

আজকের পাঠককে আগামীকালের নেতা বলে উল্লেখ করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী নকী। তিনি বলেন, ভালো বই শুধু গল্প বলে না, পাঠকের কথাও শোনে। যাঁরা বই পড়েন, তাঁরা গভীরে অনুভব করতে পারেন। একটি বই মানুষকে ব্যতিক্রম সব অভিজ্ঞতা ও মোহ উপহার দেয়। যাঁরা পকেটে বই নিয়ে ঘোরেন, তাঁরা যেন একটি সাজানো বাগান নিয়ে ঘুরে বেড়ান।

বইয়ের চেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু আর কেউ নেই বলে উল্লেখ করেন জাদুশিল্পী, বাঁশিবাদক ও চিত্রশিল্পী জুয়েল আইচ। তিনি বলেন, বই পড়লে পৃথিবীর এমন কিছু নেই, যেটা আত্মস্থ করা যায় না। বইয়ের লেখক মারা যেতে পারেন কিংবা লেখকের পরিচয় পাল্টে যেতে পারে, কিন্তু একটি বই যুগের পর যুগ সত্য কথা বলে যেতে থাকে। কাজেই বইয়ের চেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু আর কেউ নেই, কিছু নেই।

বই পড়ুয়ারা একই সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করে বলে মন্তব্য করেন গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তানভীর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, যাঁরা বই পড়েন না, তাঁরা শুধু নিজের প্রান্তে থেকে যায়। গ্রামীণফোন এ উদ্যোগের সঙ্গে থাকতে পেরে গর্বিত। বই পড়ার সময় যে একনিষ্ঠ মনোযোগ তৈরি হয়, সেটাই আগামী প্রজন্মের উৎকর্ষ মানসিকতা তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিয়ে অভিনেতা খাইরুল আলম সবুজ বলেন, ‘আমরা সব সময় ভালো মানুষ তৈরি করতে চাই, ভালো মানুষের কথা শুনতে চাই।’

আগামীর বাংলাদেশ গড়তে হলে বই পড়তে হবে বলে উল্লেখ করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, আজকে যাঁরা এখানে এসেছেন, তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলে আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

পুরস্কার নিচ্ছে এক শিক্ষার্থী | ছবি: দীপু মালাকার

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক আফসানা বেগম বলেন, এখনকার শিক্ষার্থীদের বলা হয়, তারা বই পড়তে চায় না। তাদের প্রযুক্তি গ্রাস করছে। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা ভিন্ন। এই প্রজন্ম যেই বই পড়তে আনন্দ পায়, সেই বই তাদের হাতে কেউ তুলে দেয় না। তবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এ কাজ করছে। একটি বই পাঠককে সর্বোপরি মানুষকে অনেকগুলো বইয়ের কাছে নিয়ে যায়। পড়ার সময় পাঠকের অনেক ইন্দ্রিয় সজাগ থাকে। শিক্ষার্থীরা যত বেশি ভালো বই পড়বে, তত বেশি নিজেদের মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে। জীবনবোধ ও মনুষ্যত্ব তৈরিতে বই অনেক বেশি ভূমিকা রাখে। কাজেই বই পড়া জরুরি।

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক শামীম আল মামুন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগরের ৬৫টি স্কুলের ২০ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে পাঁচ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে আজ শুক্রবার ও আগামীকাল শনিবার আটটি পর্বে পুরস্কার দেওয়া হবে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দেশভিত্তিক এই বইপড়া কর্মসূচির আওতায় প্রায় ১ হাজার ৪০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আড়াই লাখ শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।