আমরা প্রবৃদ্ধির হার এ বছরেই ৭ শতাংশের ওপরে নিতে চাই। গত কয়েক বছর ধরেই এটা লক্ষ্য। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে যেতে হলে এ বাধা জয় করতে হবে। আর সেজন্য চাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাত থেকে আরও বেশি অবদান।
Published in Samakal on Monday, 5 October 2015.
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
শিল্প-বাণিজ্যের কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টিতে যা জরুরি
ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
বাংলায় প্রবাদ রয়েছে_ আদার বেপারীর জাহাজের খবর রাখা নিয়ে। প্রধানত ব্যঙ্গার্থেই এর ব্যবহার হতে দেখা যায়। কিন্তু এখন বাংলাদেশের আদার বেপারীরও জাহাজের খবর রাখতে হয়। আরও অনেক ধরনের ব্যবসায়ীকেও জানতে হয় বিশ্ববাজারের সর্বশেষ হাল-হকিকত। কোন পণ্যের দাম বাড়ছে বা কমছে, কোন কোম্পানির জাহাজে পণ্য রফতানি বা আমদানি করলে সুবিধা, চট্টগ্রাম নাকি মংলা_ কোন বন্দরের পণ্য খালাস বা বোঝাই করলে সময় কম লাগে এবং অর্থের সাশ্রয় হয়_ এমনি নানা খবর তাদের জন্য জরুরি। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কোন পর্যায়ে সেটাও ব্যবসায়ীদের জানতে হয়। কোথায় সুবিধার মাত্রা বেশি এবং সেটার সর্বোত্তম ব্যবহার কীভাবে করা সম্ভব সেটা যেমন জানা থাকা চাই, তেমনি যেসব ক্ষেত্রে দুর্বলতা ও ঘাটতি রয়েছে তা দূর করার বিষয়টিও উপেক্ষার উপায় থাকে না। এসব ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশের অনেক গবেষণাধর্মী ও আর্থিক বিষয়ের প্রতিষ্ঠান থেকে মেলে সহায়তা। তারা বিশ্ব অর্থনীতির পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে এবং তার ফল সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। গ্গ্নোবাল কম্পিটিটিভনেস রিপোর্ট এমনই একটি উৎস, যা একই সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য এবং সহজলভ্য। প্রতি বছর এর প্রতিবেদন প্রকাশ হয় এবং তা বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে ২০১৫-১৬ সময়ের প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির পক্ষ থেকে। একই সঙ্গে তুলে ধরা হয় বাংলাদেশে ব্যবসায়ের পরিবেশ সংক্রান্ত স্টাডির প্রতিবেদন।
গ্গ্নোবাল কম্পিটিটিভনেস রিপোর্টে দেখা যায়, উন্নত দেশগুলোই রয়েছে শীর্ষ দশটি স্থানে। সুইজারল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুর পরপর কয়েক বছর রয়েছে প্রথম দুটি স্থানে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তৃতীয়। বাংলাদেশের অবস্থান দুই ধাপ উন্নত হয়েছে_ ২০১৪ সালে ছিল ১৪০টি দেশের মধ্যে ১০৯তম, এবারে ১০৭। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার (ম্যাক্রো ইকোনমি) উল্লেখযোগ্য উন্নতি এ সময়ে ঘটেছে_ র্যাংকিং ৭২ থেকে ৪৯। অবকাঠোমো ক্ষেত্রে উন্নতি অবশ্য তেমন বেশি নয়, ১২৭ থেকে ১২৩। বাজারের আকারের স্থান ৪৪ থেকে ৪০-এ উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের এ পরিবর্তন ঘটেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে সামগ্রিক কিছু নেতিবাচক প্রবণতার মধ্যে। অনেক উন্নত দেশে এখন প্রবৃদ্ধির হারে শ্লথগতি। বেকারত্বের হার রয়েছে উচ্চ পর্যায়ে। তার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির ওপরে পড়ছে। কিন্তু এর মধ্যেও দুই ধাপ উন্নতি উল্লেখযোগ্য। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, গত বছরের তালিকায় বাংলাদেশের ওপরে থাকা দুটি দেশকে এবারে টেকনিক্যাল কারণে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বিষয়টি যেমন নিজ দেশের কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে, একই সঙ্গে তাতে প্রভাব ফেলে অন্য অনেক দেশের কর্মকাণ্ড। যেমন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন ক্রমশ বাড়ছিল, তখন তেল রফতানিকারক দেশগুলো তা থেকে বিপুলভাবে লাভবান হয়। বাড়তি আয়ের সুবাদে তারা বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে থাকে। সে সময়ে তেল আমদানিকারক দেশগুলোতে পড়তে থাকে এর নেতিবাচক প্রভাব। এখন আমরা দেখছি ভিন্ন চিত্র। তেলের দাম অনেক কমে গেছে এবং এর ফলে আমদানিকারক দেশগুলোর ব্যয় কমছে। তেলের দাম কমে যাওয়ার কারণে বিশ্ববাজারে আরও কয়েক ধরনের পণ্যের দাম কিছুটা কমেছে। পরিবহন ব্যয়ও কমেছে। এ থেকে লাভবান হচ্ছে বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দেশ, যারা শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদা মেটাতে বিশ্ববাজারের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল।
সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রাপ্ত সুযোগকে কাজে লাগাতে পারার বিষয়টিকেও মনে রাখতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভারসাম্য বজায় রয়েছে। মৌলভিত্তিক সূচকে কোথাও কোথাও এগিয়েছে। আমাদের রফতানি বাড়ছে এবং কিছু প্রতিকূলতা ও জটিলতার পরও হিস্যা ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মুদ্রার বিনিময় মূল্য স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বেড়েছে। আকাশ পথের উন্নতি ঘটছে। তবে ব্যবসায়ীরা সড়ক ও নৌপথের প্রতি আরও মনোযোগ প্রত্যাশা করেন। এ থেকে করণীয় স্পষ্ট_ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং তা থেকে ভালো ফল আদায়।
ব্যবসা-বাণিজ্যের যথাযথ পরিবেশের জন্য আরও দুটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে, যেখানে জরুরি পদক্ষেপ চাই_ সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বাংলাদেশ এখনও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের ধারেকাছেও নেই। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের অবস্থান এ সূচকে সর্বনিম্ন দশটি দেশের সারিতে। আমাদের অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং সুশাসনের প্রতি নজর দিতে হবে।
আমাদের শিক্ষার প্রসার ঘটছে, তাতে সন্দেহ নেই। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫ কোটি ছাত্রছাত্রী পড়ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র ও ছাত্রীদের অনুপাত সমান। কিন্তু এখন নজর চাই মানের প্রতি। টেকসই উন্নয়নের যে ১৭টি লক্ষ্য জাতিসংঘ নির্ধারণ করেছে তাতেও শিক্ষার মানের ওপর জোর দিতে বলা হয়েছে। দক্ষতা বৃদ্ধির সূচক উন্নত করতে হলে বাংলাদেশকে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আরও যেসব বিষয়ে মনোযোগ চাই সেগুলো হচ্ছে_ আর্থিক খাতের উৎকর্ষতা বাড়ানো, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি এবং বাজারের দক্ষতা বৃদ্ধি। আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার বড় হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা এ বাজারকে উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসেবে গণ্য করছেন। দেশে রয়েছে বড় একটি ক্রেতা গোষ্ঠী। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে কৃষি খাতের ধারাবাহিক সাফল্য, তৈরি পোশাকশিল্পের লাখ লাখ কর্মীর উপার্জন এবং প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশিদের নিয়মিত পরিবারের সদস্যদের কাছে অর্থ প্রেরণ।
ব্যবসায়ীরা অগ্রযাত্রার পথের সমস্যা হিসেবে আর্থিক খাতে দক্ষতা বাড়ানোর বিষয়টিকে সামনে এনেছেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক থেকে নেওয়া সুদের হার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর ফলে শিল্প-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার পেছনে ব্যয় বেশি পড়ছে। এখানের অডিট মান দুর্বল, সিকিউরিটিক এক্সচেঞ্জ কমিশন দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে না।
তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়েও মনোযোগ চাই। এ খাতের গুরুত্ব বাড়ছে। মোবাইল ফোনের গ্রাহক ১৩ কোটি, এটি ভালো খবর। ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছায় ঘাটতি নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের স্লোগান সুফল দিতে শুরু করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এ সুবিধা ব্যাপকভাবে কাজে লাগানোর আয়োজন তেমন লক্ষ্য করা যায় না। ই-বেজড লেনদেন, ওয়েব-বেজড বিজনেস মডেল_ এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। শিক্ষার সঙ্গে ব্যবসায়ের সংযোগ সাধনও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেই। এ সূত্রে প্রযুক্তি হস্তান্তরও খুব একটা ঘটছে না।
ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য দক্ষ মানবসম্পদের অব্যাহত জোগান থাকা চাই। কিন্তু অর্থনীতিতে যে মানের দক্ষ কর্মীর চাহিদা রয়েছে, সেটা মিলছে না বাংলাদেশে। দেশে পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী_ এটা বড় অর্জন। কিন্তু উচ্চমানের কর্মীর জোগান কোথায়? স্বাস্থ্য খাতেও নজর চাই। সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু অনেক মানুষ রয়ে গেছে, যারা এ সেবা থেকে বঞ্চিত থাকছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে সেবার মান নিয়ে।
আমরা প্রবৃদ্ধির হার এ বছরেই ৭ শতাংশের ওপরে নিতে চাই। গত কয়েক বছর ধরেই এটা লক্ষ্য। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে যেতে হলে এ বাধা জয় করতে হবে। আর সেজন্য চাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাত থেকে আরও বেশি অবদান।
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধাগুলো কী কী_ এ প্রশ্নে পরপর দু’বছরেই ( ২০১৪ ও ২০১৫) ব্যবসায়ীরা বলছেন অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর কথা (গত বছর ছিল ২০.৩ এবং এ বছর ১৮.৬ শতাংশ); এর পরেই রয়েছে দুর্নীতি (গত বছর ১৯.৭ এবং এ বছর ১৮.২ শতাংশ); অদক্ষ সরকারি আমলাতন্ত্রের স্থান তৃতীয় (যথাক্রমে ১৪.৫ এবং ১২ শতাংশ)। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়_ এই তিনটি বিষয়ের কথা এ বছর উল্লেখ করেছেন মোট উত্তরদাতাদের ৪৮.৮ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৫৪.৫ শতাংশ। এ অগ্রগতি ধরে রাখা এবং উন্নতি হার আরও দ্রুততর করতে পারা চাই। ব্যবসায়ীরা প্রবৃদ্ধির পথে আরও যেসব সমস্যার কথা বলেছেন তার মধ্যে রয়েছে, সরকারের স্থিতিশীলতা বিষয়ে সংশয়। গত বছর এ সংশয় ছিল ৯.৪ এবং এবারে ১১.৬ শতাংশ। এ বিষয়টি রাজনৈতিক, কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশিরাও এ সংক্রান্ত তথ্য খুঁটিয়ে দেখেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে। তারা জাতীয় সংসদকে সর্বদা কার্যকর দেখতে চান। এটাও কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার সূত্রে লাভবান হচ্ছে। এ কারণে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের যা সমস্যা, তাদের জন্য এটা প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। সংসদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য রয়েছেন, যাদের মূল পরিচয় রাজনীতিক নয়, বরং ব্যবসায়ী। তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েন না। তবে সব ব্যবসায়ী এ সুবিধা ভোগ করেন না। তাদের দেশের বাজারে দেশীয় উৎপাদক ও আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। বিশ্ববাজারেও প্রতিযোগিতা করতে হয়। বাজারভিত্তিক কাঠামোতে আমরা সফলভাবে প্রবেশ করতে চাই। এখানে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকতে হবে। যারা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারে এবং যারা পারে না_ এই দুয়ের মধ্যে কোনো বৈষম্য চলবে না। আমাদের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা কৃষক সবার সঙ্গেই কিন্তু দেশি-বিদেশি বাজারের সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে। তারাও নতুন বিশ্বব্যবস্থা থেকে লাভবান হতে পারেন। আর এটা নিশ্চিত করতে পারলেই দেশ নিকট ভবিষ্যতে মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে পেঁৗছানোর লক্ষ্য অর্জন করতে পারে।
অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক, সিপিডি