Originally posted in দেশ রুপান্তর on 2 August 2023
৩ মাসে কাজ হারিয়েছে ৪ লাখ
একদিকে গ্যাসের সংকট, বিদ্যুতের সংকট; অন্যদিকে আমদানিনির্ভর পণ্য উৎপাদন ঋণপত্র খুলতে না পারায় সংকটে শ্রমজীবীরা। প্রভাব পড়েছে দেশের দুই প্রধান খাতে। কৃষি ও শিল্প খাতের শ্রমজীবীদের কাজের সুযোগ কমে গেছে। শুধু সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, গত তিন মাসের ব্যবধানে দেশের বিভিন্ন খাতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেছে প্রায় চার লাখ। এর মধ্যে কৃষি ও শিল্প খাত থেকে ঝরে পড়ার হারই বেশি। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে (এপ্রিল-জুন) এসব তথ্য উঠে এসেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প খাতে গ্যাসের প্রেশার কম থাকা ও বিদ্যুৎ না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে তাদের কর্মী ছাঁটাই করতে হয়েছে। অন্যদিকে তীব্র গরম ও আমদানি নির্ভরশীলতার কারণে কৃষি খাতের শ্রমিকরা কাজ হারিয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, কৃষি থেকে যারা বের হয়ে আসছেন তাদের শিল্প খাতে আমরা কর্মসংস্থান করতে পারছি কি না, এটি আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।
জরিপে দেখা যায়, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত দেশের তিন খাতে কর্মে নিয়োজিত শ্রমশক্তির সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজার। অথচ এর আগের তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) এসব খাতে শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১১ লাখ। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে এসব খাত থেকে সরে পড়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার মানুষ। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা কমেছে প্রায় চার লাখ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, যারা গত সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টা বেতন-মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে অথবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনে কাজ করেছে, তারাই কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
দেশের অর্থনীতিতে কৃষি এখনো প্রধান খাত হিসেবে আছে। এ খাতের শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি কাজ হারিয়েছে। এ তিন মাসের ব্যবধানে এ খাত থেকে কাজ হারিয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার বা প্রায় ৮ লাখ কাজে নিয়োজিত থাকা শ্রমিক। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে কৃষি খাতে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত শ্রমিক ছিল ৩ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার জনগোষ্ঠী। কিন্তু মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে এ খাতের নিয়োজিত থাকা শ্রমিক কমে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার।
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে শিল্প খাত। এ খাতেও বিভিন্ন সংকটের কারণে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। সর্বশেষ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে শিল্প খাতে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২১ লাখ ২০ হাজার। অথচ তিন মাস আগেও এসব খাতে একই পেশায় নিয়োজিত ছিল ১ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার। তিন মাসের ব্যবধানে শিল্প খাত থেকে শ্রমিক কমেছে ১ লাখ ৩০ হাজার।
শিল্প খাতের কাজে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হঠাৎ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন দেশ রূপান্তরকে বলেন, এটি বাস্তবসম্মত জরিপ। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আজ যাদের সক্ষমতা আছে, তারা শ্রমিক কমিয়ে কারখানা চালু রাখার চেষ্টা করছে।
এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, গ্যাস না থাকার কারণে, বিদ্যুৎ না থাকার কারণে বা অনেক ক্ষেত্রে গ্যাস আছে কিন্তু প্রেশার নেই আবার অনেকে রপ্তানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না, চাহিদা নেই, রপ্তানির ক্রয়াদেশ কমে গেছে ইত্যাদি কারণে এর প্রভাব পড়েছে শ্রম খাতে। এ ছাড়া সবদিকেই সংকট যাচ্ছে, বাজার নিম্নমুখী সব মিলিয়ে শিল্প খাতের সংকট খুব বেশি। এ কারণেই অনেককে শ্রমিক ছাঁটাই করতে হচ্ছে।
দেশের কৃষি ও শিল্প খাতের কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমলেও সেবা খাতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী বেড়েছে। জুন শেষে দেশের সেবা খাতের নিয়োজিত জনগোষ্ঠী ২ কোটি ৭৪ লাখ ৪০ হাজার। এর আগের প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) এ খাতে কাজে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার। অর্থাৎ সেবা খাতে তিন মাসের ব্যবধানে কাজ পেয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার জনগোষ্ঠী।
দেশের তিন খাতে কাজে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী কমে যাওয়ার ব্যাখ্যা হিসেবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কৃষি খাতে কাজে নিয়োজিত শ্রমিক কমে যাওয়ার কারণ অনেকে শহরে চলে আসছে, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে। কৃষিতে শ্রমশক্তি কমার প্রবণতা খারাপ না। কারণ সেখানে যান্ত্রিকীকরণ বাড়ছে, উৎপাদন বাড়ছে। প্রশ্নটা হলো, কৃষি থেকে যারা বের হয়ে আসছে তাদের শিল্প খাতে আমরা কর্মসংস্থান করতে পারছি কি না, এটি আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি আরও বলেন, আমাদের চেষ্টা করতে হবে শিল্প খাতে বেশি কর্মসংস্থান করে কোয়ালিটি অব জিডিপি কীভাবে বাড়াব। শুধু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করলেই তো হবে না কীভাবে ভালো মজুরি দেওয়া যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের উৎপাদন খাতে আমাদের কর্মীদের শোভন কাজে নিয়োজিত করতে পারি, এটার দিকে নজর দেওয়া জরুরি।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, কাজে নিয়োজিত নেই (নিট) এমন জনগোষ্ঠী অনেক বড়। মহিলাদের কর্মসংস্থান মাত্র ৩৬ শতাংশ। এসব বিষয় বিবেচনায়, শ্রমশক্তির মানোন্নয়ন, উৎকর্ষতা, দক্ষতার দিকেই বেশি নজর দিতে হবে।
এ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, আগের তিন মাসের তুলনায় এ তিন মাসে বেকার কমেছে ৯০ হাজার। বর্তমানে দেশে বেকার জনগোষ্ঠী ২৫ লাখ। আগের প্রান্তিকে এ সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এপ্রিল-জুন মাসে আগের প্রান্তিকের চেয়ে বেকারের হার কিছুটা কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৪১। এর আগের প্রান্তিকে এ হার ছিল ৩ দশমিক ৫১। বিবিএস বলছে, এখন বেকারদের মধ্যে ১৬ লাখ ৭০ হাজার পুরুষ ও নারী মাত্র ৮ লাখ ৩০ হাজার।
বেকার লোকের হিসাবটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী করে বিবিএস। আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, গত ৩০ দিন ধরে কাজপ্রত্যাশী একজন মানুষ যদি সর্বশেষ সাত দিনে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ না পান, তাহলে তাকে বেকার হিসেবে ধরা হবে।