Published in আলোকিত সকাল on Monday 7 August 2020
মেঘ কাটছে অর্থনীতির
করোনাভীতি কাটিয়ে মানুষ শামিল হচ্ছে জীবিকার মিছিলে। আর সরকারের নিষেধাজ্ঞা শিথিলের কারণে ক্রমেই গতি ফিরছে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে। ঈদুল আজহাকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য, গণপরিবহন সচল থাকায় অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার হয়েছে। ঈদের সময় রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে। নেতিবাচক ধারায় চলে যাওয়া রপ্তানি খাতও নতুন অর্থবছরে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। পুঁজিবাজারেও চাঙ্গা ভাব দেখা যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও শক্ত অবস্থানে আছে। করোনা অর্থনীতির নানা খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও কৃষি তুলনামূলক শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে রাজস্ব আয়, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান এখনো নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। সে কারণে অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে ফিরতে আরো সময় লাগবে। এর জন্য কার্যকরভাবে করোনা মোকাবেলার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোয় নীতি সহায়তা জোরদার এবং প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়ন করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কলকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল করে দেওয়ার মতো সাহসী সিদ্ধান্তের ফলেই অর্থনীতির কালো মেঘ কেটে যাচ্ছে। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার ঘোষণা দেয় সরকার। এরপর ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় গত ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে জরুরি সেবা, কাঁচাবাজার, নিত্যপণ্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট, শপিং মল খুলে দেওয়া হয়। এরপর গণপরিবহনও চালু করা হয়। সর্বশেষ ঈদুল আজহার আগে দোকানপাট ও বিপণিবিতান রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ঢাকাসহ চার জেলা থেকে জনচলাচল বন্ধ রাখার পরামর্শ থাকলেও গণপরিবহন সচল রাখা হয়। ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা : বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে, ঈদুল আজহার সময় ১২ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। করোনার মধ্যে এই ঈদে কাঙ্ক্ষিত বিক্রি না হলেও ব্যবসা আবার চালু হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে। সাধারণ ছুটির কারণে মানুষ অনলাইন শপিংয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। অবশ্য দোকানপাট স্বল্প পরিসরে খোলার পর মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বের হচ্ছে। সরকারের নিষেধাজ্ঞা শিথিলের কারণে ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন বলে জানালেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘কোরবানির ঈদের সময় বিক্রি ১০ শতাংশ বেড়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘টিকে থাকার জন্য আমাদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যদি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা না পান তাহলে খুবই করুণ অবস্থা হবে। প্রায় এক কোটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর একটি বড় অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’ বাংলাদেশে মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলছিলেন, ‘কোরবানির ঈদে অনলাইন এবং ফিজিক্যাল লাইফস্টাইল স্টোরগুলোতে কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটা বেড়েছে। এ ছাড়া গ্রোসারি, হোম অ্যাপ্লায়েন্সসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্য জিনিসপত্রের অনলাইন কেনাকাটাও ক্রমে বাড়ছে। আশা করা যাচ্ছে, এই লেনদেনের পরিমাণ খুব শিগগির আরো স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’ দেশীয় ফ্যাশন হাউস অঞ্জনসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীন আহমেদ বলেন, ‘করোনার কারণে আমরা বৈশাখ, রোজার ঈদের ব্যবসা হারিয়েছি। কোরবানির ঈদে দোকান খোলা রাখার সময় বাড়ানোয় বিক্রির ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। যদিও তা গত বছরের অর্ধেক।’ এক কোটি পশু বিক্রি : করোনার পাশাপাশি দেশের ৩৩টি জেলায় বেশ কিছুদিন ধরে বন্যা থাকায় এবার দেশে পশু কোরবানি হয়েছে ৫ শতাংশ কম। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, এবার এক কোটি পশু কোরবানি হয়েছে। গতবার এই সংখ্যা ছিল এক কোটি ছয় লাখ। অনলাইন কোরবানির পশুর হাট থেকে ২৭ হাজার গরু-ছাগল ও অন্যান্য পশু বেচাকেনা হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে দশ গুণ বেশি বলে জানিয়েছে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)। ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার বলেন, ‘নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ক্রেতাদের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ক্রেতাদের সুবিধা এবং উদ্যোক্তাদের সুবিধা দুটিই আমাদের দেখতে হয়েছে। শুধু ডিজিটাল হাট প্ল্যাটফর্ম ঘিরে এবার বেশ কয়েকজন নতুন অনলাইন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে।’ রেমিট্যান্সে রেকর্ড : বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেও শুধু জুলাই মাসে প্রবাসীরা ২৬০ কোটি মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। একক মাস হিসেবে এর আগে কখনো এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। এর আগে জুন মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮৩ কোটি ডলার। প্রবাসী আয়ের এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকার জন্য সরকারের সময়োপযোগী ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘ঈদ আর সংকটকালে রেমিট্যান্স বেশি আসে। করোনায় অনেকে মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে প্রবাসীরা নিজে না খেয়েও পরিবারের জন্য বেশি বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। করোনাকালে হুন্ডি বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। আবার অনেকে প্রবাসেও চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁদের একটি অংশ সঞ্চিত অংশ ফেরত পাঠাচ্ছে। ভবিষ্যতে নতুন কর্মসংস্থান না বাড়লে রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
নতুন উচ্চতায় রিজার্ভ : দেশের ইতিহাসে এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৭ দশমিক ২৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে (তিন হাজার ৭১৮ কোটি) উন্নীত হয়েছে। গত ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৬ দশমিক ০১৬ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে রেমিট্যান্সের প্রবাহ। কৃষি ও সেবা খাত : করোনাকালে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে কৃষি। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১৫.৪৪ শতাংশ অবদান কৃষি ও সেবা খাতের। কৃষিপণ্য রপ্তানি থেকে গত অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথম ছয় মাসে আয় হয়েছে ৫২ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। কর্মসংস্থানেও বড় ভূমিকা রাখছে খাতটি। আয় কমে যাওয়ায় শহরত্যাগী মানুষগুলোকেও ধারণ করেছে গ্রামীণ অর্থনীতি। রপ্তানি আয় ইতিবাচক ধারায় : নতুন অর্থবছরের শুরুতেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের রপ্তানি খাত। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রথম মাস জুলাইয়ে পণ্য রপ্তানি করে ৩৯১ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরের জুলাইয়ের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ০.৫৯ শতাংশ। যদিও এটি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩.৩৯ শতাংশ কম। তবে তৈরি পোশাক রপ্তানি আয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। যদিও কমেছে প্রবৃদ্ধি। জুলাই মাসে এই খাতে আয় ৩২৪ কোটি ডলার। এ সময় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৭২ হাজার একক কনটেইনার, যা বিগত ১৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতির (বিজিএমইএ) প্রথম সহসভাপতি আবদুস সালাম বলেন, ‘কারখানা খোলার ব্যাপারে সরকারের সঠিক, চ্যালেঞ্জিং ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণেই আমরা রপ্তানিতে বড় সুফল পাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনা, নীতিগত সহায়তা এবং শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার আন্তরিকতাও প্রশংসা করার মতো।’ আমদানি বাড়ছে : করোনার মধ্যেও আমদানিতে ইতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত জুন মাসে আমদানিতে প্রায় ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যদিও গত অর্থবছরে আমদানি কমেছে প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ। পুঁজিবাজারে লেনদেনে উন্নতি : দীর্ঘদিন ধরে নিস্তেজ পুঁজিবাজারেও গতি ফিরেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) জুন মাসের চেয়ে জুলাইয়ে শেয়ার লেনদেন বেড়েছে। বেড়েছে নতুন বিনিয়োগও। ডিএসইর তথ্যানুযায়ী, জুন মাসে চার হাজার ৭৮০ কোটি ১৩ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। সদ্য শেষ হওয়া জুলাই মাসে এই লেনদেনের পরিমাণ ছিল ছয় হাজার কোটি টাকা। আর মূলধন বেড়েছে ১৩ হাজার ৭৬৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সূচক বেড়েছে ২২৫ পয়েন্ট। যেসব খাতে গতি ফেরাতে হবে : বিদেশি বিনিয়োগ, বৈদেশিক বাণিজ্য, রাজস্ব আয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি—এসব ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারা চলছে। এ ছাড়া ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে। কমেছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি। অর্থনীতি ও বিনিয়োগ বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটি টাস্কফোর্স করে ব্যবসার পরিবেশ দ্রুত উন্নত করতে হবে।’ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমছে। আবার করোনার ক্ষতি মোকাবেলায় প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের চাপ রয়েছে। এর মধ্যেও যদি বাণিজ্যিক ব্যাংকের তহবিলে সরকার ভাগ বসিয়ে দেয়, তাহলে সেটা বেসরকারি খাতের জন্য নেতিবাচক। কারণ সরকার ঋণ না নিলে এই টাকা বেসরকারি খাতে যেত।’ অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে : অর্থনীতিবিদ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে আরো কার্যকরভাবে করোনা মোকাবেলা করতে হবে।’ তিনি বলেছেন, সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা যাদের পাওয়ার কথা তারা যাতে পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যাঁরা কাজ হারাচ্ছেন তাঁদের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার প্রকল্পগুলোকে আরো জোরদার করতে হবে এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে যাতে দুর্নীতি না হয় সেটি দেখতে হবে। এ ছাড়া আস্তে আস্তে উৎপাদনব্যবস্থা পুরোপুরি সচল করতে হবে এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চাহিদা বাড়াতে হবে।