Originally posted in সমকাল on 10 November 2022
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে এবং ক্রমান্বয়ে তা নিচের দিকে যাচ্ছে। এটি আসলে ভালো অবস্থা নয়, কাঙ্ক্ষিত নয়। এ অবস্থার কারণ, রপ্তানি আয় যতটুকু বাড়ছে, আমদানি ব্যয় তার চেয়ে অনেক বেশি হারে বাড়ছে। এর ওপর রেমিট্যান্স প্রবাহ নেতিবাচক। এর ফলে চলতি হিসাবে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক বিষয়। আমাদের শিল্প উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল, জ্বালানি তেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া অন্যান্য ভোগ্যপণ্য ও বিলাসী পণ্য তো রয়েছেই। যে হারে আমদানি ব্যয় বাড়ছে, তাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবশ্যই একটা স্বস্তিকর অবস্থায় থাকা খুব প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দেখলাম, গত এক বছরের মধ্যে রিজার্ভ খুব দ্রুত নেমে গেছে। সে পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণ চেয়েছে। আগে থেকেই এ ঋণ চাওয়া হয়েছে, যা একটা ভালো দিক। সরকার বুঝতে পেরেছে, ঘাটতিটা আরও বেড়েও যেতে পারে। শ্রীলঙ্কা সংকটে পড়ে যাওয়ার পর আইএমএফের কাছে ধরনা দিয়েছে। তাদের অর্থ পেতে অনেক সময় লেগেছে। আমাদের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো নয়। তার পরও চিন্তা বা উদ্বেগের কিছু দিক তৈরি হয়েছে। বৈদেশিক খাত অনেকটাই বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। কাজেই এখানে আমাদের প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয় রয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, আইএমএফ কিছু শর্তসাপেক্ষে ঋণ দিয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশ যখন তাদের কাছে ঋণের জন্য যায়, তখন তারা কিছু বিষয় দেখে থাকে। আইএমএফ নিশ্চিত করতে চায়, ঋণগ্রহীতা দেশ তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উন্নতি করবে এবং তারা ফেরত দিতে পারবে। এ জন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশ বা যে কোনো স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, সুশাসন এবং অনুশাসন সবসময় ভালো থাকে, তা নয়। তাই তাদের ঋণে শর্ত থাকে। বাংলাদেশ আগেও যখন আইএমএফের ঋণ নিয়েছে, তখনও শর্ত মেনেই ঋণ নিয়েছে। শর্তের মধ্যে মোটাদাগে কী কী থাকে, আমরা সবাই জানি। মূলত তারা কিছু সংস্কারের কথা বলে। অর্থনীতি সম্পর্কিত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। এবার তারা বলেছে, বাংলাদেশের জন্য আর্থিক খাত, রাজস্ব খাত, জ্বালানি খাত ইত্যাদিতে এক ধরনের সংস্কার আনতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হবে। অর্থনীতিতে যে কোনো নাজুক অবস্থা মোকাবিলা করতে এবং কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। উন্নয়ন যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়, পরিবেশবান্ধব হয়- সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর্থিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো এবং বিভিন্ন দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতার কথা বলেছে তারা। এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় বলা হয়েছে, তা হচ্ছে মূল্যস্ম্ফীতি কমানো এবং আধুনিক মুদ্রানীতি কাঠামো। এটি বলতে গিয়ে তারা সুশাসন নিশ্চিত করা, সুদের হারের সীমা তুলে দেওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছে।
তারা বলেছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা যাতে বজায় থাকে এবং সম্ভাবনা যাতে আরও এগিয়ে নেওয়া যায়, সে জন্য সহায়ক বাণিজ্য খাত তৈরি করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের পদক্ষেপ নিতে হবে। আর্থিক খাত শক্তিশালী ও বৈচিত্র্যময় করা দরকার। মানবসম্পদ উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। সুশাসনের কথা তো তারা বারবারই বলেছে। এগুলোর মাধ্যমে যাতে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়- সে কথা তারা বলেছে।
আইএমএফ তিনটি উইন্ডোতে ঋণ দিচ্ছে। এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ), এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইইএফ) এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ)। আরএসএফ নতুন একটা উইনডো, যা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত। এতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ব্যবস্থা শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে এমন একটা অবস্থা থাকতে হবে, যাতে জলবায়ু সম্পর্কিত অনেক বিনিয়োগ হয়। জলবায়ু বা পরিবেশবান্ধব শিল্প-কারখানা করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাড়াতে হবে। শিল্প-কারখানা থেকে দূষণ বন্ধ করতে হবে।
শুরুতে আমি রাজস্ব খাতের কথা বলেছিলাম। কর-জিডিপির অনুপাত আমাদের ৯ শতাংশের কম। এত কম কর-জিডিপির অনুপাত থাকলে আমাদের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে কষ্ট হবে। এ ছাড়া দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমস্যা হবে। এ জন্য আমাদের রাজস্ব বাড়াতে হবে। কিন্তু আমাদের তো সে অবস্থা নেই। সেই শক্তি কিন্তু আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি। সে জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানো দরকার বলে আইএমএফ মনে করছে। আইএমএফ এসব শর্ত দিচ্ছে তাদের ম্যান্ডেটের অংশ হিসেবে। কিন্তু এগুলো তো আমাদের নিজেদেরই করার কথা। বাংলাদেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করতে সংস্কার কার্যক্রম তো একটা চলমান বিষয় হওয়া উচিত। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এর আগে আমাদের যেসব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হয়েছে, সেগুলো দাতা সংস্থাগুলোর ঋণের শর্তের কারণে হয়েছে। আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে সেগুলো করতে পারিনি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও যদি আমরা কারও শর্তের কারণে সংস্কার করি, তাহলে তো আমাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার যে সক্ষমতা রয়েছে, তা বোঝা যাবে না। আমরা কেন দাতা সংস্থার অপেক্ষায় থাকব? তাদের টাকা নেব, তার বিনিময়ে সংস্কার করব- এট তো শোভনীয় নয়। আমরা যদি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন করতে চাই, তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং সুশাসন নিশ্চিত করার কাজ নিজেদেরেই করতে হবে। সেটা দুঃখজনকভাবে হয়নি। এখন মনে করা হচ্ছে, আইএমএফ ঋণের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছে, সেগুলো করতেই হবে। তাদের ঋণের অর্থ একবারে আসবে না। চার বছর ধরে আসবে সাতটা কিস্তিতে। একেকটা কিস্তির পর কোন বিষয়ে কী অর্জিত হলো দেখে পরের কিস্তি ছাড় করা হবে।
ভর্তুকির বিষয়ে আইএমএফের বিবৃতিতে স্পষ্ট করা হয়নি। ভর্তুকি সার্বিকভাবে ভালো নয়। এতে সম্পদের অপচয় হয়। তবে আমাদের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা খাতের জন্য কিছুদিন পর্যন্ত প্রয়োজন অনুসারে ভর্তুকি দিতেই হবে। এ ক্ষেত্রে ভর্তুকি বন্ধ করা ঠিক হবে না।
সব মিলিয়ে আশা করি, এখন যে ঋণটা দেওয়া হবে, তার মাধ্যমে অর্থনীতিতে আশ্বস্ত হওয়ার মতো একটা অবস্থা তৈরি হবে। ঋণের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারব- এটাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা। সবশেষে আবারও বলব, বাংলাদেশকে নিজে থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া ও বাস্তবায়ন করা দরকার।