Originally posted in প্রথম আলো on 1 May 2022
সদ্য প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি একজন জনমনস্ক উদার ব্যক্তিত্ব ছিলেন। একজন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক মানুষ। ছিলেন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। অভিজ্ঞ প্রশাসক ছিলেন, প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কিছু সাফল্যের সঙ্গে তাঁর নাম বহুদিন ধরে উচ্চারিত হবে। যেমন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ, নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) প্রাথমিক সাফল্য। বাংলাদেশের মতো দেশে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। পিছিয়ে পড়া মানুষদের কথা মাথায় রাখার চেষ্টা করতেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় এমন একটি জায়গা যেখানে নেতৃত্বে সততার প্রয়োজন হয় সবচেয়ে বেশি। কষ্টিপাথরের বিচারে সততায় নিঃসন্দেহে উত্তীর্ণ হয়েছেন আবদুল মুহিত। যখন অন্যায় কিছু হতো, তখন তাকে বিচলিত হতে দেখেছি।
একটি ঘটনা মনে হচ্ছে। আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৮২-১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ওই সময়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল। আমরাও সেই আন্দোলনের মাঠের সৈনিক ছিলাম। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয় অর্থনীতি সমিতির কাজ নিয়ে। তাঁর ওই সময়ের বাজেট-সম্পর্কিত একটি সভার আয়োজন করেছিল অর্থনীতি সমিতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দোতলায় সভাটি হয়। ওই সভায় বক্তব্যে তিনি ক্ষমতাসীন এরশাদ সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর ওই সব সমালোচনা শুনে তখন সভায় উপস্থিত আমরা সবাই বেশ বিস্মিত হয়েছিলাম। এর কয়েক দিন পরেই তিনি ওই সরকার থেকে পদত্যাগ করে বিদেশে চলে যান।
মনে পড়ে, ১৯৯৬ সালের মার্চে একদিন ‘জনতার মঞ্চে’-এর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ রাজনৈতিক আলোচনার কথা। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে কথা বলেছিলাম।
এক সময় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত আসতেন। ২০০০ থেকে ২০০৭ সময়কালে বিভিন্ন বিষয়ে স্বভাবসুলভ সোচ্চার বাচনভঙ্গিতে সিপিডির অনুষ্ঠানে বিতর্কে অংশ নিতেন। মনে আছে, স্থানীয় সরকার নিয়ে এক সংলাপে খুবই আবেগতাড়িতভাবে মতামত দেন।
পরবর্তীতে, সিপিডি কিংবা আমাদের সম্পর্কে অনেক বিষয় নিয়ে তিনি সমালোচনা করেছেন। কিন্তু সামনাসামনি দেখা হলে কোনো তিক্ততার বহিঃপ্রকাশ হয়নি। তাঁর সঙ্গে আমাদের পেশাদার ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভারসাম্য ছিল। সকালবেলায় সাংবাদিকদের কাছে হয়তো আমার কোনো বক্তব্য নিয়ে তিরস্কার করেছেন, আবার সন্ধ্যায় দেখা হলে সহাস্যে সামাজিক অনুষ্ঠানে সম্ভাষণ জানিয়েছেন।
তিনি এমন একটি অবস্থানে ছিলেন যেখানে তাঁর পক্ষে সর্বশেষ অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলা করে আরও বেশি কর আহরণ, সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করা, পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা আনা, ব্যাংক খাতে সংস্কার, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে আরও বেশি হয়তো কাজ করার সুযোগ ছিল। তাঁর মতো মানুষের কাছে এসব সংস্কার নিয়ে জনগণের অনেক প্রত্যাশা ছিল। এ ছাড়া স্বাধীন পেশাজীবীদের মতামতকে নীতিনির্ধারণে আরও জায়গা দিলে তিনি নিজে আরও বেশি উপকৃত হতেন। তাই মনে করি, মুহিত মহোদয়ের দীর্ঘ জীবন থেকে বাংলাদেশের নীতি প্রণেতা ও বাস্তবায়নকারীদের অনেক কিছু শেখার আছে।
মুহিত সাহেবের কর্ম ও স্মৃতির প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি