Published in সমকাল on 21 December 2020
বাংলাদেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার (২০১৫-২০২০) বাস্তবায়নকাল শেষ হয়েছে গত জুন মাসে। শিগগিরই সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২০২৫) ঘোষণা করতে যাচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশন এর খসড়া তৈরির কাজ সম্ভবত শেষ করে ফেলেছে। নতুন মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা এমন এক সময়ে হতে যাচ্ছে, যখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট অতিমারি অর্থনীতির ওপর নানাভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের নানা গবেষণা ও জরিপ বলছে, কোভিড-১৯ দেশে দারিদ্র্যের হার বাড়িয়েছে, কর্মসংস্থানকে সংকুচিত করেছে এবং মানুষের আয় কমিয়ে দিয়েছে। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রথাগতভাবে ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলো এসব নেতিবাচক প্রবণতায় বেশি আক্রান্ত হয়েছে। তবে আর্থ-সামাজিকভাবে তুলনামূলক সচ্ছল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীও এ সময় বিপন্ন বোধ করছে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অতিমারি সৃষ্ট প্রেক্ষাপট ও বিগত সময়কালের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। উল্লেখ্য, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময়কালে দেশের বেশ কিছু নজরকাড়া অর্জন রয়েছে। এ সময়ে আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। স্বল্পোন্নোত দেশের (এলডিসি) শ্রেণি থেকে বের হওয়ার শর্ত পূরণ করেছি। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তেজি হয়েছে। এক কোটি মানুষ দারিদ্র্য পরিস্থিতি থেকে বের হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অনুকূলে, যার মূল শক্তি ছিল নিম্ন মূল্যস্টম্ফীতি এবং টাকার স্থিতিশীল বিনিময় হার। গত পাঁচ বছরে সাক্ষরতার হার বেড়েছে ১০ শতাংশ, বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৪১ শতাংশ, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ১২ শতাংশ। নারীর প্রতি বৈষম্যের সূচকে এসেছে লক্ষণীয় অগ্রগতি। অতিমারিজনিত বিপর্যয়কর প্রভাবকে তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার এসব অর্জনের পাশাপাশি কিছু ব্যত্যয় ও বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়, যা আসন্ন মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন বলে মনে করি। এ প্রসঙ্গে অন্তত সাতটি অভিজ্ঞতাসঞ্জাত অনুধাবনকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন মনে করছি।
প্রথম পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময়কালে প্রাক্কলিত বিনিয়োগ ও উৎপাদন ছাড়াই অভীষ্ট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। অথচ অর্থনীতির সাধারণ সূত্র বলে- শ্রম ও পুঁজির বিনিয়োগ ব্যতীত উৎপাদন বৃদ্ধি পায় না আর উৎপাদন না হলে মোট দেশজ আয় বাড়ে না। উল্লেখ্য, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ জিডিপির ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ। পরিকল্পনার পাঁচ বছরে মোট রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে ২৩ শতাংশ কম। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ ঘাটতি ৭০ শতাংশ। রেমিট্যান্সে আয় ২৮ শতাংশ পিছিয়ে ছিল। দেখা যাচ্ছে যে, উৎপাদন সম্পর্কিত বিভিন্ন সূচক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে গেছে। প্রসঙ্গত, তাই প্রশ্ন জাগে- এটা কি বিভিন্ন সূচকের লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলনের সমস্যা নাকি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান সমস্যা। এই দ্বন্দ্বকে আগামী পরিকল্পনায় পুনরায় যেন দেখা না যায়।
দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অন্যতম দুর্বল দিক ছিল অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যর্থতা। রাজস্ব আয় যেখানে ২০২০ সালে হওয়ার কথা ছিল দেশজ আয়ের ১৬ শতাংশ, সেখানে হয়েছে মাত্র ১২.৪ শতাংশ- অর্থাৎ প্রায় এক-চতুর্থাংশ অনর্জিত। এর ফলে সরকারের নিজস্ব অর্থ ব্যয় করার ক্ষমতা কমেছে, বাজেটে ঘাটতি এবং দায়দেনা বেড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পরবর্তী পরিকল্পনায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঙ্গত মাত্রায় কীভাবে আনা হবে?
চতুর্থ পর্যবেক্ষণ হলো- সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময়কালে আমাদের দারিদ্র্য কমেছে, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্যও বেড়েছে। যদিও পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৬ সালের ‘খানা আয় ও ব্যয় জরিপ’-এর পর সম্প্রতিকালের তথ্য আমাদের নেই, তবে পরোক্ষ বিভিন্ন সূচকের মাধ্যমে প্রতিভাত হয় যে, ২০১০-১৬ সময়কালে বৈষম্য বৃদ্ধির যে ধারা পরিলক্ষিত হয়, তা ২০১৬-পরবর্তী সময়ে আরও বেগবান হয়েছে। অর্থাৎ ধনী ও দরিদ্র পরিবারের মধ্যে ভোগের বৈষম্য বেড়েছে। এর চেয়ে বেশি বেড়েছে আয় বৈষম্য এবং সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সম্পদের বৈষম্য। সবচেয়ে বেশি আয়ের ৫ শতাংশ পরিবারের সঙ্গে সবচেয়ে কম আয়ের ৫ শতাংশ পরিবারের প্রতি মাসের আয়ের অনুপাত ৩২ থেকে বেড়ে ১২১ হয়েছে। অন্যদিকে ওপরের ৫ শতাংশের সম্পদ ২০১০ সালে ছিল নিচের ৫ শতাংশের আটশ গুণ বেশি, যা ২০১৬ সালে প্রায় ১৩শ’ গুণ হয়েছে। আগেই বলেছি, গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈষম্য বৃদ্ধির এই চিত্র আরও প্রকট হয়েছে।
পঞ্চম পর্যবেক্ষণ বলছে- সপ্তম পঞ্চবার্ষিক সময়কালে যাদের আয় কিছুটা বেড়েছে তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের তুলনীয় উন্নতি হয়নি। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আগত শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির হার কমেছে। উচ্চ মাধ্যমিক সমাপ্তির ক্ষেত্রে ধনীদের তুলনায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত অথবা বিকাশমান মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে। পুষ্টিহীনতার দিক থেকেও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের তুলনীয় কোনো উন্নতি হয়নি। খর্বকায় শিশুর হার ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হারসহ স্বাস্থ্যের অনেক সূচকই ধনীদের তুলনায় মধ্যবিত্তদের অবস্থান আরও দূরবর্তী হচ্ছে।
ষষ্ঠ পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- দুর্বল সরকারি প্রতিষ্ঠান ও পরিষেবার কারণে সরকারের সঠিক নীতি ও কার্যক্রম যথার্থভাবে লক্ষ্য অর্জন করেনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার অভাব, দুর্নীতি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কারণে লক্ষ্যনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কাছে সরকারি সহায়তা যথোপযুক্তভাবে পৌঁছায়নি। স্থানীয় সরকারের দুর্বল অবস্থান এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। পরের পরিকল্পনায় এর কার্যকর সমাধান হওয়া প্রয়োজন।
সপ্তম পর্যবেক্ষণ হলো- পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক ও সামাজিক জবাবদিহিতা। তথ্যের স্বল্পতা, নীতি বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার অভাব ও অংশীজনদের সীমিত ভূমিকা-পরিকল্পনার কার্যক্রমের বাস্তবায়নকে দুর্বল করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অষ্টম পরিকল্পনা কি উদ্ভাবনী প্রস্তাব নিয়ে আসে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
নতুনভাবে চিন্তা: ওপরে উল্লিখিত অভিজ্ঞতার আলোকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উন্নয়ন কৌশলকে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। আর এ জন্য ‘প্রবৃদ্ধির ঘোর’ থেকে বের হয়ে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রাকে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার কেন্দ্রে স্থাপন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতার জায়গা ছিল কর্মসংস্থানের ঘাটতি ও বৈষম্য বৃদ্ধি। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে কার্যকর করতে বছরওয়ারি, খাতভিত্তিক ও পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠী অনুসারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈষম্য হ্রাসের প্রাক্কলনকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথাগত আয়ভিত্তিক দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক উন্নয়ন কৌশল থেকে বের হয়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং বিভিন্ন ধরনের বিপন্ন মানুষকে উন্নয়নের অভীষ্ট গোষ্ঠী হিসেবে দেখতে হবে। অর্থাৎ বিত্তহীন ও বিত্তবানদের মতো দুই প্রান্তিক গোষ্ঠীকে অতিক্রম করে বিকাশমান নিম্ন-মধ্যবিত্তদের সুরক্ষা দিতে হবে।
বাংলাদেশে প্রচলিত উন্নয়ন কৌশলে রপ্তানিমুখী উন্নয়নকে সর্বপেক্ষা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক উন্নয়ন প্রবণতা ও অতিমারির অভিজ্ঞতা বলছে, অভ্যন্তরীণ বাজারকেন্দ্রিক গ্রামীণ শিল্পায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়োজনের কথা। জাতীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা এবং টেকসই করতে কৃষিতে ফসল তোলার পরবর্তী ধাপগুলোকে শিল্পায়ন পরিকল্পনায় সামনের দিকে আনতে হবে। বর্ধিত অভ্যন্তরীণ চাহিদার সঙ্গে সংযুক্তভাবে অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনা কাঠামোকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। অর্থনৈতিক কাঠামোর বিচিত্রায়ণকে সমর্থন দিতে বাড়াতে হবে শ্রমের উৎপাদনশীলতা। অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হতে হবে অভ্যন্তরীণ ও বেসরকারি ভোগ এবং বিনিয়োগ।
সার কথা হচ্ছে, অষ্টম পঞ্চমবার্ষিক পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈষম্য নিরসন এবং বিকাশমান মধ্যবিত্তকে সুরক্ষা দেওয়ার সুনির্দিষ্ট নীতি থাকতে হবে। প্রবীণ, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী, চর-হাওর অঞ্চলের অধিবাসী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, দলিত শ্রেণি ও আদিবাসীসহ আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা নানা জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। তাদের জন্য প্রণীত সরকারি নীতি এবং প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা বাড়াতে হবে। আরও বিভাজিত এবং হালনাগাদ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে উন্নয়ন মূল্যায়নে স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি আগামী মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মেয়াদকালে সামাজিক জবাবদিহিতাকে জোরদার করতে হবে। এর মাঝেই নিহিত বিগত সাফল্যকে ধরে রাখা এবং নতুন অর্জনকে দৃশ্যমান করা।
অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো