Originally posted in NewsBangla24 on 19 February 2021
সংক্রমণের শুরুর দিকে ঝুঁকি নিয়ে অর্থনীতি খুলে দেয় সরকার। এর সুফলও মিলেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি এবং সেবা খাতে কাজের সুযোগ তৈরি হয়। ফলে কম সময়ে ঘুরে দাঁড়ায় অর্থনীতি। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো আর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এক নয়।
করোনার কারণে অর্থনীতিতে তৈরি হওয়া ক্ষত কাটাতে আরও এক বছর লাগবে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি মনে করেন, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও এখনও পুনরুদ্ধার হয়নি। পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া দ্রুত করতে হলে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প-এমএমই, গ্রামীণ অর্থনীতিসহ ‘লক্ষ্যভিত্তিক প্রণোদনা, অভ্যন্তরীণ ভোগ ব্যয় এবং রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিই আগামীতে অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জ হবে।
সরকারি ব্যয় ও ভোট বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে এই অর্থনীতিদিব বলেন, যত বেশি ব্যয় হবে, তত বেশি ভোগ সৃষ্টি হবে। চাঙ্গা হবে অর্থনীতি।
অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি, আগামী বাজেট ভাবনাসহ নানা বিষয় নিয়ে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ।
করোনা পরবর্তী অর্থনীতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী ?
করোনার প্রথম দিকে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। কঠিন সময় পার হয়ে ধীর ধীরে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে সম্প্রতি গতি আগের চেয়ে শ্লথ হয়েছে।
এই বার্তা আমাদের মতো দেশে খুবই গুরুত্ব বহন করে। কারণ, অনেকেই এখনও কর্মহীন। তাদের পক্ষে টিকে থাকাইটাই কঠিন। অর্থনীতি গতিশীল থাকলে মানুষের আয় রোজগারের সুযোগ তৈরি হয়।
সংক্রমণের শুরুর দিকে ঝুঁকি নিয়ে অর্থনীতি খুলে দেয় সরকার। এর সুফলও মিলেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি এবং সেবা খাতে কাজের সুযোগ তৈরি হয়। ফলে কম সময়ে ঘুরে দাঁড়ায় অর্থনীতি। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো আর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এক নয়।
ঘুরে দাঁড়ানোর চালেঞ্জ কাটিয়ে উঠা গেছে। এখন পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তবে এটা ঠিক, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রয়েছে।
করোনা মহামারির মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এ অর্জনকে কীভাবে দেখছেন ?
দুই শতাংশ নগদ প্রণোদনা ও বিশ্বব্যাপী হুন্ডি বন্ধের ফলে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার অন্যতম কারণ রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবাহ।
প্রবাসীরা বেশি টাকা পাঠানোর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ স্ফীত হয়েছে। এটি চার হাজার ৩০০ কোটি ডলার (৪৩ বিলিয়ন) ছাড়িয়ে গেছে। আবার আমদানি কম হওয়ায় রির্জাভ বেড়েছে।
এর একটি ইতিবাচক দিক আছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়কালে বেশি রিজার্ভ থাকার কারণে সহজেই অর্থ পাওয়া গেছে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে। কারণ, তারা মনে করে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে বাংলাদেশের।
চলতি অর্থবছরে আট মাস চলছে। সামনে অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী ?
এ মুহূর্তে অর্থনীতির দুটি চ্যালেঞ্জ। একটি হলো ভোগ ব্যয় চাঙ্গা করা। অন্যটি রাজস্ব আদায় বাড়ানো।
মানুষ কাজ হারিয়েছে, কাজ কম পাচ্ছে, কম আয় করছে। ফলে যে মাত্রায় গতিশীল হওয়ার দারকার অর্থনীতি, সেটি হচ্ছে না।
অভ্যন্তরীণ ভোগ ব্যয় না বাড়লে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসবে না। এ জন্য বেসরকারি বিনিয়োগের দিকে না থাকিয়ে কর্মসৃজনমূলক প্রকল্প নিতে হবে সরকারকে।
দ্ধিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা। আমদানি–রপ্তানি কামার কারণে রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কম রাজস্ব আহরণ সরকারের জন্য বড় দুর্ভাবনা।
ব্যয় কমার কারণ কী ?
সম্পদের সীমাবদ্ধতা তেমন নেই। কারণ, রাজস্ব আহরণ কম হলেও ব্যাংক এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি থকে প্রচুর ঋণ নিচ্ছে সরকার। বিদেশি ঋণও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। ফলে সরকারের সম্পদের ঘাটতি আছে,- এমনটি বলার সুযোগ নেই।
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। যেসব প্রকল্পে কাজের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে, সেগুলো প্রাধিকার দিয়ে যথাসময়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।
কিন্তু এখানে বড় দুর্বলতা আছে। দেখা যায়, অনেক বড় প্রকল্পে বেশি বরাদ্দ দেয়া হলেও তা ঠিকমতো খরচ করতে পারে না। টাকা ফেরত যাচ্ছে। অর্থবছরের শুরুতে ব্যয়ের দিকে বেশি নজর দিলে এ অবস্থা হতো না।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ কি যথেষ্ট বলে আপনি মনে করেন ?
প্রণোদনা ঘোষণার ফলে স্বস্তি দেখা দেয় অর্থনীতিতে। কিন্তু দুর্বল দিক হচ্ছে পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়ন না হওয়া। বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য দেয়া ঋণের শতভাগ ব্যয় হলেও পিছিয়ে ক্ষুদ্র,অতিক্ষুদ্র,মাঝারি ও কৃষিখাত। অথচ এসব খাতই অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি।
পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া দ্রুত করতে হলে লক্ষ্যভিত্তিক প্রণোদনা সুবিধা দিতে হবে। ক্ষুদ্র,অতিক্ষুদ্রসহ এসএমই, সেবা ,অ-প্রাতিষ্ঠানিক, গ্রামীণ অর্থনীতিকে এ সুবিধা দিতে হবে।
ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে ক্ষুদ্রঋণ দানকারি সংস্থার, এনিজও এবং স্থানীয় পর্যায়ে সমিতির মাধ্যমে ঋণসহায়তা দিতে হবে। ঋণসুবিধার পাশাপাশি কর সুবিধা দেয়া যেতে পারে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে কোন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া উচিত?
কর্মসংস্থানের জন্য রপ্তানিমুখী খাতের অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে। এর বাইরে কৃষিভিত্তিক, এসএমই, পরিবহন, পর্যটন খাতে বেশি সুবিধা দিতে হবে। সহজ শর্ত ও কম সুদে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি এসব খাতের কর সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারি খাতে আরও বিনিযোগ বাড়াতে হবে ব্যাপক কর্মসংস্থানের জন্য। এখন থেকে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় থেকে বলে দিতে হবে, তারা যাতে এমন প্রকল্প প্রস্তাব রাখে যেখানে বেশি কাজের সুযোগ তৈরি হয়।
চলতি অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদন -জিডিপি কত হতে পারে বলে আপনি মনে করেন ?
বিগত অর্থবছরের উপর ভিত্তি করে চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রাক্কলণ করা হয় ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এটি অর্জন সম্ভব নয়।
পূর্ণাঙ্গ তথ্য উপাত্ত নেই। ফলে এ বছর জিডিপি কত হবে তা হিসাব করা কঠিন।
গত অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত অর্থনীতি স্বাভাবিক ছিল। এর পর থেকে কয়েক মাস স্থবির হয়ে পড়ে অর্থনীতি। ফলে প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ হয়।
সেই অবস্থান থেকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখনও আগের চেহারায় ফিরে যেতে পারেনি। আশা করা যাচ্ছে, গত অর্থবছরের মতো বা তার কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি হতে পারে এবছর।
অর্থনীতি আগের চেহারায় ফিরে পেতে আর কত সময় অপেক্ষা করতে হবে ?
বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এটি বড় সাফল্য আমাদের জন্য। মানুষ পুরো আয় করতে না পারলেও রোজগার বন্ধ হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজের সুযোগ সীমিত এখনও। যারা চাকরি হারিয়েছে কাজ পায়নি তারা।
যারা এখনও বেকার বা অর্ধ বেকার বা পূর্ণ আয় করতে পারছেন না, এদের স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরে যেতে সময় লাগবে।
কিন্তু আশার দিক হলো, স্বল্প আয় ও খেটেখাওয়া মানুষ আয়- রোজগার করছে। এদের সংখ্যাই বেশি। অর্থনীতি পুরোপুরি সচল হতে ২০২১ সাল লাগবে।
এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে আন্তর্জাতিক বাজারে নানা সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?
২০১৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক শুল্ক দিয়ে ওই দেশের বাজারে প্রবেশ করছে। এ সুবিধা না থাকায় পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি খুবে বেশি না হলেও খারাপ করছে না বাংলাদেশ।
শুল্কসুবিধা না থাকলে আমরা পারব না, এ ধারণা ঠিক না। দেশের উদ্যোক্তরা এখন যথেষ্ঠ সামর্থ্য অর্জন করেছেন। খরচ কীভাবে কমানো যায় সেই দিকে নজর দিচ্ছেন তারা। উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরি করছে, যাতে আরও বেশি মুনাফা করা যায়।
শুল্ক সুবিধা উঠে গেলে অবশ্যই বাংলাদেশের উপর চাপ বাড়বে। কিন্তু কিন্তু এটি না হলে যে সক্ষমতা হারিয়ে যাবে তা ভাবার কারণ নেই। অতীতে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশ।
এ জন্য উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে।
এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতার বড় একটা হাতিয়ার হতে পারে এফডিআই। এ সুযোগটি যেন কোনোভাবেই অবহেলা না করা হয়।
এলডিসি থেকে উত্তরণে দুই বছর সময় চেয়েছে বাংলাদেশ। প্রস্ততি পর্বে এ সময় কি পর্যাপ্ত ?
স্বাভাবিক সময়ে ২০২৪ সালের মধ্যে এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বাংলাদেশ। করোনার কারণে অর্থনীতি দুর্বল হওয়ায় তা থেকে পিছিয়েছে। এ জন্য সরকার দুই বছর সময় চেয়েছে এবং বাড়তি সময় চাওয়াটা যুক্তিসঙ্গত।
আরও সময় নিলে ভালো হতো। তবে সরকার মনে করছে, কাজটি দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারবে এবং অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। সেই বিবেচনায় দুই বছর সময় যুক্তিসঙ্গত।