Originally posted in কালের কন্ঠ on 19 August 2024
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার মান এবং অন্যান্য ব্যাপার জড়িত। নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভক্ষয় বড় সমস্যা। বাজেটে প্রবৃদ্ধি ৬.৭ শতাংশ রাখা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে ধরে রাখার কথা বলা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। নতুন সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এসব নিয়ে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে কথা বলেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব।
কালের কণ্ঠ: দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। ক্রান্তিকালে নতুন সরকারের সামনে তো অনেক চ্যালেঞ্জ। কিভাবে দেখছেন?
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই অর্থনীতি বিভিন্ন রকমের ঝুঁকির মধ্যে ছিল। বিগত দু-তিন মাস সময়ের ভেতর যে ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা গেছে, সে সময়ে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে, মানুষ মারা গেছে, সম্পদের হানি হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের সমস্যা হয়েছে।
ফলে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় রকমের ব্যত্যয় হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে ব্যাবসায়িক আত্মবিশ্বাস, সেটিও অনেকাংশে কমে গেছে। আমরা দেখেছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই সারা দেশ নিরাপত্তার ঝুঁকিতে ছিল। ফলে সরকারের সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা, যাতে ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিকভাবে তাঁদের কাজকর্ম চালাতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারে দেশে এবং দেশের বাইরে আস্থা তৈরি করা, যেন রপ্তানিমুখী খাতে বিদেশিরা অর্ডার দেয়। তারা যেন অর্ডার দিতে স্বস্তি বোধ করে, প্রবাসীরা যেন সরকারের স্বাভাবিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে স্বস্তি বোধ করেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেন দুশ্চিন্তা থেকে ফিরে এসে এ দেশে বিনিয়োগ করেন; সে পরিবেশ নিশ্চিত করা।
মধ্যবর্তী চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সাম্প্রতিককালে সরকারের রাজস্ব আদায়ের গতি বেশ শ্লথ।
সব সময় আমরা দেখি, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে একটি উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়, কিন্তু বছর শেষে সেটি আদায় করা যায় না। এখন সেই চ্যালেঞ্জটি আরো বেশি। সুতরাং সীমিত রাজস্ব দিয়ে কতটুকু বাজেট বাস্তবায়ন করা যাবে, সেটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ সরকারের জন্য। আমার মনে হয়, সরকারের এটিও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার হবে, সরকার বাজেট রিভিশন করবে কি না। রাজস্ব, বৈদেশিক ঋণপ্রাপ্তি, বৈদেশিক মুদ্রাপ্রাপ্তি, রিজার্ভের যে পরিস্থিতি এবং আন্দোলনে ক্ষয়ক্ষতির ফলে সরকারের হাতে নতুন যে বাড়তি ব্যয় দাঁড়াবে, সেই বাড়তি ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ আবার আমদানি করতে হবে—সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করতে হবে। এই বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করাও এখন বড় একটি চাপ।
তৃতীয়ত, মধ্য-দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্র সংস্কার। সংস্কারের বিষয়গুলো বেশ বড়। এগুলো ধীরগতির হয়। আমি মনে করি না যে এ ধরনের সংস্কারে হাত দেওয়ার মতো অবস্থা সরকারের রয়েছে। সরকার যদি সত্যি দীর্ঘ মেয়াদে একটি কাঠামোগত সংস্কার করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুণগত পরিবর্তন আনতে চায়, যাতে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিযোগিতামূলক একটি বাজারব্যবস্থা হয়। ফলে সবাই সেখান থেকে সুবিধা নিতে পারে, গুটিকয়েক গোষ্ঠী যেন বাজারের দখল নিতে না পারে—এমনটি করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এমনটি করতে হলে ব্যাংকিং, পুঁজিবাজার, পাবলিক সেক্টর, রাজস্ব, পাবলিক প্রকিউরমেন্টের মতো অনেক খাতে সংস্কারের প্রয়োজন পড়বে। সেটি নির্ভর করবে সরকার প্রাধিকারগুলো কিভাবে সাজাচ্ছে। সরকার তার সময়কাল কিভাবে নির্ধারণ করছে। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো সরকার দেশ ও দেশের বাইরে থেকে কতটুকু সমর্থন পাচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো কী পরিমাণ সময় দেবে এই সরকারকে। স্থিতিশীলভাবে কাজ করার জন্য এ ব্যাপারগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
কালের কণ্ঠ: বাজেট দেওয়া হয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিও ঘোষণা করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি একটি বড় সমস্যা। রিজার্ভক্ষয় বড় সমস্যা। জ্বালানি সমস্যা তো আছেই। ব্যাংকিং খাতে সমস্যা আছে। রেমিট্যান্সে নিম্নগতি। এসব সমস্যার সমাধান কি খুব দ্রুত করা সম্ভব?
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: এই সমস্যাগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার আগে থেকেই ছিল। তবে এই সরকার আসার ঠিক আগে আরো কিছু নতুন সমস্যা যোগ হয়েছে। যেমন—আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। নতুন সরকারের ওপর মানুষের আস্থা ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকারকে সামাজিক ও রাজনৈতিক কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এরপর অর্থনীতির বিষয়গুলোর মোকাবেলা করতে হবে। বর্তমানে দ্রুততার সঙ্গে মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক একটি আশু মূল্যায়ন দরকার। আন্দোলনের ফলে কোন মন্ত্রণালয়ের কেমন ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতিপূরণে কত টাকা প্রয়োজন, উপজেলা থেকে শুরু করে ঢাকা পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করা, যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের পরিবারের জন্য সামাজিক সহযোগিতায় কত টাকা প্রয়োজন—এসব ব্যয়ের একটি হিসাব দ্রুত দরকার। এগুলোর জন্য বাজেটকে আবার পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে এডিপির ক্ষেত্রে যে প্রাধিকার রয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও সরকার নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। কিছু প্রকল্প শ্লথগতিতে আনা, কিছু প্রকল্প এখন না আনা।
আমার মনে হয়, প্রাক্কলিত হিসাবের ভিত্তিতে সরকার আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কাছে বাজেট সাপোর্ট চাইতে পারে। বিশেষ করে আইএমএফের সঙ্গে সরকারের এই মুহূর্তে একটি ঋণ সহযোগিতা চলছে, সেটির আলোকে সরকার জরুরি বাজেট সাপোর্ট চাইতে পারে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য। কেননা নতুন ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার সংশ্লেষ রয়েছে।
মুদ্রানীতি ঘোষিত হয়েছে। সরকারের এখন ভাবার বিষয় বাজেট পুনর্বিবেচনা করবে কি না। নতুন করে রিভাইস বাজেট এখন ঘোষণা করতে চায় কি না। যদি তা চায়, তাহলে এর সঙ্গে অনুবর্তী হয়ে মুদ্রানীতিও নতুন করে ঘোষণার বিষয়টি আসতে পারে। একইভাবে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাজারে পণ্য সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা। কারণ সাপ্লাই চেইনগুলো অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে আমদানিও যেন বাধাগ্রস্ত না হয়—এটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই সময়ে যদি কিছুটা উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকেও সেটির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা। যথেষ্ট মাত্রায় বাজারে পণ্য পাওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বাজারে নানা রকম সিন্ডিকেট কাজ করে। সেসব চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। সাপ্লাই চেইনগুলো পুনর্বিন্যাস করে ডিজিটাল সাপ্লাই সিস্টেম করা প্রয়োজন। রেজিস্টার্ড এজেন্ট ছাড়া অন্য কারো পণ্য বেচা নিষিদ্ধ করা দরকার। তাদের লেনদেন ডিজিটাইজড করা, ট্রানজেকশনগুলো ডকুমেন্টেড হওয়া দরকার। এগুলো এখনই করার কাজ নয়, করতে সময় লাগবে। কিন্তু শুরু করার দরকার আছে।
এখন আমাদের রিজার্ভ খুব কম। রেমিট্যান্সও শ্লথ। অনেক প্রবাসী হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর কারণে সেটি ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে না। বাজার অস্থিতিশীল হলে কিছু মানুষ বাজার থেকে ডলার কিনে জমিয়ে রাখে। তারা বাজার থেকে স্বল্প সময়ে একটি মুনাফা করতে চায়। আবার কেউ আছে, সোনা কিনে রাখে। ফলে রিজার্ভের স্বাভাবিক যে ফ্লো, সেখানে সংকট তৈরি করে। এগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো কত দ্রুত আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছি, যেন ব্যবসার ওপর আস্থা আসে। মার্কেট মনিটরিং হয়। মুদ্রা পাচার না হওয়া যেন নিশ্চিত হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা যত দ্রুত যেতে পারব, তত রিজার্ভক্ষয় আমরা রুখে দিতে পারব। আমাদের রিজার্ভ বর্তমানে খুব ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। সরকারের উচিত হবে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সঙ্গে দেনদরবার করা, যাতে সরকার জরুরি ভিত্তিতে বড় আকারের বাজেট সাপোর্ট নিয়ে আসতে পারে। কিংবা প্রকল্পভিত্তিক ঋণ সহায়তা দ্রুত নিয়ে আসা দরকার, যাতে রিজার্ভ বৃদ্ধি পায়, যেন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল হয়। সবাই যেন টাকা জমিয়ে না রেখে বাজারব্যবস্থায় ফিরে আসে।
ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো সবার জানা। সমস্যার মূল কারণটি দাঁড়িয়ে গেছে যে ব্যাংকিং খাত এখন আর সর্বজনের প্রতিষ্ঠান না হয়ে কিছু ব্যক্তির কুক্ষিগত হয়ে গেছে। সবার টাকা লেনদেনের জায়গা না হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ দেখার ব্যাপার হয়ে গেছে। ফলে ব্যাংকিং খাত বড় রকমের ভঙ্গুরতার ভেতরে রয়েছে। এই সমস্যার সমাধানটা সময়সাপেক্ষ। আমরা মনে করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যর্থতা রয়েছে। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং অপারেশনের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং দক্ষতা দেখতে চাচ্ছি। এই তিনটি একই সঙ্গে করা দরকার।
আমার ধারণা, রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে যে নিম্নগতি, সেটি সাময়িক। আস্থা ফিরে এলে সবাই ব্যাংকিং চ্যানেল দিয়েই হয়তো অর্থ প্রেরণে উৎসাহী হবে। তবে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো টাকার মূল্যায়ন স্থিতিশীল রাখা এবং অবমূল্যায়ন ঠেকানো।
কালের কণ্ঠ: বাজেটে প্রবৃদ্ধি ৬.৭ শতাংশ রাখা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে ধরে রাখার কথা বলা হয়েছে। এটি কি সম্ভব হবে? মূল্যস্ফীতি কমার কোনো সুযোগ কি আপাতত আছে?
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: বাজেট ঘোষণার পরপরই মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমাদের মূল্যায়ন ছিল। সেখানে আমরা বলেছি মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা (ওই সময় মনে হয়ে প্রায় ৮.৫ শতাংশের মতো ছিল) কষ্টকর। আমরা বলেছিলাম, মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। কারণ বাজেটে এমন কিছু উদ্যোগ ঘোষণা হয়েছিল, যেটি খাদ্যবহির্ভূত মূল্য বাড়িয়ে দেবে—এটি আমরা আশঙ্কা করেছিলাম। এর ভেতরে ছিল সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়াবে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে খাদ্যেও এর প্রভাব পড়বে। এর মধ্যে গত দুই মাসে যে ধরনের পরিস্থিতি গেল সেটি বাজারব্যবস্থার জন্য মোটেই অনুকূল ছিল না। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাজারে মূল্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। সব কিছু মিলে আমাদের কাছে মনে হয় না যে মূল্যস্ফীতি রোধের যে টার্গেট, এটি এখন বাস্তবায়নযোগ্য। একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধির যে টার্গেট, সেটিও আর এখন বাস্তবায়নযোগ্য নেই বলে মনে হয়। এ জন্য সামষ্টিক অর্থনীতির দ্রুত পুনর্মূল্যায়ন দরকার।
কালের কণ্ঠ: দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে আপনি কোন কোন দিকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার বলে মনে করেন?
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: বিগত সময়ে আমরা যে ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেখে এসেছি, তাতে এক ধরনের গোষ্ঠীতান্ত্রিক বাজার কাঠামো তৈরি হয়েছে। ফলে সাধারণ উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এর মধ্যে এসএমই খাত রয়েছে, মাইক্রো এন্টারপ্রেনার রয়েছে। নতুনভাবে ইমার্জিং ই-কমার্স, এফ-কমার্সে যারা জড়িত, তারা রয়েছে। এই উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণের জায়গাগুলো সেভাবে বিকশিত হয়নি। ছাত্র-জনতার যে আন্দোলন হয়েছে, এটিও এক ধরনের বঞ্চনার জায়গা থেকে হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এমন একটি কাঠামোতে যেতে হবে, যেন সবার অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়। সে জন্য বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। পাবলিক কন্ট্রাক্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তি এবং প্রতিযোগিতার বিষয়টি দেখতে হবে। ঘুষ, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে পাবলিক কন্ট্রাক্ট দেওয়া যাবে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক ধরনের মনোপলি বা অলিগোপলিস্টিক যে স্ট্রাকচার হয়ে যাচ্ছে, এতে ক্রমেই সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ যেমন সীমিত হয় ব্যবসায়—আরেকটি হচ্ছে এটি কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে তার যে সুবিধা পাওয়ার কথা, সেটি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। জীবনযাত্রার মান তখন অবনমন হয়। আমরা বাজারে সবার অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারিনি বলে এটি হয়েছে। এটি করতে হলে কিছু আইনগত পরিবর্তন আনতে হবে। এমন কিছু সংস্কার দরকার, যাতে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা থাকবে যে এর চেয়ে বেশি কেউ বিনিয়োগ করতে পারবে না। তখন অন্যরাও বিনিয়োগের সুযোগ পাবে। একইভাবে ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলও এককভাবে কেউ করতে পারবে না। কেউ যেন এককভাবে গোষ্ঠীতন্ত্র কায়েম করতে না পারে, সেটি মনিটর করতে হবে। তাহলে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ হবে, বাজার প্রতিযোগিতামূলক হবে, কাজের সুযোগ তৈরি হবে, ভোক্তা হিসেবেও মানুষ উপযুক্ত পণ্য উপযুক্ত মূল্যে পাবে এবং সেটি সবার জন্য স্বস্তিদায়ক হবে।
কালের কণ্ঠ: আমাদের প্রধান সমস্যা মূল্যস্ফীতি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি তো ১০ শতাংশের বেশি। এটি প্রায় ছয়-সাত মাস ধরেই চলছে। সাধারণ মানুষ, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টে আছে। এটি নিয়ন্ত্রণে আনতে এই সময়ের করণীয় কী?
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আগেই বলেছি, এই মুহূর্তে পণ্য সরবরাহটা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ও গরিব মানুষের জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যেন অব্যাহত থাকে। আগের সরকার করেছে বলেই সেগুলো খারাপ, সেভাবে না দেখে আগের সরকারের কল্যাণকর কাজগুলো অব্যাহত রাখা দরকার। বিশেষত খাদ্য বিরতণ কর্মসূচি, ট্রাক সেল, টিসিবির মাধ্যমে যে সেল, সেগুলো ইতিবাচক। তবে ফ্যামিলি কার্ড যেটি বিতরণ করার কথা, সেগুলো উপযুক্তভাবে বিতরণ হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাবান্বিত ব্যক্তি, গোষ্ঠীর কাছে বিতরণ হয়েছে। ফ্যামিলি কার্ডের ব্যাপারে সরকারের উচিত হবে নতুন করে পুনর্বিবেচনা করা। সঠিক ব্যক্তির কাছে কার্ডটি বিতরণ করা।
কালের কণ্ঠ: আমাদের সরকারি ঋণ দিন দিন বাড়ছে। বিদেশি ঋণ মোট জিডিপির ১৬ শতাংশ, দেশি ঋণ প্রায় ২১ শতাংশ। আমাদের বিদেশি ঋণ পরিশোধের গড় মেয়াদ হলো ১০-১১ বছর বা একটু বেশি। এখন এর মধ্যে কয়েকটি বিদেশি ঋণ ম্যাচিউর হয়ে গেছে। এটিও তো একটি বড় সমস্যা। আপনি কিভাবে দেখছেন?
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: বিদেশি ঋণ আমাদের জন্য নেতিবাচক—এটি ভাবার প্রয়োজন নেই। একটি উদীয়মান অর্থনীতিতে সব সময় সম্পদের চাহিদা থাকে এবং সেখানে বিনিয়োগের চাহিদা থাকে। প্রশ্ন হলো, আপনি সেই ঋণ নিয়ে কোন ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগ করছেন? সেই প্রকল্পগুলো থেকে আপনি সময়মতো রিটার্ন পাচ্ছেন কি না? দুর্ভাগ্যবশত এই জায়গায় আমরা বড় চ্যালেঞ্জ দেখেছি। অবকাঠামো খাতের অনেক প্রকল্প ইতিবাচক ফল দিলেও প্রকল্পের সময়কাল দীর্ঘায়িত হয়েছে। এতে এর ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে, রিটার্ন সময়মতো আসেনি। এই যে বিপুল বিনিয়োগ সেখানে করা হলো, এটি পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে বা হবে। সুতরাং ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ঋণের যৌক্তিকতা দেখা, কতটা উপযুক্ত সেটি দেখা, ঋণের শর্তগুলো দেখা এবং সে অনুযায়ী ঋণ করে কার্যক্রম নিতে হয়। বিগত দশকে আমাদের এমন কিছু ঋণ হয়েছে, যার সব কটিই যে ইতিবাচক হয়েছে, তা বলব না।
কালের কণ্ঠ: আর্থিক খাতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা আছে। বাজেটে ঘাটতি আছে। ঘাটতি পূরণে সরকারকে ঋণ নিতে হয়। এই সমস্যার সমাধান কিভাবে দেখছেন?
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আর্থিক খাত খুবই সুবিন্যস্ত একটি খাত। আন্তর্জাতিকভাবে যদি আমি বিবেচনা করি, যেখানে উন্নত দেশগুলো তাদের নীতি সুদ হার দিয়েও বাজারে মানি ফ্লো কমিয়ে দিতে পারে, বাজারের ব্যাপারে শক্ত বার্তা দিতে পারে যে আগামী দিনে কী আসতে যাচ্ছে, সে রকম আর্থিক খাতের ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়ে দেওয়া কিন্তু সম্ভব। দুর্ভাগ্য হলো বাংলাদেশে আর্থিক খাত এমনভাবে পরিচালিত হয়, আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট ইনস্ট্রুমেন্টগুলো আমরা কখনোই কার্যকর দেখি না। যেমন বলা হয়ে থাকে, মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস করা হবে, সরকার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়েছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মানে হচ্ছে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে যখন কমিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যটি নেওয়া হয়, সেটি প্রাইভেট সেক্টর কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। বেসরকারি খাতের ঋণকে টেনে ধরা হয়। সরকারের উচিত হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তার চাহিদাটা কমিয়ে রাখা। কিন্তু সরকার প্রায়ই সেটি করে না। তখন বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে দেওয়াটা ইতিবাচক থাকে না। বরং বাজারে মুদ্রাস্ফীতির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক কাজ না করতে পারার কারণে এই সমস্যা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর যেভাবে তার ঋণ সরবরাহ করা দরকার, তার যে ডিউটিলিজেন্সগুলো মানা দরকার অথবা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে যেভাবে তার ঋণ দেওয়া দরকার—২০১৯ সাল থেকে ব্যাসেল-৩ একটি মানদণ্ড মানার কথা, সেটির কাছাকাছি আমরা নেই। ব্যাংকগুলোর লোন ইকুইটির রেশিও ব্যালান্স করে ঋণ দেওয়ার কথা, সেটিও সে মানছে না। যাকে ঋণ দিচ্ছে, তার যে কমার্শিয়াল ডাটা দেখা দরকার, সেটিও দেখছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এগুলো মনিটর করছে না। নিয়ন্ত্রণ করছে না। খেলাপি ঋণ এখন সম্ভবত এক লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা। সরকারের যে লোনগুলো অবলোপন করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো, যে লোনগুলো বিভিন্ন কারণে আটকে আছে, এগুলো যদি সব বিবেচনায় নিই, তাহলে কিন্তু অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকার ওপরে। উপরন্তু ব্যাংক কম্পানি আইন যখন হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামত হয়তো বিবেচনা করা হচ্ছে না। সেখানেও রাজনৈতিক প্রভাবান্বিত ব্যাংকের পরিচালকের সংখ্যা, তার মেয়াদকাল পারিবারিকভাবে থাকার সময়কাল বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যেগুলো কম্প্যারেটিভ স্ট্রাকচারের পরিপন্থী; যেটি হওয়ার কথা নয়। ব্যাংকিং খাতের চেয়েও বেশি দুর্বল নীতি পুঁজিবাজারে। পুঁজিবাজারের করুণ দশা। একই রকম অবস্থা বীমা খাতে।
কালের কণ্ঠ: আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আপনাকেও ধন্যবাদ।
অনুলিখন : রায়হান রাশেদ