Originally posted in Prothom-Alo on 11 August 2023
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
শ্রীলঙ্কাও পারল, বাংলাদেশ কেন পারছে না
এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এই প্রবণতা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও দেখা যাচ্ছে। পার্থক্য হলো, অনেক দেশই গত এক বছরে মূল্যস্ফীতির হার কমাতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত দেশও মূল্যস্ফীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। অথচ বাংলাদেশ পারছে না, বরং এখানে মূল্যস্ফীতি উল্টো বাড়ছে।
গত বছরের আগস্ট মাস থেকে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ শুরু হয়। এই সময়ে কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে নামেনি। এখন তো ১০ শতাংশের কাছাকাছি। সরকারি হিসাবেই তা এতটা হলে বাস্তব পরিস্থিতি যে আরও নাজুক, তা বলাই বাহুল্য। মূল্যস্ফীতির কারণে, বিশেষ করে দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষের অবস্থা সঙিন হয়ে পড়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের সব দেশেই মূল্যস্ফীতি কমবেশি বেড়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ভারতের মতো দেশগুলো মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিয়ে ফেলেছে। গত ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে, যুক্তরাজ্যে ১০ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৭ শতাংশে, জার্মানিতে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে, ভারতে সাড়ে ৬ থেকে সোয়া ৪ শতাংশে নেমে এসেছে মূল্যস্ফীতি। এমনকি অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কাও মূল্যস্ফীতি সামাল দিয়েছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে যেখানে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ, সেখানে এ বছরের জুলাইয়ে তা কমে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এই পরিসংখ্যানে অবশ্য ভিত্তিবছর পরিবর্তনের প্রভাব আছে।
মূল কথা হলো, যেসব দেশে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা গেছে, সেসব দেশের সরকারগুলো নীতিগতভাবেই তা করেছে। বাংলাদেশে সেই প্রচেষ্টা কিছু করা হলেও তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।
মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার বৃদ্ধি। এটা বৈশ্বিক প্রবণতা। বাংলাদেশ ব্যাংকও গত এক বছরে বেশ কয়েকবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে, কিন্তু দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া বাণিজ্যিক ঋণের সুদহার বাড়ায়নি। ফলে নীতি সুদহার বাড়িয়ে বাজারে অর্থের প্রবাহ কমানো সম্ভব হয়নি। এ ধরনের দ্বিমুখী নীতির কারণে নীতি সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।
এ ছাড়া বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে মুদ্রা বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছিল। যে কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যখন ডলারের বিনিময় হার অনেকটা বৃদ্ধি পায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। এটি মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ। যদিও এখন বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কেবল বৈশ্বিক কারণে হচ্ছে না, নিজস্ব বাজার ব্যবস্থাপনাও এর জন্য দায়ী।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল বিষয় হলো চাহিদা ও সরবরাহ। কিন্তু দেশে কত চাহিদা আছে আর কত সরবরাহ হচ্ছে, সেই হিসাব নেই। অনেক সময় কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মেলে না। বাজারে কখন ঘাটতি হতে পারে, সেই বার্তা আগেভাগেই আমদানিকারকদের দিতে হবে। সেই সঙ্গে এসব আমদানির জন্য দ্রুত এলসি খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। ভারতে কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণে স্থায়ী কমিশন আছে, যারা সব সময় বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কৃষক ও ভোক্তা—উভয়ের স্বার্থই রক্ষা করে। কিন্তু আমাদের সে রকম কিছু নেই।’
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যথেষ্ট পরিমাণে সময়মতো আমদানি করে, তাহলে বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় থাকবে। সে জন্য তাদের আরও বেশি পণ্য আমদানি করা উচিত বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান।
২০২২ সালের শুরুতে শ্রীলঙ্কায় আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি চলছিল। তা মোকাবিলায় দেশটি নীতি সুদহার ৯৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে রাজস্ব নীতিতেও পরিবর্তন আনে, যেমন করহার বৃদ্ধি ও ব্যয় হ্রাস। আমদানি নিরুৎসাহিত ও রপ্তানি চাঙা করতে ২০২২ সালের মার্চের পর শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশটির মুদ্রা রুপির দর ৮০ শতাংশ কমিয়েছে। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা সরকার মূল্যস্ফীতির দীর্ঘমেয়াদি কারণ, যেমন ঋণের চাপ, রপ্তানির দুর্বলতা, আমদানিনির্ভরতা—এসব কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নিয়েছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা আছে। মূল বিষয়য় হলো, চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হলে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই কৃত্রিমভাবে ভারসাম্যহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। সমস্যা হলো, এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, অর্থনৈতিকভাবে অনেক নাজুক অবস্থায় থাকলেও শ্রীলঙ্কার বাজার ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের চেয়ে শক্তিশালী। সে কারণে তারা মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে। অন্যান্য যেসব দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে, তাদের বাজার ব্যবস্থাপনাও শক্তিশালী। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতি হ্রাসে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। জানা গেছে, গত ৬ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় মূল্যস্ফীতি কমানোর উপায় খোঁজার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, অর্থনীতিতে এখন দুটি প্রধান উদ্বেগ আছে; একটি বিদ্যুতের সমস্যা, অপরটি মূল্যস্ফীতি।
অথচ ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং বিভিন্ন উন্নত দেশ শুরু থেকেই মূল্যস্ফীতি হ্রাসে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছে। মুদ্রানীতিকে তারা যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে নীতি সুদহার বৃদ্ধির ধারা শুরু হয়েছে বেশ পরে। প্রথমত, নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফল পেতে বেশ সময় লেগে যায়; দ্বিতীয়ত, নীতি সুদহার বাড়ানো হলেও ব্যাংকঋণের সুদহার বেঁধে রাখার কারণে তার প্রভাব এখনো চোখে পড়ছে না।
উন্নত দেশগুলো মানুষকে জ্বালানির উচ্চ মূল্য থেকে রেহাই দিতে বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দিয়েছে। এর আগে কোভিডের সময়ও নাগরিকদের নগদ অর্থ প্রণোদনা প্রদান করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পারিবারিক কার্ডের মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে নির্দিষ্ট কিছু খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা বা খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে খাদ্য বিক্রি ছাড়া বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি) মানুষকে স্বস্তি দিতে তেমন কিছু করেনি। আসলে রাজস্ব আয় কম হলেও সরকারের পক্ষে বেশি কিছু করা সম্ভব হয় না।
কোভিডের সময় দেখা গেছে, প্রণোদনার অর্থ বড় ব্যবসায়ীরাই পেয়েছেন, ছোটরা তেমন একটা পাননি। অর্থাৎ সরকারের দৃষ্টি বড়দের দিকে, ছোটদের দিকে নয়, এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। মানুষ মনে করছে না, তাদের দুর্ভোগ লাঘবে সরকার কিছু করছে।
আরেকটি বিষয় হলো, দীর্ঘদিন উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকলে সামষ্টিক অর্থনীতিতেও তার প্রভাব পড়ে। যেমন কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হন। সেই সঙ্গে সামনে নির্বাচন, এই বাস্তবতায় চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ কমতে পারে বলেই আশঙ্কা সেলিম রায়হানের।
মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় নীরব ঘাতক। এর কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায় এবং পরিণামে জীবনচক্রেও প্রভাব পড়ে। সে কারণে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকা উদ্বেগজনক বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা উচিত। পারিবারিক কার্ডের প্রাপ্তি ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যাপ্তি বাড়ানো যেতে পারে, তাহলে বাজারের ওপর চাপ কিছুটা কমবে। সীমিত আয়ের মানুষেরা কিছুটা স্বস্তি পাবেন।