Published in প্রথম আলো on Tuesday 14 July 2020
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান। করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে গত ১৭ জুন তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। আলোচনায় এসেছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের চিত্র; স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে বাজেট বরাদ্দ, দেশে করোনা পরিস্থিতি ও তা মোকাবিলার উপায় এবং করোনার কারণে বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাব্য রদবদলসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়। ভিডিও যোগাযোগের অ্যাপ জুমে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম কিস্তি আজ
প্রথম আলো: আপনারা ১৯৭২ সালে এমন একটি সংবিধান গ্রহণ করেছিলেন, যাতে বলা ছিল যে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। এর অর্থ হলো বেকার, রোগব্যাধিগ্রস্ত কিংবা বিধবা বা এতিমদের জন্য ত্রাণ নয়, সরকারি সহায়তা দিতে হবে। আপনারা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। দেশে এখন তেমনই এক পরিস্থিতি।
অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, সামাজিক নিরাপত্তার (সোশ্যাল সিকিউরিটি) অধিকার নিশ্চিতে সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন। এ বিষয়টি এখন রাষ্ট্রের মূলনীতিতে রয়েছে, যা মৌলিক অধিকারে থাকা উচিত। যেমনটা নেলসন ম্যান্ডেলা করেছেন। নেপালসহ আরও কিছু দেশ এটা করেছে। তারা বিষয়টিকে রাষ্ট্রের মূলনীতি থেকে মৌলিক অধিকারের আওতায় নিয়ে এসেছে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
রেহমান সোবহান: আমি একমত। আমরা যখন সংবিধানে এ বিষয়গুলো ঢুকিয়েছিলাম, তখন নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ছিলেন এমন একজন নেতা, যিনি বিশ্বাস করতেন নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অবশ্যই পূরণ করতে হবে। ছয় দফার ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য ছিল। যদি তিনি সংবিধানে উল্লিখিত নীতির অন্তর্ভুক্তি সমর্থন করতেন, তাহলে তা পূরণ করতেন। যদিও এটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়নি, তারপরও তিনি বিশ্বাস করতেন যে সংবিধান অনুসারে প্রতিশ্রুতি পূরণের মর্যাদা পূরণ করা তাঁর মৌলিক দায়িত্ব। এই পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা কমিশনে আমরা অনুধাবন করলাম যে সংবিধানের ভিত্তিতে তাঁর অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের এখতিয়ার আমাদের দেওয়া হয়েছে। জনগণের এসব অধিকারের সুরক্ষা এবং তা পূরণ করতে সম্পদের বণ্টন এবং প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে।
কিছু দেশে সমস্যার উদ্ভব ঘটে, কারণ সেসব দেশের নেতৃত্ব সংবিধানে দেওয়া প্রতিশ্রুতি, যা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত নয়, শুধুই রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি হিসেবে ঘোষিত এবং সেই কারণে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে বাধ্যবাধকতা অনুভব করে না।
ভারত কী করেছে, সেটা আপনি দেখুন। আপনি আইন তৈরি করেন, কিংবা আপনি আদালতে গিয়ে বলুন, এসব নীতিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হোক। ভারতে খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার এবং কর্মসংস্থানের অধিকারের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটাই করা হয়েছে।
এগুলোর সবটাই মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা আইন দিয়ে সুরক্ষিত এবং সরকার তা নিশ্চিত করতে বাধ্য। কাজেই আমাদের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে, যেখানে সাংবিধানিক অধিকার আইনিভাবেই মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রয়োগ করা যায়, আমরা এসব অধিকার প্রতিষ্ঠায় আদালতের দ্বারস্থ হতে পারি। তবে সরকার এগুলো প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেবে কি না, সেটা নিশ্চিত নয়। বিষয়টা নির্ভর করছে এ ধরনের বাধ্যবাধকতা পূরণে তারা প্রস্তুত কি না, তার ওপর।
প্রথম আলো: আপনি বর্তমান পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখেন, যেখানে ব্যাপক বাজেট ঘাটতি রয়েছে? অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ঝুঁকিতে থাকা গোষ্ঠীগুলো অথবা দারিদ্র্যসীমার নিচে যারা রয়েছে, তাদের সুরক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ ব্যয় থাকা দরকার। কিন্তু জিডিপির ৬ শতাংশের সমান বাজেট ঘাটতির আলোকে এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন। সরকারের এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
রেহমান সোবহান: ৬ শতাংশ বাজেট ঘাটতি নিয়ে আমি খুব বেশি চিন্তিত নই। দুঃখজনক বিষয় হলো, সরকার কিংবা সিপিডিসহ অন্যদের গবেষণায় গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণই করা হয়নি, কতটা বাজেট ঘাটতি গ্রহণযোগ্য। বাজেট ঘাটতিতে প্রকৃত সমস্যা হলো, আমাদের এমন উপযুক্ত উৎপাদন সক্ষমতা থাকতে হবে, যখন আমরা সত্যিই সরকারি অর্থ ব্যয় করতে চাইব, তখন যেন সেটা কাজে লাগাতে পারি। আজ আমাদের দেশের শিল্প ও কৃষি খাতে প্রচুর অব্যবহৃত সক্ষমতা রয়েছে, যেখানে আমরা উৎপাদন বাড়াতে পারি। এসব সক্ষমতার ব্যবহার নিশ্চিতে আমরা যদি বাজেট থেকে বরাদ্দ দিতে পারি, তাহলে বাজেট ঘাটতির নেতিবাচক প্রভাব এড়ানো সর্বদাই সম্ভব।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আরও অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারি। ৬ শতাংশ বা তার কাছাকাছি পর্যন্ত বাজেট ঘাটতি যদি ঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে এতে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কিংবা সামাজিক সুরক্ষার ব্যয় মেটাতে অর্থনীতির পণ্য উৎপাদন ও সেবা দেওয়া খাতগুলোয় উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এই ঘাটতি ব্যবহার করা হয়। কাজেই এ নিয়ে আমি খুব বেশি চিন্তিত নই। ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সহনীয় মাত্রার বাজেট ঘাটতি নিরূপণে আমাদের সবারই গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করতে হবে। এ মুহূর্তে বিশ্বব্যাংক ও অন্যদের মতো ৪ শতাংশ বা ৫ শতাংশের হিসাব দাঁড় করানোটা আসলে প্রাথমিক ধারণা ছাড়া কিছুই না। তাদের আসলে বাজেট ঘাটতির সহনীয় মাত্রার বিষয়ে প্রকৃত কোনো জ্ঞান বা জানাশোনা নেই।
প্রথম আলো: নোবেলজয়ী অধ্যাপক অভিজিৎ ব্যানার্জি সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলোচনার সময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনে টাকা ছাপানোর কথাও বলেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টির যৌক্তিকতা কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?
রেহমান সোবহান: বাজেট ঘাটতি এক বিষয়, টাকা ছাপানো আরেক বিষয়। সরকারি ব্যয়ের প্রয়োজন মেটাতে বাজেট ঘাটতি রাজস্বের পথে হাঁটে। আর টাকা ছাপানো বাজেট ঘাটতির আরেকটি রূপ, যেখানে আমাদের আয় বা সঞ্চয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হবে। উভয় বিষয়ই নির্ভর করবে অর্থনীতির উৎপাদন সক্ষমতা কতটুকু সহ্য করতে পারবে, তার ওপর। আমরা যদি টাকা ছাপানোর পথে যাই, তাহলে কিছু সময়ের জন্য এটি কাজে আসবে। এটি নিশ্চিতভাবেই কাজে আসবে, তবে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য নয়।
প্রথম আলো: অধ্যাপক বিনায়ক সেনের একটি সাক্ষাৎকার সম্প্রতি প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে। এতে বিনায়ক সেন বলেছেন, ১৪ শতকে ইউরোপে যখন প্লেগ ছড়িয়ে পড়ল, সে সময় কোয়ারেন্টিন, লকডাউনের ধারণা কাজে এসেছিল। কিন্তু ১৮৩০ সালে যখন কলেরা ছড়িয়ে পড়ল, তখন আর ওই পদ্ধতি কাজে এল না। একে বলে নিয়মানুবর্তী মডেল (ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার)। আমি নিশ্চিত, আপনি লক্ষ করছেন যে লকডাউন দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশ কী সমস্যায় পড়ছে। এখন লাল, সবুজ ও হলুদ এলাকা চিহ্নিত করে অঞ্চল ধরে ধরে লকডাউন করছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই পদ্ধতি সেভাবে কাজ করছে না। সমস্যাটি আপনি কীভাবে দেখছেন? আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?
রেহমান সোবহান: আলাদা দুই শতাব্দীর পরিস্থিতির মধ্যে তুলনা অর্থবহ বলে আমি মনে করি না। ১৪ শতক বলেন, কিংবা ১৮ শতক, সে সময় যে অঞ্চলজুড়ে রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল, সেখানকার জনসংখ্যা ছিল কম। কাজেই সমস্যা মোকাবিলা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। যে অঞ্চলজুড়ে মানুষের বসবাস ছিল, তার আয়তন ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট এবং তা নিয়ন্ত্রণও ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। ১৪ শতক আর ১৮ শতকের পার্থক্য হলো ১৮ শতকে অপেক্ষাকৃত জনসংখ্যা বেশি ছিল, অধিকসংখ্যক মানুষ নগরাঞ্চলে বসবাস করত। কাজেই লকডাউন করাও ছিল অপেক্ষাকৃত কঠিন। একই সমস্যা এখনকার জন্যও প্রযোজ্য। ঢাকায় ২ কোটির বেশি মানুষের বাস। এই দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। কোয়ারেন্টিন কার্যকর করা আমাদের জন্য অপেক্ষাকৃত কঠিন কাজ। কিন্তু চীন আর ভিয়েতনাম দেখিয়ে দিয়েছে যে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকেও কোয়ারেন্টিন করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন অপেক্ষাকৃত সুসংগঠিত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সরকার। একই সঙ্গে দরকার জনসমর্থনও, যেখানে জনগণ নিয়ম মানতে প্রস্তুত থাকবে।
আমাদের জন্য প্রয়োজন এই দুটি শক্তিকে কাজে লাগানো:
১. নিয়ম মানার ইচ্ছা। বাংলাদেশে নিয়ম মানার কিংবা শৃঙ্খলা মানার প্রবণতা খুবই কম।
২. সরকারের সক্ষমতা ও শাসন পদ্ধতির গুণগত মান যথাযথ হলে শৃঙ্খলা আনা যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লকডাউন বলুন কিংবা ঘোষিত ছুটি, আমাদের সরকার নিয়ামুবর্তিতা আনার ক্ষেত্রে খুব বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। আমরা যদি প্রকৃত অর্থেই নিয়ম মানাতে পারতাম, তাহলে লকডাউন করতে পারতাম। কিন্তু সবকিছু নির্ভর করে কতটা যথাযথভাবে আমরা তা প্রয়োগ করতে পারব, তার ওপর। বাংলাদেশে শুধু লকডাউন কিংবা কোয়ারেন্টিন করার ক্ষেত্রে নয়, যেকোনো নিয়মই দুর্বলভাবে মানা হয়েছে। কারণ, এসব নিয়ম সব ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। এসব ক্ষেত্রে সব সময়ই কিছু ব্যতিক্রম থাকে। আপনি যদি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হন, কিংবা আপনি এমন অবস্থানে থাকেন যেখান থেকে অর্থ দিতে পারেন, তাহলে আপনার জন্য নিয়ম সব সময়ই শিথিল। এ বিষয়টা একবার যখন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়, তখন সবাই মনে করতে শুরু করে যে সে–ও কোনো না কোনোভাবে নিয়ম এড়াতে পারবে। এমন পরিস্থিতিতে সব ক্ষেত্রে সমহারে কোয়ারেন্টিন করতে হবে, সব জায়গায় সমানভাবে নিয়মের প্রয়োগ ঘটাতে হবে এবং আমাদের প্রশাসনিক ও আইন প্রয়োগকারী ব্যবস্থাকে নজরদারি করতে হবে যে সবকিছু ঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না। কোয়ারেন্টিনের সময় মানুষের চাহিদা পূরণ করতে হবে। যাদের খাবার নেই, তাদের খাবারের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এর সবকিছুর জন্য চাই প্রস্তুতি, উপকরণ। তবে সবার আগে দরকার উচ্চমাত্রার সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা। কোভিড মোকাবিলায় পরামর্শ দিতে সম্প্রতি সফর করে যাওয়া চীনা প্রতিনিধিরা আইন প্রয়োগ বা তা নজরদারিতে আমাদের অক্ষমতার কথা পরিষ্কারভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
প্রথম আলো: দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং এর ত্রুটি ও দুর্বলতার দিকে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। করোনা পরীক্ষার ফলাফল এবং হাসপাতালে রোগীর উপচে পড়া ভিড় আপনি লক্ষ করছেন। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার উপায় কী? পুরো বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
রেহমান সোবহান: স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বহু বছর ধরেই সরকার অবহেলা করে আসছে।
প্রথম আলো: এটা জিডিপির ১ শতাংশেরও কম।
রেহমান সোবহান: জিডিপির সঙ্গে তুলনা করলে বড় অঙ্কের ব্যয় বেসরকারি খাতে হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয়ের একটি বড় অংশ যে বেসরকারি খাতে চলে যাচ্ছে, তা আমলে নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ মানুষ পকেটের টাকা খরচ করে স্কয়ার, অ্যাপোলোর মতো উঁচু মানের বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা নিম্নমানের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, এমনকি ওষুধের দোকান, চিকিৎসকের কাছ থেকে সেবা কিনছে। সীমিত সম্পদ দিয়ে হলেও একটি দায়িত্বশীল সরকারকে জনগণের চাহিদা মেটাতে সুগঠিত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা এই খাতকে অবহেলা করেছি। শুধু কম বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমেই এই খাতকে উপেক্ষা করা হয়নি, আমার জন্য সিপিডির করা হিসাবে উঠে এসেছে যে বছরের পর বছর ধরে বরাদ্দকৃত বাজেট ব্যয়ের ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা ছিল সবচেয়ে বেশি।
আমরা এখন যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি, তা হলো, আমাদের একটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে অভিজাত শ্রেণি, শুধু বিত্তবানেরাই নয়, সরকারের উঁচু পর্যায়ের লোকজন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সবাই কম-বেশি সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এড়িয়ে চলছে। সবাই এখন বেসরকারি খাত থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছে। যারা সচ্ছল তারা যায় ভালো কোনো বেসরকারি হাসপাতালে। আর শীর্ষ অভিজাতরা স্বাস্থ্যসেবা পেতে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, ভারত এবং এমনকি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে যায়। এখন যেটা হয়েছে যে শাসকশ্রেণি সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা একরকম পুরোপুরি পরিত্যাগ করেছে। এই খাতে কী ঘটছে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে সে সম্পর্কে তাদের আসলে কোনো ধারণাই নেই।
আজ আমরা স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই হাল আবিষ্কার করছি, কারণ লকডাউন ব্যবস্থার কারণে কেউই দেশ ত্যাগ করতে পারছে না। ফলে করোনায় আক্রান্ত ভিআইপিরা আজ সিএমএইচের (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল) মতো গুটিকয়েক সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যাচ্ছেন, যেখানে মানসম্পন্ন সেবা পাওয়া যায়। তবে এই গুটিকয়েক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র দিয়ে পুরো চাহিদা মেটানো প্রায় অসম্ভব। এখন সাংসদ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, প্রশাসনের লোকজন, এমনকি স্বাস্থ্যসেবা খাতের কর্মকর্তারাও সংক্রমিত হচ্ছেন। তাঁদের দক্ষতার সঙ্গে চিকিৎসা দিতে না পারায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো এখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এখন আমাদের শাসকশ্রেণি পাচ্ছে। এর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজে কী ঘটছে, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন কখনো বোধ করেনি কেউই। একসময় সমাজের অভিজাতদের অনেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ কিংবা পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা নিত। আমার মনে আছে, বঙ্গবন্ধুর বাবা যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তাঁকে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায়ই চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। সে সময় আমাদের সরকারি ব্যবস্থা ছাড়া বিকল্প কিছু ছিল না। আজ আমরা সরকারি ব্যবস্থাকে ফেলে রেখেছি নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য। সরকারি সেবার ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এই চাহিদা পূরণে বিনিয়োগ হয়েছে অপর্যাপ্ত। সরকারি ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যাও প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম। আবার অনেকে বেসরকারি হাসপাতালেও সময় দিচ্ছেন। ফলে রোগীর প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার অবস্থানে তাঁরা নেই। অভিজ্ঞতা থেকে আজ বলতে পারি, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় বড় বিনিয়োগের পাশাপাশি মানসম্পন্নভাবে পরিচালনা নিশ্চিতে আমাদের অত্যন্ত বাস্তবসম্মত নীতি নির্ধারণ করতে হবে।
বর্তমান বাজেট কোভিড–সম্পর্কিত বিষয়গুলোসহ স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট নয়। সরকারকে অবশ্যই এই অর্থ বছর এসব প্রতিশ্রুত ব্যয়ের ফলাফল কী হবে, তা পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। এতে বিভিন্ন জেলায় অন্তত ১০টি হাসপাতালের এমন উন্নয়নের কথা থাকতে হবে, যেগুলো সিএমএইচের মতো স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারবে এবং এসব হাসপাতালে এমন সুবিধা থাকবে কোভিড চিকিৎসায় যা সিএমএইচের আছে। আগামী এক বছরে অন্তত এমন ১০টি হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে। এই চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের জন্য সরকারকে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি ও লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সরকার প্রয়োজনীয় জনবল সরবরাহ করবে, এ বিষয়টি নিশ্চিতে মানসম্পন্ন তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করবে। তারা স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া প্রতিটা কর্মীর পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত করবে। তারা পরীক্ষা কার্যক্রম এমন পর্যায় পর্যন্ত বাড়াবে, যেখানে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়েও পরীক্ষার হার বেশি হবে। এগুলোর সবই লক্ষ্য হিসেবে নেওয়া উচিত এবং প্রতি তিন মাস পরপর অগ্রগতি মূল্যায়ন করা উচিত। এই উপায়েই বাজেট প্রতিশ্রুতি পূরণ সম্ভব। এখন তো সরকার কেবল অর্থ ব্যয়েরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতিতে বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে তারা কী করবে এবং স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে তারা কী পদক্ষেপ নেবে, তার যথাযথ কোনো উল্লেখ নেই।
* মূল সাক্ষাৎকারটি ইংরেজিতে নেওয়া। ইংরেজিতে সাক্ষাৎকারটি পড়ুন প্রথম আলোর ইংরেজি অনলাইনে। https://en.prothomalo.com/
বাংলা অনুবাদ: আবু হুরাইরাহ্ ও রাজিউল হাসান