Published in সকালের খবর on Wednesday, 15 March 2017
ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর সুদ মওকুফ ২৭৬ কোটি টাকা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাতে ঋণ অনিয়ম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুদ মওকুফের হিড়িক পড়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক তদবিরে বড় অঙ্কের সুদ মওকুফ করে যাচ্ছে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তথ্যে জানা যায়, গত ডিসেম্বর-১৬ মাসেই ব্যাংকগুলো ২৭৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলোর ১৫৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। ডিসেম্বর শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর প্রকৃত লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫১১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর মধ্যেও ব্যাংকগুলোতে সুদ মওকুফের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এতে ব্যাংকগুলোর আয় যেমন কমছে, তেমনি বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায়ও পিছিয়ে পড়ছে।
এদিকে, উচ্চ আদালতের এক রুলের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণগ্রহীতার সুদ মওকুফ ও ঋণ অবলোপনের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে গত ৮ মার্চ তফসিলি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর কাছে দেওয়া পত্রে বলা হয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর-১৬ভিত্তিক তারিখ পর্যন্ত সুদ মওকুফ ও অবলোপনকৃত ঋণ সংক্রান্ত তথ্যাদি আগামী ১৬ মার্চ-১৭ তারিখের মধ্যে প্রেরণ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, উচ্চ আদালতের রুলে ঋণ মওকুফের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যাংক ঋণের আসল মাফ করতে পারে না। তারপরও কোনো ব্যাংকে এমন কোনো ঘটনা ঘটে থাকলেও তাও জানাতে বলা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, প্রতি প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে ঋণ অবলোপনের প্রতিবেদন তৈরি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাছাড়া ব্যাংকগুলোকে সুদ মওকুফের মাসিক ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিপোর্ট পাঠাতে হয়। তাই ব্যাংকগুলোকে পূর্বে প্রেরিত তথ্যের সঙ্গে সমন্বিত রিপোর্টের মিল থাকার বিষয়টিও অবগত করা হয়েছে।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকগুলো জনগণের কাছ থেকে নির্দিষ্টহারে সুদ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমানত সংগ্রহ করে। পরে এই অর্থ অন্য গ্রাহককে ধারও দেয় নির্দিষ্টহারে সুদ আদায়ের শর্তে। ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় যোগ করে কিছু বাড়তি মুনাফা ধরে ঋণ বিতরণে সুদহার নির্ধারণ করে। তবে খেলাপি ও ঝুঁকিভিত্তিক ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে গিয়ে অনেক অর্থ অলস রেখে দিতে হয়। এতে ঋণ বিতরণে সুদহার আরও বেড়ে যায়। কিন্তু ব্যাংকগুলোর মধ্যে এই সুদ মওকুফের প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাব বা অন্য কোনো কারণে সুদ মওকুফে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যারা সুদ মওকুফের সুবিধা নিয়েছেন তাদের বড় অংশই ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম মানেননি। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব, পরিচালকদের প্রভাব ও ব্যাংকের শীর্ষ পদে থাকা অনেকের প্রভাবেও সুদ মওকুফের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, এভাবে কিছু মানুষ সুদ মওকুফের সুবিধা পেলে অন্য যারা নিয়মিত ঋণের টাকা পরিশোধ করেন তারাও ঋণের টাকা ফেরত দিতে অনীহা দেখাবেন। বিভিন্নভাবে মওকুফের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবেন। এতে ব্যাংকগুলোতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও শক্ত অবস্থান নিতে হবে। ব্যাংকগুলো মূলত ২০০৬ সালে জারিকৃত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে সুদ মওকুফ করে থাকে। এতে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড আদায় নিশ্চিত করে এবং ব্যাংকের আয় খাত বিকলন না করেই কেবল আরোপিত সুদ মওকুফের বিধান রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ ব্যাংক সুদ মওকুফে কস্ট অব ফান্ড শিথিল করে ঋণগ্রহীতাকে সুযোগ দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই পরিপত্রে ব্যবসার দুর্দশাজনিত কারণে সুদ মওকুফের বিধান থাকলেও অন্য কারণ দেখিয়েও সুদ মুওকুফ হচ্ছে।